মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতা—সীমাহীন জীবন প্রবাহের বিনির্মাণ

যে কবি সময়ের স্বর শুনেছিলেন। যে কবি মাটির গন্ধে জেগে উঠেছিলেন। যে কবি মানুষের ক্রন্দনে মন ভিজিয়েছিলেন। সেই কবিই মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিলেন। মানুষের অধিকারের কথা, অন্যায়ের প্রতিরোধের কথা, রাষ্ট্রযন্ত্রের শোষণের কথা তিনিই তো কবিতায় বলতে চেয়েছিলেন। তাই কবিতাই তাঁর কাছে অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। শব্দই তীক্ষ্ণশর হয়ে বিদ্ধ করেছিল মর্মকে। কবিতা শুধু বিলাসিতা নয়, জীবনের নানা অন্তরায়কে, সমাজের নানা অসামঞ্জস্যকে এবং রাষ্ট্রের নানা অমানবিকতাকে দূর করার এক মেধাবী অস্ত্র বলেই তিনি মনে করেছিলেন। তাই তার কন্ঠে বেজে উঠেছিল: 

“ক্রন্দনরতা জননীর পাশে 
এখন যদি না থাকি 
কেন তবে লেখা,কেন গান গাওয়া 
কেন তবে আঁকাআঁকি?

নিহত ভাইয়ের শবদেহ দেখে 
যদি না-ই হয় ক্রোধ 
কেন ভালবাসা,কেন বা সমাজ 
কিসের মূল্যবোধ!
যে মেয়ে নিখোঁজ,ছিন্নভিন্ন 

জঙ্গলে তাকে পেয়ে 
আমি কি তাকাব আকাশের দিকে 
বিধির বিচার চেয়ে?

আমি তা পারি না  
যা পারি কেবল সেই কবিতায় জাগে 
আমার বিবেক, আমার বারুদ 
বিস্ফোরণের আগে।”

হ্যাঁ,আমাদের মনে আছে ২০০৬ সালে হুগলি জেলার সিঙ্গুরে টাটাদের মোটর কারখানা স্থাপনের জন্য জমি দখলের বিরুদ্ধে কৃষকেরা জমি বাঁচাও আন্দোলনে নেমে পড়েছিল।  সরকারিভাবে জমি অধিগ্রহণ কিছুতেই তারা মানতে পারেনি। কবি কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদী হয়েছিলেন। সিঙ্গুর আন্দোলনেই তাপসী মালিককে ধর্ষণ করে খুন করা হয় এবং অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ছিন্নভিন্ন তার দেহ পাওয়া যায়। এই ঘটনাও সেদিন সারা দেশকে তোলপাড় করে দিয়েছিল। এভাবে একটি মেয়ের মৃত্যুও ছিল খুবই মর্মান্তিক ও যন্ত্রণাদায়ক। কবিও নিজের বিবেককে ঘুমিয়ে রাখতে পারেননি। তাই কবিতায় গর্জে উঠেছিলেন। বিধির বিচারের আশা নয়, মিলিত মানুষের প্রতিরোধের শক্তিই এর উপযুক্ত বিচার করবে। আর এই মানুষেরাই হলেন কবি-শিল্পী-গায়ক-লেখক।

ধানখেত থেকেই শুরু হয়েছিল আন্দোলন তাই কাব্যের নামও ধানখেত। যে সময় আন্দোলন শুরু হয়েছিল সেইটি ছিল জানুয়ারি মাস। দু-তিন ফসলী জমিগুলিতে সেই সময়ও বোরো ধানের চাষ করা হয়েছিল। রোপিত ধানের চারায় কৃষকদের আশা ও স্বপ্ন মঞ্জুরিত হচ্ছিল। আর সেই সময়ই জমি দখলের হিড়িক পড়ে যায়।

তাই ধানখেত থেকে কাব্যের নাম কবিতাতেই কবি কবিতার প্রথম অংশে লিখেছিলেন:

“কিশোর ধানের চারা, শিশু ধান
ওড়ে ধর্মবক
উদ্বেগে তাকিয়ে থাকি
আমিও তো কবিতা-কৃষক।”

প্রথমেই কবি জানিয়ে দিলেন কৃষকের সঙ্গে তাঁর কোনো তফাত নেই। জমি দখল হলে শুধু শিশুধানই মারা পড়বে না, ধর্মবকও উড়ে যাবে। কবিতা কৃষকও বাঁচবে না। কবিতার দ্বিতীয় অংশে লিখলেন আগ্রাসী শিল্প কারখানার ভয়ঙ্কর রূপের কথা:

“দানব জেগেছে আজ
কী অবাক, তারও
দুটো হাত
ঠেলা দাও
হয়ে যাবে কাত্।”

জেসিবি এবং জেসিপি ইত্যাদি কতরকম মাটিকাটা যন্ত্রের আমদানি করে যারা নির্মমভাবে হত্যা করে চলেছে প্রকৃতিকে। কবি তাদেরই ঠেলা দিতে বললেন। কৃষকেরা প্রতিবাদ করতে গিয়ে বন্দুকের নলের মুখে পড়ল। কেউ হলো মৃত, কেউ হলো আধপোড়া। তাদের কথা লিখলেন কবিতার তিন নং অংশে:

“রাজা ধানখেতে ছুটিয়েছে 
ঘোড়া
হতাহত পড়ে আছে
কেউ বুলেটে বেঁধা
কেউ আধপোড়া।”

সেই ইতিহাস, সেই ঘটনা, সেই দৃশ্য, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড আজও জ্বল জ্বল করে ওঠে। বাঙালি কোনোদিনই ভুলতে পারবে না। কিন্তু কবির উদ্বেগ আরও গভীর,আরও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। জমি দখলকে সেই কারণেই বর্গী হানার সঙ্গে তুলনা করলেন। কবিতায় লিখলেন:

“ওরা যদি এসে গায়ে হাত-দেয় 
মা-র কোল থেকে শিশু কেড়ে নেয়  
শুরু হলে সেই কালো অধ্যায় 
আমি বলবোই এটা অন্যায়।

সেই যুগ যদি এই যুগে আসে 
গ্রামগুলি কাঁপে খাকি সন্ত্রাসে 
ঘোরতর সেই সর্বনাশে 
কৃষিজমি যায় নগরের গ্রাসে 
আমি বলবোই সেটা অন্যায়।

ধানখেতে যদি নামে রাজ হাতি 
অতি বিদ্যুতে নেভে দীপবাতি 
শুরু হয়ে যায় বর্গী ডাকাতি 
ফের এলে সেই কালো অধ্যায় 
আমি বলবোই সেটা অন্যায়।”

কৃষিসভ্যতার প্রতি কবির দরদি মনের অফুরন্ত এক ভালোবাসার পরিচয় যেমন এখানে ফুটে উঠেছে, তেমনি নিরীহ শান্ত গ্রামগুলোর সরল স্বাভাবিক জীবনের কাছেই প্রকৃত আনন্দের মুখ দেখতে পেয়েছেন। সুতরাং সেখানে অতি বিদ্যুতের আলো কাম্য নয়। জোর করে জমি দখল করে, মায়ের কোল থেকে শিশু কেড়ে হত্যা করে নির্বিবাদী জীবনকে অশান্ত করতে দিতে চান না। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার। কোনো স্বার্থের কাছেই তিনি নিজেকে বিক্রি করতে পারবেন না। সহানুভূতিশীল বিবেকবান মানবিক কবির হৃদয়ের স্পন্দনের পরিচয় পাওয়া যায় এইসব কবিতায়। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় তিনি নিজেও সামিল হয়ে এই আন্দোলনের শরিক হতে চান। তাই নির্ভেজাল ও অকপট উচ্চারণে কবিতায় আলো ফেলেছেন। এই কবিকেই আমাদের চিনতে ভুল হবে না।

যে কবির কথা বলতে চাইছি তিনি মৃদুল দাশগুপ্ত (জন্ম: ৩ এপ্রিল ১৯৫৫)। সারাজীবন প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকেই গ্রামীণ জীবনকে আত্মস্থ করেই লিখে গেছেন কবিতা। কখনো বাবু কালচারের ভেতর আত্মদর্শন করতে চাননি। জীবনের যে সহজাত সহজ সুন্দর রূপ আছে, পথের ধুলো থেকে নিসর্গ পর্যন্ত এই জীবনের মহিমা ব্যঞ্জিত হয়, মুহূর্ত থেকে মহাকাল ধারণ করে এই জীবনের স্বরূপ তাকেই তিনি উন্মোচিত করেছেন। কবিতায় একদিকে যেমন এসেছে সমসাময়িক প্রসঙ্গ, অন্যদিকে তেমনি এসেছে কাল-সীমাহীন জীবনধারার পরিচয়। রূপ-রূপান্তরে বহির্জগৎ ও অন্তর্জগতের সমন্বয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো: জলপাইকাঠের এসরাজ (১৯৮০), এভাবে কাঁদে না (১৯৮৬) গোপনে হিংসার কথা বলি (১৯৮৮), এখন ঘটনাচক্রে (১৯৯১), ঝিকিমিকি ঝিরিঝিরি (১৯৯৭), সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহ (১৯৯৮), আমপাতা জামপাতা (১৯৯৯), একটি রূপকথা (১৯৯৯), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৯), প্রেমের কবিতা (২০০১), ছড়া পঞ্চাশ (২০০১), কবিতা সহায় (২০০২), ধানখেত থেকে (২০০৭),  রঙিন ছড়া (২০০৮), কবিতা সংগ্রহ (২০০৯), সোনার বুদ্বুদ (২০১০), Selected Poems (২০১০), প্রিয় পঁচিশ (২০১১) ইত্যাদি। মৃদুল দাশগুপ্তের পিতা ছিলেন বরিশালের গৈলা-ফুল্লশ্রী গ্রামের জ্যোৎস্নাকুমার দাশগুপ্ত এবং মাতা ছিলেন যশোরের সান্ত্বনা দাশগুপ্ত। ১৯৬৬ সালে তাঁর ‘মোমবাতি’ নামে প্রথম কবিতা মুদ্রিত হয়। তারপর ১৯৭১ সালে ধূর্জটি চন্দ সম্পাদিত এবং পত্রিকায় সাতটি কবিতা প্রকাশিত হলে তিনি সত্তর দশকের কবি হিসেবেই পরিচিতি পান। কেননা এখান থেকেই তাঁর তিনটি কবিতা নিয়ে কবিতা সিংহের সম্পাদনায় ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় সত্তর দশকের কবিতা সংকলন ‘সপ্তদশ অশ্বারোহী’। এই সপ্তদশ অশ্বারোহীর মধ্যে তিনিও একজন। ১৯৭৫ সালে জুলোজিতে স্নাতক হয়ে ১৯৭৬তে প্রথম শিক্ষকতার চাকরিতে যোগদান করেন। এই বছরই তিনি ন্যাশনাল রাইটার্স অ্যাওয়ার্ড পান একজন নবীন লেখক হিসেবে। অল্পদিনেই ছেড়ে দেন শিক্ষকতার চাকরি। তারপর ১৯৭৮-তে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন সাপ্তাহিক ‘পরিবর্তন’ পত্রিকার মাধ্যমে। তারপর একে একে ১৯৮২-তে যুগান্তরে এবং ১৯৯১-এ আজকাল পত্রিকায়। 

লেখক জীবনের শুরু হয় লিটিল ম্যাগাজিনে লেখার মাধ্যমেই। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জলপাই কাঠের এসরাজ’ প্রকাশিত হলে পাঠকের কাছে তিনি সহজেই পৌঁছে যান। বিশেষ করে ‘বেলাভূমি’, ‘ভাইরাস’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘কয়েকজন’ ইত্যাদি পত্রিকায় তাঁর কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। তথাকথিত আত্মবিষণ্ণতা, প্রকৃতি বর্ণনা এবং গতানুগতিক পথে তিনি পা বাড়াননি। সাবলীল ছন্দোবদ্ধতার প্রয়োগে প্রতিবাদী কবিতায় একটি নতুন ভাষা পেয়ে গেলেন যা বাঙালি কবিতা পাঠকের কাছে সহজেই গৃহীত হলো। খুব সুউচ্চ স্বর নয়, অথচ এক অনপনেয় অভিঘাত সৃষ্টি করল মননে। উত্তাল সময়ের অস্থিরতা, হতাশা ও ক্ষোভকে আত্মস্থ করেই নিজস্ব পথ খুঁজলেন। রাজনীতির স্থূল কম্পন ও আবেগকে অতিক্রম করে স্লোগান বিবৃতির পর্যায়কে পাশ কাটিয়ে কবিতায় নিয়ে এলেন এক মেধাবী উত্তরণ। ভাঙনকালের প্রভাব থাকলেও বৃহত্তর মানবিক অবকাশে নান্দনিক সুষমায় নির্মিতি লাভ করল কবিতা। ‘জলপাইকাঠের এসরাজে’ লিখলেন:

“কোনওদিন কিছুই ছিল না, কিছুই কিছুই নেই আমাদের আজ
আমরা কি বাজাবো না জলপাইকাঠের এসরাজ?
ও কি ফুল? বুনো ফুল, গোলাপি পাপড়িময় চাবুকের দাগ
আমরা কি চলে যাবো? কখনও দেবো না ওকে পুরুষ-পরাগ?
অনেক লন্ঠন ওড়ে, হাওয়াবাতাসের রাত, কেউ এল আজ?
বাজাবো না আমাদের, বাজাবো না জলপাইকাঠের এসরাজ?”

কোনোদিন কিছুই ছিল না,আজও কিছুই নেই, তাহলে আমরা কি জলপাই কাঠের এসরাজ বাজাবো না? গোলাপি পাপড়িময় চাবুকের দাগ পড়ে আছে। তাহলে আমাদের কি চলে যাওয়া ঠিক? ‘পুরুষ-পরাগ’-এর সংযোগ কি ঘটবে না? হাওয়াবাতাসের রাতে অনেক লণ্ঠন উড়ে যায়। কারা আসে আজ? সব প্রশ্নের মধ্যেই একটা পরিস্থিতির উত্থাপন যেমন ঘটেছে, তেমনি দৃপ্ত সত্তার জাগরণও নাড়িয়ে দিয়েছে। জলপাই কাঠের এসরাজে সেই পৌরুষেরই পরিচয়। গড্ডলিকা প্রবাহ থেকে নিজেকে বিছিন্ন করে আত্মস্থিত উত্থানের সুরঝংকার সমস্ত ক্ষত ও স্তব্ধতাকে ছাপিয়ে গেছে। এখানেই নিজস্ব সংরাগের অপূর্ব পরিবৃত্তি চাবুকের মতো সাঁই সাঁই করে ওঠে।যে কবিতার জন্ম কবি দিতে চলেছেন তা সকলের মতো হবে কেন? সেই নিজস্বতার কথাই জলপাই কাঠের এসরাজ। 

‘সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহ’-তে রহস্য আরও ঘন হয়ে উঠেছে, কবিও সেখানে স্বয়ংচারী দেদীপ্য সংসারী। স্বপ্নের মতো অপার্থিব হলেও বাস্তবের নিরক্ষীয় ক্রিয়াসংযোগে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি উঠে এসেছে। কবিতাটিতে লিখেছেন:

“রূপ মাত্র অন্ধকার। সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহে কে না জানে সন্ধ্যাই সকাল।
আমি তো ভূতের হাসি টের পাই দিবসেও, অধিকন্তু নিশীথের অর্থভেদ ক’রে
সঞ্চয় বাড়াই, দেখি চতুর্দিকে লাস্যময়ী বিবিধ রমণী।
কেউবা ভাষার ভুলে দ্বারে উপস্থিত আর কারো কারো রন্ধনের ছন্দে মৃদু ত্রুটি।
পত্নী একজন হবে! সে ওড়ে সংকেতে তার কৌতূহল ধর্মের সমান ব’লে                  

   উড়ন্ত আমিও—
হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ, পিঠে বোঝা বাসনের, স্বপ্নে দেখি কন্যা ঘুমে,পুত্র যায় শিস দিতে দিতে”

রূপই যখন অন্ধকার। তখন সূর্যাস্তের নির্মিত গৃহে তো সন্ধ্যাকেই সকাল বলতে হয়। নিশীথের অর্থভেদ ক’রে যে অভিজ্ঞতার সঞ্চয় কবি বাড়ান—সেখানেও ভূতের হাসি স্পষ্ট হয় দিবসেও। চতুর্দিকে লাস্যময়ী বিবিধ রমণীর ঢল। কারও ভাষার ভুল, কারও রন্ধনের ছন্দে ত্রুটি। আসলে কবি তাঁর নিজস্ব সময় বৃত্তের ভেতর কাব্যরচনার বিচিত্র পরিচয় তুলে ধরেছেন। সত্তর দশকের পরবর্তী সময়কালে অনেকেই নিজস্ব পথ খুঁজে পাননি। দিশাহীন কাব্যচর্চার ছান্দিক মাধুর্য পরিলক্ষিত হলেও তা ভ্রান্তিতে ভরা। একেই বলেছেন ‘রন্ধনের ছন্দে ত্রুটি’। কবি যেখানে পরিপক্ক পাকা রাঁধুনি, শব্দ-ভাবে যে রসায়নের প্রকল্প তুলে ধরেছেন যা সংকেতের ভাষা পেয়েছে। তাই লিখেছেন ‘পত্নী হবে একজন’। কাব্যদর্শী চেতনার আলোকশস্যে তা ধর্মের কৌতূহলের মতো। সৃজন সত্তার ঘোর স্বপ্নাতুর কন্যাসম যা ঘুমে আচ্ছন্ন, আবার পুত্রসম ধ্বনিময় যাকে বলেছেন ‘শিস দিতে দিতে’। ‘হেঁটমু্ণ্ড উর্ধ্বপদ’ এবং ‘পিঠে বোঝা বাসনের’ কথা দুটিতে জীবিকার কঠিন কঠোর লড়াই এর ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিজ সময়কে কেন্দ্র করেই একদিকে কবির ব্যঙ্গ অপরদিকে বাস্তবতাকে ছাড়িয়ে এক আত্মসত্যের গহন গভীরে পথান্বেষণই মূল বিষয়। পরবর্তীকালে তাই দেখতে পাই ‘আগুনের অবাক ফোয়ারা’র বিস্ফোরণ। সেখানেও শ্রেণি সচেতনতার পরিচয় ফুটে ওঠে।

বড়দের সঙ্গে সঙ্গে লিখলেন ছোটদের কথাও। কিন্তু সেখানেও কপর্দক শূন্য অসহায় মানুষের পরিচয় পক্ষীজীবনের মতোই ধরা পড়ল। সেখানেও শ্রেণিসচেতনতার সম্পর্কে কবি উদাসীন হতে পারলেন না। তাই লিখলেন:

“নাম বলেছি , ধাম বলেছি- এবং বয়স কত
সেই সঙ্গে এও বলেছি মা হয়েছেন গত।
দশখানা আঁক কষতে দিলে একটা হবে ভুল
আমাকে তাও নিতে নারাজ এই তোমাদের স্কুল!

কারণ আমার প্যান্টে ফুটো জামার কলার ফাঁসা
উড়াল সেতুর নীচে আমার পাখ-পাখালির বাসা।
বাবা উধাও পুলিশভ্যানে তখন আমি ছোটো,
মরার আগে মা বলেছেন মানুষ হয়ে ওঠো।

সেই কারণেই বই পড়েছি,পথ কুড়োনো বই
তোমার সঙ্গে আজকে না হোক,কালকে তো খেলবোই।”

জাগিয়ে তুললেন অসম্ভব মনের জোর। বেঁকে যাওয়া অস্তিত্ব যেন সোজা হয়ে দাঁড়ালো। মানুষ হওয়ার লক্ষ্যকে স্থির হতে দেখা গেল। প্রত্যেকটা মানুষের হৃদয়ে যে প্রতিবাদী সত্তা আছে,যে সংগ্রাম আছে, যে স্বপ্ন আছে তাকে তিনি দেখাতে চাইলেন। ছোটদের কথাও সর্বকালের মানুষের কথা হয়ে উঠলো। বেশ কিছু সিরিজ কবিতায় কবির দার্শনিক চেতনারও পরিচয় পাই। যখন মহাজীবনের ব্যাপ্তিতে মহানুভবতাও অনন্তের ধারক হয়ে ওঠে—তখনই কবির এই বোধ জন্মায়:

“আকাশে আয়নাখানি,ঘোরে পড়ে মনে হয়

                                     বিরাট রূপসী

নিচের ধারণাগুলি জড়ো হয়ে দোলে যত

                                 আমিও তো দুলি

বাতাসের দিকে কেন তারা ঠেলে, কেন বা

                আমিও গিয়ে এক কোণে বসি

তবু ভাসে, হাসে যেন, ঝলমল করে যেন

                        অগণিত চিন্তার কাঁচুলি”

মহাবিশ্বের মহাবিস্ময় হয়ে ওঠা তাঁর কবিতার ব্যাপকতা কতখানি, সামর্থ্য কতখানি, প্রাচুর্য ও তীব্রতা কতখানি একথা বোঝাতেই তিনি আরেকটি সিরিজ কবিতায় লিখেছেন:

“আমি ও কবিতাখানি মুখোমুখি বসে আছি,আমাদের উভয়ের কথোপকথনে 

ভাবে রাত্রি, থাকি থাকি; মদিরার ঢেউ দেয় বঙ্গোপসাগর

থামে চন্দ্র, তারাদল, নাটকীয় কত কিছু ঘটে যায় গগনে-গগনে

আবছা বাতাস এসে আমাদের টেনে নেয়, বিনা ঝড়ে ওড়ে এই ঘর 

সেগুন মঞ্জরী ঝরে গোপন কাঠের ভীরু মোহময় আবরণ থেকে

উল্কার আলো লেগে সচকিত লোহা যেন জ্বলে

শীতের কুয়াশা দেয় আমাদের ধীরে-ধীরে নীল রঙে ঢেকে

এ কবিতা মৃদুলের,প্রভাতে গুঞ্জনরত শিশুগণ বলে”

গ্রহ-নক্ষত্রের জগতে অর্থাৎ সৌরজগতেও যে উলটপালট কম্পনের প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং স্বয়ংক্রিয় এক মহাশক্তির জাগরণ টের পাওয়া যায় তা তিনি বোঝালেন। এই কারণেই তিনি শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকায় নিজের রচনা সম্পর্কে লিখেছিলেন: “কবিতা আকাশ থেকে নামে। আমার ভূমিকা অবতরণক্ষেত্রের। আমার মন ও মস্তিষ্ক সে-অবতরণে আলোকসম্পাত ও দিকনির্দেশ করে।” অর্থাৎ কবিতার যোগসূত্র যে বিরামবিহীন ব্রহ্মময় জগৎ এবং তা অনিঃশেষ তা তিনি বোঝাতে চাইলেন। ফরাসি কবি-প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক পল ভ্যালেরি(১৮৭১-১৯৪৫) ‘Pièces sur l’art’ (Pieces on Art,1934) গ্রন্থে কবিতার উৎস স্বর্গ হলেও তার অবতরণ ক্ষেত্র পৃথিবী বলে উল্লেখ করেছেন এবং আরও বলেছেন:

“A poem is never finished, only abandoned” অর্থাৎ একটি কবিতা কখনোই শেষ হয় না, শুধুমাত্র পরিত্যক্ত হয়।

এ কথার প্রতিধ্বনি অনেক উল্লেখযোগ্য কবির বক্তব্যের মধ্যেই পাওয়া যায়। টি.এস. এলিয়ট বলেছেন: “No poem is ever finished; it’s just abandoned.” অর্থাৎ কোনো কবিতা কখনোই শেষ হয় না; এটি পরিত্যক্ত হয়। পৃথিবীখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চিও বলেছেন: “A work of art is never finished, only abandoned.” অর্থাৎ শিল্পের কাজ কখনোই শেষ হয় না, শুধুমাত্র পরিত্যক্ত হয়।

শিল্পী বা কবি যেই হোন তাঁর সৃজনশীল সত্তার বহুমুখী পর্যায় স্বাক্ষর রেখে চলে। ‘দুর্ঘটনা’ নামক কবিতায় তাই কবি লিখেছেন “যতো গ্রন্থ ততো দুর্ঘটনা”। “ঈশ্বরের কিঞ্চিৎ অধিক” কাজ বলেই “তাই বাক্য,গুপ্ত বিদ্যা, পুস্তিকার প্রয়োজন”। লোহা লক্কর কংক্রিট সভ্যতার হৃদয়হীন যান্ত্রিক অনুভূতির জগৎকে তখন এভাবে রূপ দেন— “লোহার গণিত এসে ভিন্নতর বাগান সাজায়।” তেমনি তাঁর ‘ক্লাউন’ কবিতায় আমরা সেই ক্লাউনকেই খুঁজে পাই যে আমাদের মধ্যেই মিশে আছে। যে অন্ত্রনালীতে লুকিয়ে এনেছে হীরা। যার বাঁশি মহিষের ঘন কালো শিংধাতুমোড়া। যে গামবুট পরে পাহাড় ডিঙিয়ে এসেছে। সব শেষে সে যখন বলে:

“ভোরবেলা ভাঙিয়ে দেবে তো ঘুম? 

এই শোনো, আমারও তো ছিলো ডাকনাম”

তখনই বুঝতে পারি ক্লাউন কতখানি অনবদ্য হৃদয়বাদী। এই স্বর যেন আমাদেরই। এই আবেদন আমাদেরই অনুজ্ঞাকে ধারণ করে আছে। 

বহুধা বিস্তৃত এই সৃজনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াও তাঁর সমূহ সৃষ্টিতে ছড়িয়ে পড়ে। কবি যে শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি অনন্ত প্রজ্ঞার, অনন্ত আত্মার, অনন্ত ধারকের মধ্যেই নিষিক্ত ও চূড়ান্ত একটি রূপ তা তার জাগরণেই সেই সত্তা প্রকাশিত। বারবার নিজেকে জানান দিতে চেয়েছেন:

“আঙুলের মৃদু স্পর্শে আমার দোতারাখানি অতি ঊর্ধে বাজে

কখনো কাতরভাবে, ফুর্তিতে আবার যেন টিঙি টিঙি গুব গুব

এ ভূমি কম্পিত হয়,তোমারও কি নিদ্রা যায় আওয়াজে-আওয়াজে?

এক চন্দ্র যথাস্থানে, আর চন্দ্র জলে দেয় ডুব”

কবিতা শুধু দৈনন্দিনের পাওয়া না-পাওয়ার হিসেবের মধ্যেই বন্দি থাকেনি। সময়ের ধুলোবালিতে ম্লান, অসহায় মানুষের ক্রন্দনে দিশেহারা গতানুগতিক একঘেয়েমির পর্যায় অতিক্রম করে তা মহাকালের অনন্ত সীমানা স্পর্শ করেছে। তাই সৌরজগতের ঠিকানাও কবির ঠিকানা। স্বপ্নজীবনের প্রজ্ঞাময় সীমাহীন পরিসরও কবির বিচরণ ক্ষেত্র। বাস্তবতার ঊর্ধ্বে নির্মিত আরও এক উপলব্ধির জগৎ আমাদের ক্লান্ত করে না, বিধ্বস্ত ও বিমর্ষ করে না—সেই ঠিকানাও তিনি দান করেছেন। এখানেই কাব্যজগতের মুক্তি। আমাদের ক্রন্দনেরও মুক্তি। আমাদের হৃদয়েরও অনন্তগামী বহু বিপুল পর্যটন। অনন্ত জগৎ সম্পর্কে জার্মান উদ্ভিদবিদ ও প্রকৃতিবিদ ফার্দিনান্দ কোহন(১৮২৮-১৮৯৮) বিশেষত অনন্ত যৌবনের জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষা, মৃত্যুকে অতিক্রম করতে কবিতা এবং স্বপ্নের ভূমিকা ও শারীরিক অমরত্ব খোঁজার অসারতাকে আবিষ্কার করতেই ১৮৮৩ সালে নিউ ইয়র্কের ‘পপুলার সায়েন্স’ ভলিউম বাইশের মাসিক জার্নালে তিনি লেখেন:

“The more formidable the contradiction between inexhaustible life-joy and inevitable fate, the greater the longing which reveals itself in the kingdom of poetry and in the self-created world of dreams hopes to banish the dark power of reality. The gods enjoy eternal youth, and the search for the means of securing it was one of the occupations of the heroes of mythology and the sages, as it was of real adventurers in the middle ages and more recent times. . . . But the fountain of youth has not been found, and can not be found if it is sought in any particular spot on the earth. Yet it is no fable, no dream-picture; it requires no adept to find it: it streams forth inexhaustible in all living nature.”

অর্থাৎ অনিবার্য জীবন-আনন্দ এবং অনিবার্য ভাগ্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব যত তীব্র, কবিতার রাজ্যে এবং স্বপ্নের স্ব-সৃষ্ট জগতে বাস্তবের অন্ধকার শক্তিকে উচ্ছেদ করার আকাঙ্ক্ষা তত বেশি। দেবতারা শাশ্বত যৌবন উপভোগ করেন, এবং এটিকে সুরক্ষিত করার উপায় অনুসন্ধান করা ছিল পৌরাণিক কাহিনির নায়কদের এবং ঋষিদের পেশাগুলির মধ্যে একটি, কারণ এটি মধ্যযুগ এবং সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৃত দুঃসাহসীদেরই কাজ ছিল। . . . কিন্তু যৌবনের বেগ পাওয়া যায়নি, পৃথিবীর কোনো বিশেষ স্থানে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। তবু তা কোনো রূপকথা নয়, কোনো স্বপ্ন-চিত্র নয়; এটি খুঁজে পেতে কোনো যোগ্যতারও প্রয়োজন নেই: এটি সমস্ত জীবন্ত প্রকৃতিতেই অফুরান প্রবাহিত। এই অনন্ত শক্তির আধারকেই কবি আশ্রয় করেছেন। তাই বাস্তবের জড়তা অন্ধকার প্রতিবন্ধকতা কবির কাছে অতিক্রম করা সহজ হয়ে উঠেছে। জীবনের ক্ষণিকতা মৃত্যুর সীমাবদ্ধতাও কবিকে বন্দি রাখতে পারেনি। জীববিজ্ঞানী ফার্দিনান্দ কোহনের মতোই তিনিও অনন্ত জীবনের প্রবল স্রোতের কাছে নিজেকে পৌঁছে দিতে পেরেছেন। এই বোধ থেকেই তাঁর কবিতা ও স্ব-সৃষ্ট জগতের বিনির্মাণ। ভাবনারও মুক্তি। 

অনন্ত ভ্রমণের মহাকাশে এই অপার্থিবতার প্রয়োগে স্বতশ্চল হতে পেরেছিলেন  বলেই কবি বিচিত্র  কর্মপন্থা ও পদ্ধতির পরিচয়ও দিতে পেরেছেন। সবকিছুর মূলেই আছে সেই গতিময় ক্রিয়া। তাই প্রতিটি নিসর্গ যাপনেই গতিশীল ইমেজের জন্ম হয়েছে। রহস্যও ঘনীভূত হয়েছে। ‘একটি পাতা’ নামের কবিতায় লিখেছেন:

“কী ঘুম ঘুমিয়ে পড়ি, হাসে ইতিহাস
থামে সে গাড়ির চাকা,
লোকালয় হয় ফাঁকা,
ছিলো তো একটি চাঁদ, হয়ে গেলো সাতাশ-আঠাশ

আকাশও তো একা নয়,তদুপরি কয়েক আকাশ

সভয়ে একের পরে

টাল খায়,ভেঙে পড়ে,

সহসা সহস্র পাখি আঁচড়ায় হাজার বাতাস 

তখন নিদ্রার ঘোরে

আমারও তো দেহ ওড়ে

তবে কিনা পাশ ফিরি, বুক ভরে নিতে চাই শ্বাস”

এই স্বপ্নমেদুর ঘোরের ভেতর স্বয়ংক্রিয় চলনে আর কোনো বাধা থাকে না। ব্রহ্মময় যাপনের তীব্রতা এতই ক্ষুরধার হয়ে ওঠে যে,গভীর মগ্নতা থেকে একান্ত অভিনিবেশে তাকে ধারণ করতে হয়। জাদুবাস্তবের আশ্রয়েও বোধের পরিপুষ্টি ঘটে। যুক্তি পারম্পর্য ভেঙে পড়ে। একের মধ্যে বহু স্বরের জন্ম হয়। একটি আকাশ বহু আকাশের স্পট খুলে দেয়। একটা পৃথিবীতে অনেক পৃথিবীর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। এভাবেই কাব্য নির্মাণের পথ খুলে দিয়েছেন। সীমাহীন জীবনের প্রবাহকে ধারণ করেই এই বিনির্মাণ। কবিতার কিভাবে জন্ম হয়,কবিতার জন্য কতখানি জীবন মন্থন দরকার, সময়-ব্যক্তি-ইতিহাস চেতনার সঙ্গে সঙ্গে সমকালীন কবিদের সৃষ্টি সম্পর্কেও কতখানি ওয়াকিবহাল হতে হয় তা তিনি ভালো করেই জানতেন বলেই নিজস্ব পথ আবিষ্কার করা সহজ হয়েছিল। ‘কবিতা সহায়’ নামে গদ্যের বইটিতে সেই অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেছেন। কবিতার বাস্তবতা, উপলব্ধি ও দর্শনের আন্তরিক পর্যটনে ঋজু স্পষ্টবাক কবির অনায়াস গদ্য রীতির দৃষ্টান্ত এই বইটি।

কাব্য রচনার জন্য বিভিন্ন সময়ে তিনি বহু সম্মান ও পুরস্কারও লাভ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ২০০০ সালে ‘সূর্যাস্তে নির্মিত গৃহ’ কাব্যগ্রন্থের জন্য বাংলা অ্যাকাডেমী পুরস্কার এবং ২০১২ সালে ‘সোনার বুদ্বুদ’ কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত হন। কবির পাঠকপ্রিয়তাও সীমাহীন। ভালবাসায় তিনি যতখানি মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন তার কোনো তুলনাই হয় না। 

তৈমুর খান : কবি, ভারত

আরও পড়ুন