নূর হোসেনের গণতন্ত্র কি মুক্তি পেয়েছে?

এক
চীনের কিংবদন্তী মাও সে–তুং বলেছিলেন, ‘কারও মৃত্যু পাখির পালকের মতো হালকা, কারও মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়ে ভারী।’ আমাদের মনে রাখতে হবে, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নূর হোসেনের মৃত্যু হয়েছিল, তাঁর মৃত্যু ছিল পাহাড়ের চেয়ে ভারী। কেননা তিনি গণতন্ত্রের লড়াইয়ে এক মহান-মূর্ত প্রতীক।
সহজাতভাবেই এ প্রশ্নটি সামনে আসে—শহীদ নূর হোসেনকে কতটুকু মনে রেখেছি আমরা? শামসুর রাহমান যাঁকে বলেছিলেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। তাঁর সেই ছবি কেবলমাত্র বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীজুড়ে পরিচিতি পেয়ে যায়। যে আগুনের স্ফূলিঙ্গ নূর হোসেন এই বাংলাদেশে তুলেছিল—চোখের সামনে ভাসে আলবার্তো কোর্দার তোলা সেই ব্যারেটা পরিহিত বিখ্যাত ছবিটি—যার নাম ‘গেরিলা হিরোয়িকো’। কিন্তু যে সম্মান বিশ্বব্যাপী আর্নেস্ত চে গুয়েভারা পেয়েছেন, মৃত্যুর পরে নূর হোসেন বাংলাদেশে কি তা পেয়েছেন? নাকি কেবল রাজনীতির একটি পোশাক ছিলেন তিনি?

গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক নূর হোসেন। ছবি : পাভেল রহমান
২৪ বছরের তাগড়া যুবক নূর হোসেন উদোম শরীরে রাজপথে রাজপথে নামেন। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সমাবেশে বুকে-পিঠে গণতন্ত্রকামী মানুষের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষায় শুভ্র-সাদা অক্ষরে লেখা সেই অনন্য স্লোগান— ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক’, আর গনতন্ত্র মুক্তি পাক’। সেই রৌদ্র করোটি সকালে সচিবালয়ের পাশে রাস্তায় পুলিশের লক্ষ্যভেদী বুলেট বিদীর্ণ করে নূর হোসেনের শরীর। পুলিশের বন্দুকের সিসা নূর হোসেনের বুকে নয়, বাংলাদেশের হৃদয় যেন ফুটো করে দেয়।
ফরাসি দার্শনিক জাক রাঁচিয়ের বলেছেন, রাজনীতির যেমন একটা নিজস্ব নন্দনতত্ত্ব আছে, নন্দনতত্ত্বেরও আছে অনুরূপ নিজস্ব রাজনীতি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে নূর হোসেনের রাজনৈতিক আদর্শের প্রকাশ কিন্তু শিল্পের ভঙ্গিমায়। দেহকে বানিয়েছেন ক্যানভাস। কাঁচা রং দিয়ে মুদ্রিত করেছেন গণতন্ত্রহীনতার আহাকার। আবার রাজনীতির কাছে তার শৈল্পিক জীবনবোধের সন্ধান তিনি খুঁজেছেন। মুক্তির লক্ষ্যে নূর হোসেনের অভিনব রাজনৈতিক আত্মত্যাগ তাই সমকালীন রাজনৈতিক দর্শনের একটা জ্বলজ্বলে ব্যবহারিক উদাহরণ। প্রশ্ন হলো, কিসের মুক্তি?
শামসুর রাহমান ও মতিউর রহমান রচিত ‘শহীদ নূর হোসেন’ বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। ওই গ্রন্থের ভূমিকায় বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের অগ্রদূত এই শিল্পের যোদ্ধা লেখেন, “বুক ভরে মাটির গন্ধ নেওয়ার জন্য, উদাত্ত কণ্ঠে গান গাওয়ার জন্য, ক্যানভাসে স্বপ্নের ছবি আঁকার জন্য, কবিতায় জীবনের ফুল ফোটানোর জন্য রাজপথে নেমে এসেছিলেন যে তরুণ, বুকের রক্তে লিখে রেখে গেলেন মানবতার শত্রু ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’।”
নূর হোসেনকে বাংলাদেশে ‘গণতন্ত্রের পতাকা হাতে এগিয়ে আসা একজন’ হিসেবে অভিহিত করে কাইয়ুম চৌধুরী আরও লেখেন, “যে দেশে মানবতা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হয় প্রতিনিয়ত, সে দেশে এই আত্মদান আমাকে বিমূঢ় করে, গর্বিত হই অন্তরে, উজ্জীবিত হই প্রাণে।”
দুই
অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘পাগলামি ছাড়া প্রতিভা থাকতে পারে না’। নূর হোসেন আত্মাহুতি দিয়েছেন। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা বেঁচে আছি। তাহলে নূর হোসেনরাই বাংলাদেশে বারবার গুলি খায়, পড়ে যায়, আবার উঠে দাঁড়ায়। বঞ্চিতরা যে লড়াই করতে পারে তার কারণ এই নূর হোসেনরা। নূর হোসেনের রক্তের দামে কেনা জাতীয় সংসদে ধারাবাহিকতায় দেশের বড় দুই দল ক্ষমতায় আসে–যায়, এরা সবাই গণতন্ত্রের জন্য রাজনীতির আসর সরগরম করে। কিন্তু নূর হোসেনের গণতন্ত্র কি মুক্তি পেয়েছে?

এরশাদের পদত্যাগের দাবিতে সেদিন সারাদেশ থেকে ঢাকায় চলে এসেছিল হাজার হাজার মানুষ। ছবি: দীনু আলম
নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের আগে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের জন-আকাঙক্ষাগুলো বুঝতে হবে। স্বাধীনতার পরে সেই জন-আকাঙ্ক্ষা ভূপাতিত হতে শুরু করল। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো এই যে যার বক্তৃতা ও বাগ্মিতা গণমানুষকে এনে দিয়েছিল ঔপনিবেশিকতার দীর্ঘ শোষণ থেকে চিরমুক্তির স্বপ্ন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপনিবেশ-উত্তর স্বাধীন রাষ্ট্রে সেই গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার সমীকরণটি আপ্ত করতে পারলেন না। তারপর রাজনীতির পাশা খেলার মঞ্চে আবিভূর্ত হলো সেনাশাসন। প্রথমে জিয়াউর রহমান, তার হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতায় এলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জনতা বনাম ক্ষমতার বাইনারিতে ক্ষমতা হয়েছে নিরঙ্কুশ। আর জনতা হয়েছে ব্রাত্য! যার ফলাফল ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাফর-জয়নাল-দীপালি-কাঞ্চনের লাশ, ১৯৮৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ফুলবাড়িয়ায় ছাত্রদের মিছিলে পিষে ফেলল সেলিম-দেলোয়ারকে। কিন্তু এরশাদকে থামানো গেল না। আরও জুলুমবাজ হয়ে উঠল তার শাসিত রাষ্ট্রযন্ত্র। কিন্তু পতন ঘটাতে না পারলেও এরশাদের আরশ কাঁপিয়ে দিয়েছিল নূর হোসেনের লাশ। কিন্তু ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবিগুলোর অপূর্ণতা, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের পৌনঃপুনিকতা, লাগামহীন দুর্নীতি-সামাজিক অবিচার আর রাষ্ট্রীয় শোষণ প্রশ্নবিদ্ধ করে গণতন্ত্রের অঙ্গীকার। অন্যদিকে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় পতিত স্বৈরাচার বনে যান গণতন্ত্রের ধারকবাহক। চিন্তার ধারহীন এই মেকি উন্নয়নের তথাকথিত গণতান্ত্রিক অবয়বের তলায় নীরবে সুসংগঠিত হয় অশুভ ধারালো ছায়া। সাম্যের লড়াই ব্যাহত হয় মুক্তচিন্তার অস্তিত্ব রক্ষার আতঙ্কে।
আরেক ফরাসি দার্শনিক এলা বাদিউ বলেছেন, “আমরা যেন বিপ্লবের খোয়াবের এতিম”। মানে রাজনীতি ও আদর্শের এই আকালে শুধু বিপ্লব সশরীরে অনুপস্থিত নয়, বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাও ভুলে গেছে মানুষ। এই বিস্মৃতির বিপরীতে যে কজন তাদের ত্যাগ দিয়ে আমাদের স্মৃতি আর বর্তমানকে নিয়ত উসকানি দিতে থাকেন, নূর হোসেন তাদের একজন। কেননা, তার স্বপ্নের শোষণহীন সমাজ এখনো অধরা। যে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পথ নূর হোসেন খুঁজেছেন, তা নির্মাণের ব্যবস্থা নিয়ত বহাল রেখে, স্বৈরাচারের পতনে কখনো মিলবে না কাঙ্ক্ষিত প্রকৃত গণতন্ত্র। তাহলে মুক্তির পথ কী এবং কোথায়?
তিন
স্বৈরাচার এরশাদের দীর্ঘ প্রায় সাড়ে আট বছরের শাসনের যবনিকাপাত ঘটেছিল এক গণ-আন্দোলনের মুখে, ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। নতুন যে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল, তা রাজনীতিকদের অবিমৃশ্যতায় তাৎপর্যহীন হয়ে গেল। তারই প্রতিফলন দেখা গেল ২০২৪ সালে। নূর হোসেনের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করে বসল তারই দল আওয়ামী লীগ। তিনটি জনবিচ্ছিন্ন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা শেখ হাসিনা জারি রেখেছিলেন, তার চূড়ান্ত মূল্য শুধু তাদেরই দিতে হলো না, দিতে হলো বাংলাদেশকেই। এর কী জবাব তারা নূর হোসেনের কাছে দেবেন?

পত্রিকায় প্রকাশিত ১০ নভেম্বর ১৯৮৭
চার
এ দেশে গণ-আন্দোলনের নায়ক বদলে গেছে। স্বাধীনতার আগে গণ-অভ্যুত্থানের প্রতীক ছিলেন শহীদ আসাদ। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম গণ-আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে ঘটা নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন নূর হোসেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের ইতিহাসেই অভূতপূর্ব শিক্ষার্থী-গণ-অভ্যুত্থান তথা ‘জুলাই জাগরণের’ প্রতীক রংপুরের আবু সাঈদ।
নিঃসন্দেহে, মৃত্যুর আগে নূর হোসেনের লড়াই আর সাঈদের লড়াই এক ছিল না। নূর হোসেনের দাবিটি ছিল স্পষ্ট ও সুদৃঢ়। তিনি জানতেন, তার চাওয়া স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে চকচকা পোশাকের সংযোগ—এ কারণেই তার মৃত্যুর ঘটনা পুরো দেশেই আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। দুই হাত প্রশস্ত করে বুক পেতে ঘাতকের সামনে দাঁড়ানোর সাঈদের দুঃসাহসিক মৃত্যুদৃশ্য লাইভ কিংবা ধারণকৃত ভিডিওর মাধ্যমে দেখা গেছে। ইন্টারনেটের যুগে মুহূর্তেই ছড়িয়ে গেছে এ দৃশ্য দুনিয়াব্যাপী। কিন্তু তখনো সাঈদ বা সাঈদদের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ছিল না। তখনো তা কোটা সংস্কার বা বড়জোর বৈষম্যবিরোধিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অথচ তার মৃত্যুই পুরো আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, আন্দোলনকে করে তুলেছিল আরও জনসম্পৃক্ত। ছাত্রদের আন্দোলন ছিল না, দেশের একটা বৃহৎ অংশ এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। সেখান থেকে মাত্র ২০ দিনের মাথায় আরেকটি স্বৈরতন্ত্রের পতন।

কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে পুলিশের গুলিতে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। ছবি: সংগৃহীত
‘জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি’র যে প্রসঙ্গ স্বাধীন দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় লিপিবদ্ধ হয়েছিল, তা রহিত হয়েছে গত ৫৩ বছরে। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট যে জনজাগরণ, তার প্রতিও সুবিচার হয়নি। উল্টো বারবার রাজপথ রঞ্জিত রক্তের সঙ্গে চরম অবিচার করা হয়েছে। মনে রাখতে হবে, একটা অগণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটানোই যথেষ্ট নয়, নতুন করে যাতে ফ্যাসিজমের উত্থান না হয়, সেই পরিবেশ-পরিস্থিতি দরকার। মানুষকে মন খুলে কথা বলার স্পেস দিতে হবে। আর যদি সে ব্যবস্থা চালু না করা যেতে পারে, তাহলে ফ্যাসিজম আবারও ভিন্ন চরিত্রে, ভিন্ন মেজাজে ফিরে আসবে। তেতো হলেও সত্য, নূর হোসেন জিতে গেলে সাঈদদের মরতে হতো না। আবার এটা ভাবতে হবে, সাঈদের আত্মদান কি হারিয়ে যাবে?
হাবীব ইমন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
