ধীরে বহেন বিভুরঞ্জন

আমরা যারা ঢাকা শহরকে ভালোবেসেছিলাম
তারা বুঝতে চেয়েছি বুড়িগঙ্গাকেও—
কেন ধীরে বহে সে?
কেন জল তার কুচকুচে কালো?
কেন মৎস্য রেখে মানুষের প্রতি দরদ তার ষোলো আনা?
কেন নগরজীবনের অকাতর পঙ্কিলতা গ্রহণে উদারহস্ত সে?
প্রিয় বুড়িগঙ্গা, এসব উত্তর কী তুমি জানিয়ে দিয়েছিলে তাকে?
তুমি কী বুঝলে কার কথা বলছি আমরা?
জ্বী, হ্যাঁ- আমরা তার কথাই বলছি।
যিনি তোমাকেই ভেবে নিয়েছেন শেষ অবলম্বন।
তোমাকেই করে নিয়েছেন আশ্রয়।
পরিণতি জেনেশুনেই নিজেকে ঠেলে দিয়েছেন তোমার গহনে।
শেষ হিসেবটা মেটাতে তোমাতেই ঝাঁপ দিলেন
বুঝে নিতে পৃথিবীর যাবতীয় বকেয়া।
গোটা একটা দেশও কী সাথে ছিল তার?
একটা ব্যর্থ সমাজ? একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র?
সবই কী সাথে নিয়ে চললেন তিনি?
হাসতে হাসতে ভাসতে ভাসতে
তিনি কী তোমার বুক থেকে
বিক্রমপুরের কাছে মেঘনার দিকে চললেন?
পেছনে ফেলে রেখে তোমাকে বুড়িগঙ্গা,
ফেলে রেখে প্রিয় ঢাকা শহর,
ফেলে রেখে কন্যা-পুত্র-স্ত্রীকে।
তার ভেলার মতো ভাসতে থাকা—
সে রাতে পঞ্চমীর চাঁদ তো ছিলই না
শেষরাতে ভরা চাঁদের কতকটা জোছনালোক কী ভেসেছিল—
তার মুখ ও মণ্ডলে?
কিছু মাছ কী তাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল?
কিছু হাঁস কী আঁচ করতে পেরেছিল—
জাতিস্মর হওয়ার যাত্রাপথে কোনো একজন?
হয়তো কিছু কচুরিপানা সঙ্গ দিয়েছিল তাকে
আর বাতাসও নিশ্চয়ই নায়ের বাদামের মতো
অনুকূল করেছিল মহাসিন্ধুসম এই অনন্তলোকের পথ।
রাতের শেষে ভোরও এসেছিল সেদিন
দিনের প্রথম আলো কী ভেবেছিল—
একটা ভাসমান মানুষ দেখে?
যে আর উল্টোস্রোত জানে না,
জানে না প্রতিকূল বৈঠার লড়াই
ভাসতেই আছে ভাসতেই আছে একটা শরীর
জলের সাথে সাথে উজানভাটির ভাগ্যলিপির মতো
গন্তব্য মেনে নিয়ে যে চলন
তার সাথে আর কার দেখা হয়েছিল?
দেড়টা দিন একাই কেটে গেছে?
একা একা ভাসতে ভাসতে ভাবতে ভাবতে
সেই সে স্বদেশ ভূমি:
“রাষ্ট্র—এমন এক রাজনীতি
ভাগ হয়ে যায় আকাশ, নদী আর দ্যাশের বাড়ি।
রাষ্ট্র—তুমি চিনেছ ভিসা, পাসপোর্ট ও পরিচয়পত্র।
মানুষ চিনতে চাওনি কখনো।
রাষ্ট্র—তোমার লাগে পানি-বায়ু-মাটির দখলদারি।
মনের ভেতর যেতে দেখিনি তোমায়।
আত্মার অশ্রু জানো না কিছুই তুমি।”
আচমকা ঢেউয়ের তোড়ে ভাবনাও ভেসে যায়
পাশ কেটে চলে যায়
আকাশে চোখ রেখে সারি ধরে চলা খল্লা মাছের ঝাঁক
সন্ত ভেবে নিয়ে ‘গার্ড অব অনার’ কি দিয়ে গেল তারা?
এসবে অবশ্য কিছুই যায় আসে না তার
আরও আরও উচ্চতার দিকে তিনি
তবু তিনিও কি কিছুটা ক্ষণ আকাশের দিকে চোখ রেখে
ওদের একজন হয়ে পড়েছিলেন?
উত্তর জানার আর থাকেনি উপায়।
প্রশ্ন তো আজও সহজ—তবু করবে না কেউ।
প্রিয় সত্য কেবল ঢেকে রাখারাখি আপোষে-পাপোষে।
যেমন, এখানেও বলতেই হবে—
মিলে গেলে তা কেবল কাকতাল,
কিছুই ঘটেনি আদতে
সব চরিত্রই ছিলো কাল্পনিক
কবি ও বিজ্ঞানীর তফাৎ সেই তো মূর্তে ও বিমূর্তে।
তাই তিনি দিনপঞ্জি মেনে বেরুবেন রোজ সকালে
যথারীতি ফিরবেন সন্ধ্যের পাখিরা যেমন
চায়ের কাপে পত্রিকা হাতে আবার ভোরের দেখা।
এর ব্যত্যয় এনে দিতে পারে কিছু অন্ধকার সময়।
সাদা পাথরে শোনা যেতে পারে কালোথাবার অশনি সংকেত।
তাই এমন কথাই বাস্তব হোক:
তার ভেসে থাকা কাল্পনিক
আমাদের বুড়িগঙ্গা কাল্পনিক
কাল্পনিক মেঘনার কাছে বিক্রমপুর
জল ও জোছনা, চাঁদ ও কচুরিপানা কাল্পনিক
আকাশ তো সেই প্রাচীন কুহক, বরং চোখ আর খল্লাও কাল্পনিক হোক।
এত যে বয়ান ভরা মবে পোড়া দেশ—
সে-ও কাল্পনিক।
যেভাবে কাল্পনিক উত্তরবঙ্গের কিশোর ছেলে জয় আর স্কুলে যায় না।
নিহত বাবা রুপলালের ব্রাশ হাতে অন্যের জুতো পালিশ করতে হয় তাকে।
অথচ মবের যত জনক, তারা ঠিকই সুর-সুর করে চা পান করেন
নতুন কোনো পিটুনি দিন আনতে।
তাদের পুত্র-কন্যারা ঠিকই যায় স্কুলে-মাদ্রাসায়।
তারও দিনকতক পরে নুরাল পাগলার মরদেহও সইবে না তারা
কবর খুঁড়ে এনে আগুনে ঝলসে দিয়ে করতে হবে দ্বিতীয় হত্যা।
এভাবে এখানে এখন আমি-তুমি-সে বলে কিছু নেই:
তাই হতে পারে তৃতীয় হত্যাও।
আমি যে সত্য, সে সত্যই সব—
আমার সত্যই আমার আপন ভাই, বাকিরা নাকি সৎ ভাই,
বাকি সব সত্যি নাকি মিথ্যে—
তুমি ও তার সত্যকে তাই হনন করতে হবে খঞ্জরে খঞ্জরে।
এসব বাস্তবতা থেকে আপনি লিখলেন:
“সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়।”
তারপর হয়তো আপনি ভাবলেন,
এভাবে আর কত তারিখ ইব্রাহিম হয়ে থাকা?
এর চেয়ে উত্তম নদীপথ, ভাসতে থাকাও ভালো।
আর ভালো থাকতে বায়বীয় পত্রালাপ
হতে পারে আকাশের ঠিকানায়,
কুশলাদির পর কিছু বিশদ কথা:
যদিও জেনেছি আমরা- ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা।
আর হাল খবর হলো এই: ধীরে বহেন বিভুরঞ্জন।
কত দূরে বিক্রমপুর? এখনো ধীরে বহে মেঘনা?
সেখানে কী নেমে আসে আকাশ, তোমার দিগন্তরেখা?
ভেসে ভেসে মেলে কী, তোমার ওপারে আরেক আকাশ?
তায়েব মিল্লাত হোসেন কবি ও সাংবাদিক
আমাদের কাছে লিখুন
বইয়ের আলোচনা, কবিতা, গল্প, ফিচার, লাইব্রেরি, প্রিয় গ্রাম, সাহিত্য সমালোচনাসহ নানা বিষয়ক। লেখা পাঠাবেন: boicharita@gmail.com