তুমিও আমার মতো হয়ে গ্যা্লে!

১৯৬৯ সাল। গণ-অভ্যুত্থান চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র হেলাল হাফিজ। একদিন রিকশায় যাচ্ছেন। হঠাৎ সামনে মিছিল চলে আসায় রিকশাচালক ব্রেক কষে থামলেন। মিছিলকারীদের থামাতে পুলিশ ধাওয়া দিতে শুরু করলে উল্টো দিক থেকে মিছিলকারীরাও ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করলেন। পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রিকশাচালক বললেন, ‘মার, মার শালাদের। প্রেমের জন্য কোনো কোনো সময় মার্ডারও করা যায়।’ কথাটা কানে পৌঁছাতে হেলাল হাফিজের মনে হলো—‘আসলেই তো তা–ই! দেশপ্রেমের জন্যও তো মার্ডার করা যেতে পারে।’ পরবর্তী সময়ে এ ঘটনার সূত্রেই তিনি রচনা করেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’।
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
মিছিলের সব হাত
কণ্ঠ
পা এক নয়’
সংগ্রামে, দ্রোহে, প্রতিবাদে তার এই উচ্চারণ আপামর হয়ে ওঠে। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত হয় হেলাল হাফিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। তেত্রিশ বছর আর কিছু লিখলেন না। ওই একটা কাব্যগ্রন্থই হেলাল হাফিজকে দিয়েছে অসামান্য খ্যাতি। সবগুলো কবিতা মানুষের মুখে মুখে। যারা প্রেম করেছে, যারা বিরহে ছিল, নিঃসঙ্গ ছিল, কষ্টে ছিল—তারা কখনো না কখনো হেলাল হাফিজের কবিতা তাদের প্রিয় মানুষকে পাঠিয়েছে, দেয়ালে লিখেছে, খাতায় তুলেছে।
এরপর দীর্ঘদিন ২০১২ সালে ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতার সঙ্গে কিছু কবিতা যুক্ত করে প্রকাশ করা হয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘কবিতা একাত্তর’। সবশেষ ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয় তৃতীয় কবিতার বই ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’।
দুই।
শৈশবে মাকে হারান হেলাল হাফিজ। আপন মানুষ বলতে ছিলেন কেবল বাবা। তিনিও ১৯৭৩ সালের ১৯ জুন না–ফেরার দেশে চলে যান। কবি পুরোপুরি একা হয়ে যান। বাবার মৃত্যু তাকে প্রবলভাবে ধাক্কা দিল। তার কাছে মনে হলো, জগৎসংসার তুচ্ছ। সব অর্থহীন। তার বৈরাগ্য আরও প্রগাঢ় হলো।
বাবার মৃত্যুর মাসখানেক পর তার যে প্রেমিকা হেলেন, তিনিও কবির সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটান। তাকে ডেকে বলেন, ‘কবি, তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।’ তারা গিয়ে বসলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে। হেলেন বললেন, ‘আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’
জবাবে কবি কি বলেছিলেন হেলেনকে? না, তেমন কিছু বলেননি। অনুরোধও করেননি, আঁকড়ে ধরেও রাখেননি। কীভাবে সামলেছিলেন পরিস্থিতি। জানতে চাইলে হেলাল হাফিজ বলেন ‘ছোটবেলা থেকে আমি খুব সহনশীল ছিলাম। প্রচণ্ড সহ্যশক্তি আমার। কথাটা শুনে ভেতরের ঝড় বুঝতে দিলাম না হেলেনকে। ওখান থেকে উঠে রিকশা নিয়ে…চলে এলাম।’
জীবনে পরপর ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা কবি কাউকে বুঝতে না দিলেও ঘটনাদ্বয় ভেতরে-ভেতরে তাকে এলোমেলো করে দেয়। বাবার চলে যাওয়ায় কিছুই করার ছিল না তার। কিন্তু হেলেন? যাকে ভালোবেসে সম্রাজ্ঞি বানিয়েছিলেন তার প্রেমসাম্রাজ্যে, তাকে কেন যেতে দিলেন, আটকাতে কি পারতেন না? হয়তো পারতেন অথবা পারতেন না। কবিতার বিশালতার মতো বিশাল হৃদয় দিয়ে তুমুলভাবে ভালোবেসেও জোর করে থেকে যাওয়ার দাবিটা শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারেন না। সে কারণেই হয়তো ‘প্রতিমা’ শিরোনামের কবিতায় কবি বলেছেন,‘অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে/মূলতই ভালোবাসা মিলনে মলিন হয়, বিরহে উজ্জ্বল’।
আবার ‘পৃথক পাহাড়’ শিরোনামের কবিতায় দ্বিধাহীন কণ্ঠে হেলাল হাফিজ যখন বলেন, ‘আমি আর কতটুকু পারি?/এর বেশি পারেনি মানুষ।’ এ কথা কি কেবল কবির একার নাকি আমরা যারা কবির মতো করে বলতে পারি না, তাদেরও?
লোকটা হেলেন নামের একজনকে ভালোবেসেছিলেন। হেলেনের বিয়ে হয়ে যায় আরেকজনের সঙ্গে। তারপর পরিবারের অনেক জোড়াজুড়ি সত্ত্বেও তিনি বিয়ে করেন নি। গোটা জীবন পার করেছেন নিঃসঙ্গ অবস্থায়। একা।
বাংলা ভাষায় বিরহ এবং একাকীত্ব খুবই কমন দুটো জনরা। এ জনরায় অনেকে লিখেছেন, অনেকে লিখবেন। কিন্তু এ জনরার ওপর অধিকার দাবি করা—কেবল হেলাল হাফিজকেই এটা মানায়।
তিন।
বহুবছর দৃশ্যের আড়ালে ছিলেন—কবি খুব রাগী—এমনটাই শুনেছি। বইমেলায় দেখি, কথা বলি না। দ্বিধায় বলি না। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কিনেছি। অটোগ্রাফ নেইনি। তখন তাকে ডরাইতাম। একদিন দ্বিধা ছেড়ে তার সঙ্গে দেখা করি। কথা হয়। আলাপ হয়। সব দ্বিধা-ডরভয় উড়ে গেল। খুব কাছের মানুষ হয়ে গেলেন তিনি। আমার আব্বু যেদিন মারা যান, সেদিন শোক জানিয়ে মেসেজ দিলেন। আমি ফোন দিলাম। একটা কথা বললেন শুধু—‘তুমিও আমার মতো হয়ে গ্যা্লে!’ আমার যে বড়ো কষ্ট হচ্ছে।
পরিণত বয়সে হেলাল হাফিজ চলে গেলেন। কিন্তু তার প্রয়াণে যে ঘটনা, মর্মান্তিক এ ঘটনা আমাকে বিমূঢ় করেছে, আমাকে শঙ্কিত করছে, প্রবলভাবে ধাক্কা দিয়েছে। তার মেসেজগুলো পড়ছি, মন আরও বিষণ্ন হয়ে যাচ্ছে। মানুষ মূলত একা। তবে কেউ হয়তো ইচ্ছে করে একা থাকতে চায় না। প্রতিটা মানুষই মনে মনে সঙ্গ খোঁজে। শেষ জন্মদিনে একটি সাক্ষাৎকারে হেলাল হাফিজ বলেছিলেন, একা থাকা তার ভুল হয়েছে।
নিঃসঙ্গতায় আমাদের আর দেখা হবে না, হয়তো দেখা হবে যেখানে, সেখানে আমার যাওয়া এখন বাকি কেবল৷ আপনার-আমার ওপারের জীবন যেন নিঃসঙ্গ না হয়।
‘আমি না হয় ভালোবেসেই ভুল করেছি ভুল করেছি,
নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে
পাঁচ দুপুরের নির্জনতা খুন করেছি, কী আসে যায়?’
