মহিউদ্দিন আহমেদ : শুধু ব্যক্তি নন, একটি প্রতিষ্ঠান

আমরা সাধারণ মানুষেরা ব্যক্তিই থেকে যাই, ‘প্রতিষ্ঠান’ হয়ে উঠতে পারি না। কিন্তু কোনো কোনো বিশেষ মানুষ তাঁদের অনন্যসাধারণ কর্মযজ্ঞের দ্বারা একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হন। তাঁদের প্রত্যেকেই হয়ে ওঠেন এক একটি বাতিঘর, যাঁরা আমাদের পথনির্দেশ দেন। এই কথাগুলো বিশেষ করে মনে হল আজ মহিউদ্দিন ভাইয়ের চতুর্থ প্রয়াণ দিবসে। ২০২১ সালের ২২ জুন বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের বিরাট এক মহীরুহ জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ লোকান্তরিত হন।

মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় সত্তুরের দশকের প্রথম দিকে। আমার শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক মুশাররফ হোসেনের ফুলার রোডের সেই বিখ্যাত প্যাগোডা বাড়ির দোতলার খোলা বারান্দায়। আমাদের স্নাতক পরীক্ষার ফল তখন সবে বেরিয়েছে। কেন জানি, ভালো ফলাফলের ছাত্রদের মহিউদ্দিন ভাই এক বিশেষ স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে দেখতেন। হয়তো তাঁর বিদ্যানুরাগের পেছনে কাজ করেছে। সেই প্রথম দেখাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে আমাদের আগের পাঁচ বছরের স্নাতকে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্ত সব ক’জনার নাম বলে তিনি আমাকে তাক্ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আমি নিশ্চিত যে, ইংরেজি কিংবা ইতিহাস বিভাগের ক্ষেত্রেও এ কাজটি তিনি অনায়াসে করতে পারতেন। পরবর্তী জীবনে বহু পরেও বহুবার তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার ফলাফল এক গর্বিত মমতার সঙ্গে উল্লেখ করতেন।

আমার ব্যাপারে মহিউদ্দিন ভাইয়ের আরেক বলার বিষয় ছিল আমার বিতর্ক করা। তিনি ইংরেজি বিতর্ক যুগের মানুষ, কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিতর্ক প্রচলন ও তার জননন্দিতকরণের ক্ষেত্রে আমাদের ক’জনার ভূমিকার কথায় উচ্চকিত ছিলেন। মনে আছে ১৯৭৪ সালে আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিয়োগিতায় আমার বিতর্ক শুনতে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে দর্শকদের প্রথম সারিতে তিনি বসেছিলেন। বড় ভালো লেগেছিল।

আশির দশকের প্রথম দিকে উচ্চশিক্ষা শেষে বিদেশ থেকে ফিরে এলে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আবার নতুন করে যোগসূত্র স্থাপিত হয়। মনে আছে, বাংলাদেশ অবজার্ভারে সম্পাদকীয় খণ্ডকালীন লেখক হিসেবে কাজ করার সময়ে মাঝেমধ্যেই সেখানে কাজ-আড্ডা শেষে বেতার অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনার জন্যে চলে যেতাম কৌশিকের (বাংলাদেশ বেতারের স্বর্ণকণ্ঠ বালক কৌশিক আহমেদের কাছে)। কৌশিক তখন কাজ করতো পদ্মা প্রিন্টার্সে। মতিঝলে কৌশিকের দপ্তরের কৌণিক অবস্থানে ছিল মহিউদ্দিন ভাইয়ের ইউপিএল (University Press Limited). কৌশিকের ওখান থেকে রাস্তা পেরিয়ে চলে যেতাম ইউপিএল-এ।

দু’টো জিনিস সেখানে অবধারিতভাবেই হত। এক, মধ্যাহ্ন ভোজের সময়ে ওখানে গেলে কখনো না খেয়ে আসতে পারিনি এবং মহিউদ্দিন ভাই তাঁর জন্যে আনীত খাবার ভাগ করে দিতেন। এমন করে আর কাউকে আমি খাবার ভাগ করে দিতে দেখিনি। দুই, ইউপিএল প্রকাশিত নানা বই তিনি আমার সামনে মেলে ধরতেন। ছাপায়, বাঁধাইয়ে সেগুলো ছিল দৃষ্টিনন্দিত। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা ছিল, বিষয়ের গভীরতায় আর বৈচিত্র্যে প্রতিটি বই-ই ছিল অনন্য।

বিভিন্ন বিচিত্র বিষয নিয়ে বই প্রকাশ করতে ভালেবাসতেন তিনি। গভীর গবেষণামূলক যেকোনো কাজের প্রতি তাঁর বড় রকমের আগ্রহ ছিল। কোনো এক নতুন বিষয়ের ওপরে কেউ একজন লিখছেন, কিংবা কোনো একটি গবেষণা কাজের পাণ্ডুলিপি তৈরি হয়েছে জানলে তিনি তা প্রকাশের জন্যে বিবেচ্য কিনা দেখতে চাইতেন। বাংলাদেশের ওপরে যেকোনো কাজের প্রতি তাঁর মমতা আর আগ্রহের সীমা ছিল না। মনে আছে ১৯৯১ সালের দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহানের উদ্যোগ ও নেতৃত্বে যখন বিভিন্ন অর্থনীতিবিদ সমন্বয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতির নানা দিকের এক বিশ্লেষণধর্মী সমীক্ষা বেরুল, মহিউদ্দিন ভাই সাগ্রহে চার খণ্ডে তা প্রকাশ করলেন। ভাষা আন্দোলনের ওপরে গবেষণাও তিনি প্রকাশ করেছিলেন কয়েক খণ্ডে। প্রতিটি পাণ্ডুলিপি তিনি নিজে পড়তেন এবং ইউপিএল থেকে প্রকাশিতব্য প্রতিটি গ্রন্থের প্রকাশনা তিনি তদারকী করতেন।

বাবা মহিউদ্দিনের সঙ্গে কন্যা মাহরুখ মহিউদ্দিন। ছবি: সংগৃহীত

১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যোগদানের পরে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ কমে এল। বৈশ্বিক ‘মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের’ প্রকাশক ছিল Oxford University Press (OUP). এটা তাঁকে প্রীত করত, কারণ OUP তাঁর পুরোনো কাজের জায়গা। মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আবার নতুন করে যোগাযোগ স্থাপিত হল ২০১৫ সাল নাগাদ যখন তাঁর সুযোগ্য কন্যা মাহরুখ মহিউদ্দীন আমার একটি গ্রন্থ প্রকাশে আগ্রহী হলো। মাহরুখ আমার কন্যা-জামাতারও বন্ধু এবং একত্রে ওরা অনেক সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত ছিল।

সেই গ্রন্থের কাজ উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ইউপিএল এর কার্যালয়ে গেলে বহুদিন বাদে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে বহুদিন পরে দেখা হলো। ততদিনে তিনি দীর্ঘ অসুস্থতার শিকার, কিন্তু মন ও মননের দিক থেকে সেই আগের মতোই দৃঢ়চেতা। তখন তাঁর বিশেষ খাবার বাড়ি থেকে আসে এবং সম্ভবত: ভাবি (আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালীন সহকর্মী অধ্যাপক মেহতাব খানম) সেটা তৈরি করেন। স্বভাবসুলভ: ভাবে সেদিনও মহিউদ্দিন ভাই আমার সঙ্গে খাবার ভাগ করে খেয়েছিলেন।

সেদিন নানা কথার মধ্যে প্রকাশক হিসেবে তাঁর রীতি-নীতি ও মূলবোধ এবং আমাদের প্রকাশনা শিল্পের দায়িত্বে সততা সম্পর্কে তাঁর চিন্তা-চেতনার কথা বলেছিলেন মহিউদ্দিন ভাই। মাহরুখ ও আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল তাঁর অনেক কথায় সেদিন মাহরুখের জন্যে পথ-নির্দেশ ছিল। ইউপিএলের ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধ রক্ষার ব্যাপারে তিনি খুব জোর দিয়েছিলেন। পুরোটা সময় ধরে আমার মনে হয়েছিল, আমি একজন ব্যক্তির কথা শুনছি না, আমি একটি প্রতিষ্ঠানের বাণী শুনছি।

শেষ দেখা হয়েছিল বছর কয়েক আগে আমি যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন উপস্থাপনার জন্যে। তিনি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন, প্রতিবেদনটির প্রশংসা করেছিলেন এবং বিশেষভাবে বলেছিলেন কোনো কাগজ ব্যতীত আমার এক ঘণ্টার ইংরেজি বক্তব্যের, যাতে প্রচুর সংখ্যা উপাত্ত ছিল। আমি আপ্লুত হয়েছিলাম। মানুষের প্রশংসায় তিনি ছিলেন উদার-তাঁর হৃদয়ের মতোই।

মহীউদ্দীন ভাইয়ের চলে যাওয়ার পরে আমার সব সময়ে মনে হয়েছে যে, একটি প্রতিষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটল, একটি মহীরুহ চলে গেলেন, যার স্নেহচ্ছায়ায় আমরা আর আশ্রয় পাব না প্রয়োজনে, না সঙ্কটে। অমন বাতিঘরের আমাদের এখন যে বড় প্রয়োজন।

সেলিম জাহান : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ. শিক্ষক ও লেখক

আরও পড়ুন