কবি নজরুলের প্রিয়পুত্র বুলবুলের জন্মশতবর্ষে নিবেদিত গান-কবিতা ও বইপ্রকাশ

১২ অক্টোবর মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় পুত্র অরিন্দম খালেদ বুলবুলের জন্মশতবর্ষে, বুলবুলের জন্মস্থান কৃষ্ণনগরের গ্রেস কটেজে ছায়ানট (কলকাতা) এবং কথাশিল্প আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র যৌথভাবে তিন ঘণ্টা ব্যাপী ‘নজরুলের প্রাণপ্রিয় বুলবুল’ শীর্ষক একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। অনুষ্ঠান শুরু হয় দুপুর ৩টায়। বিশেষ সহযোগিতায় আল-আমীন মিশন এবং হারমোনিয়াম পার্টনার পাকড়াশী হারমোনিয়াম।
উক্ত অনুষ্ঠানে সোমঋতা মল্লিকের সম্পাদনায় রিসার্চ পাবলিকেশন থেকে ‘বুলবুল: বিদ্রোহীর বুকে বিষাদের সুর‘ বইটি প্রকাশিত হয়। বুলবুলকে নিয়ে প্রবন্ধ, কবিতা লিখেছেন দুই বাংলার বিশিষ্ট কবি ও নজরুল গবেষকরা। এছাড়াও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলেন কলকাতা সহ নদীয়ার শিল্পীবৃন্দ। বুলবুলকে নিবেদিত গান ও কবিতায় মুখরিত হয়ে উঠেছিল গ্রেস কটেজ। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন, কলকাতা – এর প্রথম সচিব (প্রেস) তারিক চয়ন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নজরুল গবেষক ও শিক্ষারত্ন প্রাপক ড. আবুল হোসেন বিশ্বাস, বুলবুল পত্রিকার সম্পাদক এস.এম.সিরাজুল ইসলাম এবং সুজন বাসর সংগঠনের সম্পাদক ইনাস উদ্দীন।

স্বল্প আয়ু নিয়ে নজরুল-পুত্র বুলবুল পৃথিবীতে এসেছিল ঠিকই, কিন্তু নজরুল ও তাঁর পরিবারের সকল সদস্যর মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল এই ছোট্ট শিশুটি। প্রায় চার বছর বয়সি ছেলে অরিন্দম খালেদ বুলবুল এতোটাই মেধাবী ছিল যে, নজরুল যখন উস্তাদ জমীরুদ্দীন খানের সঙ্গে সঙ্গীত-চর্চা করতেন, তখন শুনে শুনে বুলবুল সবকিছু আয়ত্ত ক’রে ফেলত। বুলবুলের জন্মশতবর্ষে তাই আরও একবার তার স্মৃতিকে খুঁজে ফেরা। নজরুল সুহৃদ মুজফ্ফর আহ্মদ তাঁর ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’ গ্রন্থে বুলবুলকে ‘ক্ষুদে জাদুকর’ বলে উল্লেখ করেছেন – “নজরুলের ছেলে বুলবুল ১৯২৬ সালের ৯ই অক্টোবর তারিখে কৃঞ্চনগরে ‘গ্রেস কটেজে’ জন্মেছিল। ‘গ্রেস কটেজ’ ছিল খ্রীস্টান মহিলার বাড়িটির নাম, যে – বাড়িতে নজরুল থাকত। নজরুল ছেলের নাম রেখেছিল অরিন্দম খালিদ। বুলবুল তার ডাক নাম। এই নামেই শিশুটি শুধু যে নজরুলের বন্ধুদের নিকটে পরিচিত হয়েছিল তা নয়, সে তাঁদের ওপরে তার অপরিসীম প্রভাবও বিস্তার করেছিল। একটি ক্ষুদে জাদুকর ছিল সে। নজরুলের বন্ধুদের সঙ্গে সে চলে যেত এবং তাঁদের বাড়িতে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে আবার নিজেদের বাড়িতে সে ফিরে আসত।…এই বুলবুল, মা ও দিদিমার চোখের মণি ছিল,- চোখের মণি ছিল সে নজরুলের তামাম বন্ধুদের, যাঁরা তার বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন। কিন্তু কেউ জানত না কত গভীর ছিল নজরুলের স্নেহ তার প্রতি।”

নজরুল সান্নিধ্য-ধন্যা গোফুরুন্নেসার দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় – “বুলবুল বড় হতে লাগল। এই বুলবুলের মুখেভাত অনুষ্ঠানও হয়েছিল গ্রেস কটেজে সাতমাস পর মার্চ মাসের প্রথম দিকের এক রবিবার সম্ভবত ১৩ মার্চ ১৯২৭ তারিখে। সে কি হৈ হুল্লোড় – আনন্দ আর ফূর্তির উৎসব। কলকাতা থেকে কাজীদার বন্ধুরা দলবেঁধে নিমন্ত্রণ খেতে এসেছিলেন। আমরাও সারাদিন সেখানেই ছিলাম আর মুখেভাতের ভোজ খেয়েছিলাম। কাজীদা নিজে ভোজের তদারকি করেছিলেন। রাতে গানবাজনার আসরও বসেছিল। সেদিন কাজীদার যে আনন্দময় মূর্তি দেখেছিলাম, সেই স্মৃতি আজও আমার মনে পড়ে – ভোলা যায় না সেদিনের স্মৃতি।”
শিশু পুত্র বুলবুলের মৃত্যু কবিকে মানসিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত করে দেয়। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যেও পরিবর্তন এসেছিল। ‘বিদ্রোহী’ নজরুল হলেন ধীর,স্থির। মাহবুবুল হকের লেখা ‘নজরুল তারিখ অভিধান’ থেকে জানা যায় – “৫০/২ এ, মসজিদ বাড়ি স্ট্রিটের বাসায় ২৪ বৈশাখ, ১৩৩৭ বসন্ত রোগে অসহনীয় কষ্ট পেয়ে নজরুলের দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের (অরিন্দম খালেদ) মৃত্যু হয়। এই শিশুর রোগশয্যার পাশে বসে নজরুল মূল ফারসি থেকে রুবাইয়াৎ-ই- হাফিজ অনুবাদ করেন। বুলবুলের প্রাণরক্ষায় যত্ন, সেবা ও চিকিৎসার ত্রুটি ছিলনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচানো যায় নি। বুলবুলের মৃত্যুতে পরিবারে গভীর শোক নেমে আসে। নজরুল, প্রমীলা ও গিরিবালাদেবী এ মৃত্যুতে মর্মান্তিক আঘাত পান। বুলবুলকে হারানোর গভীর শোকের অভিঘাত থেকেই নজরুল এ কাব্য বুলবুলের নামে উৎসর্গ করেন। পুত্রের শোক এত প্রবল হয়েছিল যে নজরুল পরে গভীরভাবে আধ্যাত্ম সাধনার দিকে ঝোঁকেন এবং লালগোলা স্কুলের হেড মাস্টার যোগসাধক বরদাচরণ মজুমদারের কাছে যোগ-সাধনায় দীক্ষা নেন। এই সময়ে লেখা সাধন সংগীতগুলোতে নজরুলের আধ্যাত্ম-সাধনার প্রভাব প্রবল।”

বর্তমান সময়ে নজরুলপ্রেমীরা কীভাবে মনে রেখেছেন নজরুলের প্রাণপাখি বুলবুলকে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন ছায়ানটের সভাপতি সোমঋতা মল্লিক। তাঁর গবেষণায় উঠে আসে বেশ কিছু তথ্য। দীর্ঘ ৫৮ বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে কলকাতায় ‘বুলবুল’ মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। পত্রিকার নামকরণের মাধ্যমে নজরুলের প্রাণপ্রিয় দ্বিতীয় পুত্র বুলবুল – এর স্মৃতিকে এভাবেই দীর্ঘ সময় মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন এস.এম.সিরাজুল ইসলাম। ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঈদ-উল-আযহা উপলক্ষে সিরাজুল ইসলামের একক সম্পাদনায় মাসিক পত্রিকা হিসেবে ‘বুলবুল’ প্রথম প্রকাশিত হয়। পত্রিকার পাশাপাশি, ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বুলবুল’ প্রকাশনী। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতাসহ প্রায় ৫০০টি বই এই প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম মহিলাদের অবদান’ শীর্ষক বইয়ের জন্য ১৯৭৩ সালের ২৫ নভেম্বর কাটোয়ায় রবীন্দ্র পরিষদ হলে ‘বুলবুল’ পত্রিকার পক্ষ থেকে এম. আব্দুর রহমান – কে ‘বুলবুল পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। এভাবেই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই নজরুল পুত্র বুলবুল – এর নাম নজরুলপ্রেমীদের অন্তরে চিরস্থায়ী করেছেন এস.এম.সিরাজুল ইসলাম। উক্ত অনুষ্ঠানে বুলবুলের জন্মশতবর্ষে নজরুল-অনুরাগীদের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি বিশেষ সম্মান জ্ঞাপন করা হয়।

বুলবুলের স্মরণে সোমঋতা পরিবেশন করেন ২টি নজরুল – সঙ্গীত – শূন্য এ বুকে পাখি মোর, ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি।
বুলবুলকে নিবেদিত স্মৃতিচারণামূলক লেখা ও কবিতা পাঠে অংশগ্রহণ করেন – ছায়ানটের পক্ষ থেকে এককভাবে দেবযানী বিশ্বাস, ডা. বৈশাখী দাস, অনিন্দিতা ঘোষ, স্নেহাঙ্গনা ভট্টাচার্য্য ও স্বাতী ভট্টাচার্য্য। নজরুল-সঙ্গীত পরিবেশন করেন রীতা দে রায় এবং তাপস রায়। দলীয়ভাবে নজরুল-সঙ্গীত পরিবেশন করেন – ছায়ানট (কলকাতা), সপ্তসুর, গীতাঞ্জলি – এর শিল্পীবৃন্দ।

কবিতা আবৃত্তি করেন কথাশিল্প, সালৌনি পারফর্মিং আর্টস (শান্তিপুর), আমরা অ আ ক খ – এর শিল্পীবৃন্দ। কথাশিল্প আবৃত্তি চর্চাকেন্দ্র বুলবুলকে নিয়েই দুটি কবিতা কোলাজ পরিবেশন করে। শ্যামাপ্রসাদ ঘোষের লেখা ‘বুলবুল কথা’ শোনায় অদ্রিকা মৌলিক, তনভী বিশ্বাস ও রাজলক্ষ্মী মোদক। দ্বিতীয় কোলাজটির শিরোনাম ‘প্রাণপাখি বুলবুল’। কাজী নজরুল ইসলাম, আশীষকুমার মুখোপাধ্যায়, তন্ময় মণ্ডল এবং সুজল দত্ত-এর কবিতা দিয়ে সাজানো এই অনুষ্ঠান। অংশগ্রহণে ঐশানী ভট্টাচার্য, মেঘনা দাস, রিন্তা ঘোষ, অনুমেঘা সোনার। সমগ্র অনুষ্ঠানটি নজরুলপ্রেমীদের মনের মণিকোঠায় বহুদিন থেকে যাবে – এই বিশ্বাস আয়োজকদের।
অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সোমঋতা মল্লিক এবং পীতম ভট্টাচার্য।
