হেমন্তবাহী

সারা শহর জুড়ে হেমন্তের হাতছানি। প্রতি বছরের মতো এ বছরও সে এসেছে ঝটিকা সফরে। এই সময়টায় আমরা, যারা মফস্বলে বেড়ে ওঠেছি, তারা যখন প্রাণের টানে ছুটে যাই আমাদের এক চিলতে ছোট্ট শহরটায়, তখনো দেখতে পাই পাশের বাড়ির ছাদে সযত্নে রোদ পোহাচ্ছে আদরের লেপ-কাঁথারা। আর তাদেরকে সমানে সঙ্গ দিয়ে চলেছে নানা মাপের বেশ কয়েকটা আচারের বয়াম এবং কিছু গয়না বড়ি।
সেদিন যখন প্রিয় মানুষটার হাত ধরে কলকাতার শহরের ব্যস্ত রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছি , হঠাৎ খুব চেনা একটা মিষ্টি গন্ধ পেলাম। ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখি মস্ত বড় ছাতিম গাছ, তাতে থোকায় থোকায় ফুল ফুটেছে। সকালের মিঠে রোদ গায়ে মেখে বিস্বাদ গ্রিন টি খেতেও মন্দ লাগে না আজকাল। খালি পায়ে শিশির ভেজা ঘাসের ওপর শেষ কবে হেঁটেছি, তা আর মনে পড়ে না। কিংবা সোনালী ধানে গোলা ভরে ওঠার সেই বিশেষ মুহূর্তগুলো, ছেলেবেলায় বাবার গ্রামে ফেলে এসেছি। এমনই এক হেমন্তের বিকেলে যে মানুষটির অকস্মাৎ মৃত্যু সংবাদে থমকে গিয়েছিলাম বেশ কিছুক্ষণ, বিদায় জানাতে গিয়ে দেখি তাঁর সযত্নে লাগানো অতি আদরের বারান্দার গাছগুলোতেও হেমন্ত লেগে আছে। এমন ভাবেই স্মৃতির পাতাগুলো ভরে উঠছে একটু একটু করে।
হেমন্তকাল যেন সেই মানুষগুলোর মতো, যারা মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে স্মিত হাসিমুখে সবটুকু সামলে নেন নিপুণ হাতে। অনুষ্ঠান শেষে সব কলাকুশলীরা যখন হাসিমুখে ঝকঝকে আলোয় দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে , তখন সে ভিড়ে আর তাদের দেখা মেলেনা। ততক্ষণে তারা পাড়ি দিয়েছে বাড়ি ফেরার পথে। ঠিক আমার প্রিয় ঋতু হেমন্তের মতো, শীতের পরশ সে সঙ্গে করে আনে, আনে কিছু সাময়িক রোগব্যাধিও। আসন্ন শীতের দিনগুলিতে যে পিঠেপুলির সম্ভারে বাঙালির হেঁশেল সেজে ওঠে, সেই কাঁচামালের যোগান দিতেও এই ঋতুর জুড়ি মেলা ভার।
এই ভীষণ রকম যান্ত্রিক জীবনে হেমন্ত কতখানি চোখে পড়ে জানি না। জানি না, এই হেমন্তের মতো মানুষগুলোর কথা আদৌ কেউ মনে রাখে কিনা। তবে সময়ের সাথে বেশ বুঝতে পারি, হেমন্তের মতো মানুষগুলোই আসলে আলো জ্বালিয়ে ফেরে, চারিদিক আলো করে রাখাই যে এদের জীবনের মূল মন্ত্র। আচ্ছা, আমাদের জীবনেও এমন কোনো মানুষ থাকলে তাকে আঁকড়ে ধরা যায় না কি? শুধু আলো নেওয়ার তাগিদে নয়, কিছু আলো ফিরিয়ে দিতে।
