ধূসর শরৎ

সৌম্য আকাশ, অথচ নীল নয়—ধূসর। বাতাসে শরতের নরম স্পর্শ, হালকা রোদে গাছের ছায়া দীর্ঘ হয়ে গেছে। চারদিকে একরকম স্নিগ্ধ নিঃসঙ্গতা—যেন প্রকৃতি নিজেই ধীরে ধীরে কথা বলা শিখছে। এই ঋতুতে সবকিছু একটু থেমে যায়; পাখিরা উড়ে না, সময়ও যেন হাঁটে এক ধীর, পরিমিত ছন্দে।

আজকের দিনটি অচেনা নয়, তবু তার পরিচয় স্পষ্ট নয়। এই মেঘলা শরতের আকাশে আমি নিজেকে মিশে যেতে দেখি—আলো আর ছায়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক ক্লান্ত মানুষ। প্রকৃতি অনন্ত, আমি ক্ষণস্থায়ী; তবু দু’য়ের মাঝে কোথাও এক অদ্ভুত যোগাযোগ রয়ে গেছে।

জীবনের গতি এখন আমার কাছে আর সরলরেখা নয়, বরং এক বৃত্ত—যার ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে আমি দেখি নিজের প্রতিচ্ছবি, প্রতিদিন একটু একটু করে মলিন হয়ে যাচ্ছে। সময়ের বিজ্ঞাপনগুলো, বড় বড় প্রতিশ্রুতির মতো, এখন আমাকে ক্লান্ত করে। আমি সেই কাগজপত্র, স্বপ্ন আর প্রত্যাশা সড়কের ধারে ফেলে এসেছি। হয়তো বাতাসে উড়ে যাবে, কিংবা কেউ ভুল করে কুড়িয়ে নেবে—এক মুহূর্তের কৌতূহল, তারপর বিস্মৃতি।

প্রকৃতির নিজস্ব শৃঙ্খলা আছে; সে জানে কবে ফুল ঝরবে, কবে আকাশ কেঁদে উঠবে। মানুষ জানে না—তাই তার প্রতিটি ঋতু অনিশ্চয়তায় ভরা। শরৎ আসলে আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সৌন্দর্যও ক্ষণিক; সাদা কাশফুলের রোদের ভেতরেও সময়ের ছায়া লুকিয়ে থাকে।

এখন আমি শুধু “আগে” আর “পরে”-র মাঝখানে আছি—সেই অদৃশ্য ফাঁকে, যেখানে কেউ তাড়া দেয় না, কেউ চায়ও না কিছু। আকাশ ধূসর হলেও শান্ত, মাটির গন্ধে এক প্রশান্ত বিষাদ। আমি জানি, এই নিস্তব্ধতাই আসলে আমার ঘর, আমার অস্তিত্বের শেষ সংজ্ঞা।

শরৎ আমাকে শিখিয়েছে—নীরবতা কখনও ভয় নয়; এ এক প্রকার মুক্তি।

সময়ের মুখ দেখতে দেখতে মনে হয়, শরৎ যেন এক আয়না—যেখানে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ একসঙ্গে প্রতিফলিত হয়। এই ধূসর আকাশে তাকালে দেখি, বহু বছর আগের এক বিকেল ফিরে আসে; হয়তো কলেজের শেষপ্রহর, দীঘির পাড়ে বসা, কিংবা এক অপূর্ণ কথোপকথন। তখনও জানতাম না, নীরবতাও কখনও এত বলিষ্ঠ হতে পারে।

শরতের আলো অদ্ভুত—সে উজ্জ্বল নয়, তবু তীক্ষ্ণ; যেন সত্যের মতো, যাকে এড়ানো যায় না। এই আলোয় দাঁড়িয়ে আমি নিজের ভেতর দেখি এক জটিল গাছের মতো জীবন—যার শিকড় গেছে মাটির গভীরে, আর শাখাগুলো ছড়িয়ে পড়েছে অচেনা আকাশে। কিছু ডাল শুকিয়ে গেছে, কিছুতে এখনো পাতার গন্ধ আছে। মানুষ হয়তো এইভাবেই বাঁচে—অসম্পূর্ণতায়, তবু অস্তিত্বের প্রমাণ রেখে।

আমি ভাবি, সুখ কি আদৌ কোনো স্থায়ী অবস্থা? নাকি কেবল এক ক্ষণিক অনুভূতি, যা আসে, ছুঁয়ে যায়, তারপর মিলিয়ে যায় শরতের পাতার মতো? আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলোও হয়তো এমনই—চোখে রয়ে যায়, হাতে ধরা পড়ে না।

আজকাল আমি সময়কে আর প্রতিপক্ষ মনে করি না। সে এক পুরনো সঙ্গী—মাঝে মাঝে পথ দেখায়, মাঝে মাঝে হারিয়ে দেয়। তার কাছ থেকে আমি শিখেছি, হারানোও এক প্রকার প্রাপ্তি; তাতে অহংকার কমে যায়, মন শান্ত হয়।

এই ধূসর শরতে আমি বুঝতে পারি, জীবনকে মাপার একটাই উপায় আছে—কতটা নীরবতার সঙ্গে আমরা বাঁচতে পারি। শব্দ, সাফল্য, আলোচনার ভেতর যতই নিজেকে খুঁজে বেড়াই না কেন, শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে হয় নিজের ভেতরেই। সেখানে কেবল এক টুকরো আকাশ থাকে—ধূসর, শান্ত, অথচ নিঃসীম।

শরৎ আমাকে বারবার শেখায়—অন্তরালে থাকাই কখনও কখনও সবচেয়ে বড় উপস্থিতি।

হাবীব ইমন : কলামলেখক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন