আম্মা, ও আম্মা

আম্মা, ও আম্মা এখন তো অনেক রাত—গভীর রাত
চারপাশে আলোকিত জলের বাঁক, আহ্লাদে লাফিয়ে উঠছে
পুরোনো দৃশ্য—জলের ভেতরে ক্ষত-বিক্ষত অন্ধকার—জানো,
এমন সুনসান রাত—কোজাগরি পূর্ণিমা রাতে সব হারিয়ে আমি কাঁদছি;
তুমি তো টের পাও, তাই না!

ও আম্মা, আমার কী হয়েছে, বলো না?
কিছু ভালো লাগে না, ঘুমোতে পারি না রাতভর,
বুকের ভেতর কেমন যেনো ছটপট লাগে।

সবাই যখন ঘুমিয়ে যায়, পানি নেওয়ার অজুহাতে
সারা ঘর পাঁয়চারি করি, তখন আমি চুপিচুপি তোমার
রুমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকি, আমার চোখ ছলছল করে 
দরোজাটা একটু ফাঁক করে চে’য়ে থাকি তোমার দিকে,
আমি তাকিয়ে দেখি; তুমি আমার দেখা-না দেখার শূন্যতা।

আম্মাকে আমি বলি ‘তুমি’, আম্মা দাঁড়িয়ে থাকতো বাবার সামনে,
বাবার সামনে আম্মাকে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে
আম্মাকে ‘আপনি’ বলার কথা কোনোদিন মনেই হয়নি।

আজ বাবা নেই। তাকে ‘আপনি’ বলা হয় না এখন।
আমার থেকে ১৮ বছরের বড় আম্মা, কিন্তু ছিল আমার সমান।
যখন ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর বড় হ’তে থাকি,
আম্মা বড় ছিল—বছর বছর আম্মা ছোটো হ’তে থাকে।

আম্মা দিন দিন ছোটো হ’তে থাকে, দিন দিন ভয় পেতে থাকে।
মাঝরাতে আম্মা ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখে
আজো অশ্রু-বিন্দু, আজো আম্মা টলমল করে।

আম্মা, কতো শব্দহীন রাতে তোমাকে একপলক দেখতে
চুপিচুপি তোমার ফরসামুখ দেখি, যেনো
আমাকেও এক লহমা স্বর্গের স্পর্শ দিচ্ছো।

কতো মধ্যরাত তোমার দরোজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি
কী যে দ্বিধা হয়, কাছে ঘেঁষার সাহস পাই না,
জানি না আমার কেবল ভয় লাগে, লজ্জা লাগে
একদিন রাতে তোমার গায়ের সুবাস নিতে চুপিচুপি
তোমার ঘরে ঢুকেছি—
তোমার নরোম-শাদা হাত ধরে আমি নিশ্চুপ ক্রন্দনে মেতেছি
কারবালা প্রান্তরে যেনো শোকার্ত কান্নার ফোয়ারা বইছে 
আম্মা, তুমি কি শুনতে পেয়েছিলে? সমস্ত পাথর আমি একা বই!
যখন আমার অসুখ লাগতো, সারা রাত তুমি
কোরোসিনের বাতি জ্বলিয়ে আমার পাশে
বসে থাকতে, বসেই থাকতে, একটুও নড়তে না
তোমার চোখে আধো ঘুম, বলতাম— আম্মা ঘুমোতে যাও
যেতে না, বসে থাকতে, আমার মাথাটা ধরে। 

আম্মা, তুমি চেয়েছিলে উৎকৃষ্ট মানুষ হবো,
এই যে এঁকেছি, ক্ষতচিহ্নগুলো গুণে নাও।  
ও আম্মা সবাই ক্যান আমাকে ঠকায়, সমস্ত দূষিত জলস্রোত
যেনো আছড়ে মারে, মিথ্যে মিথ্যে ভালোবাসা খেলা খেলে,
দয়া করে, ক্যান আম্মা?
ক্যান আমার সব বিশ্বাস তলিয়ে যাচ্ছে চোরাবালিতে?
তুমি তো কাউরে ঠকাও নাই আম্মা, আমিও তো কাউকে ঠকাইনি
যতো দূরে ছুটতে যাই, ততো আগলে রাখো, আশ্রয় দাও
আম্মা, ও আম্মা কখনো তোমাকে বলিনি, বলতে গিয়েও পারিনি
—‘তোমাকে আমি অ-নে-ক ভালোবাসি’।

কোনোদিন হয়তো আর বলার সুযোগ নাও পেতে পারি।
আম্মা ও আম্মা, মেঘের মধ্যে যারা থাকে
তারা আমায় ডাকে, আমায় ডাকে, শুনতে পাচ্ছো তুমি?
আম্মা, ও আম্মা আমার গল্পটা কবে শ্যাষ হবে?

৬ এপ্রিল ২০২৫

আরও পড়ুন