আমার দীর্ঘ ৩৭ বছরের বন্ধু কবি নুরুল হক বোমবার্ড

“সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে—সব নদী—ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

জীবনানন্দ দাশের এ কবিতা পংক্তির সঙ্গে সংযোজিত হলো আমার কবিতার কয়েকটা পংক্তি আমার দীর্ঘ ৩৭ বছরের বন্ধু কবি। নুরুল হক বোমার্ডের ২০০৬ সালে কার্তিকের কুয়াশার মাঝে উড়ে যাওয়া পাখির মত বিষন্ন প্রয়াণে।

‘তোমরা আসিবে যারা
শতাব্দীর প্রান্তর সাঁতরায়ে                         
তিরনই আর টাঙ্গনের                      
মুখরিত অববাহিকায়                                 
পৃথিবী চুমিছে যেথা নিলীমা আকাশ           
ক্ষেত ভরা ধান আর                           
এ মাঠ প্রান্তরে                                   
সকলের মতো                                      
তোমরাও পাবে দেখা এমনি একদিন
শুধু পাবে না দেখা আর
ত্রিকাল দীঘল জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে
একটি বারেও
সেই যে আপন ভোলা শিবাকৃতি
বিংশ শতাব্দীর শেষাংশের
শেষ ভোলানাথ রুহিয়ার
নুরুল হক বোমবার্ড নাম যার।
              আমার ৩৭ বছরের প্রাণ কৈলাশ
ধামের প্রাণ পুরুষরে।’

যত দূর মনে পড়ে ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিলে ঠাকুরগাঁও কলেজের অধ্যক্ষের পদে আমি যোগদান করি। বাম রাজনীতির ছাত্রাবস্থা থেকে চলমান পরিক্রমায় পরিচিতি প্রাপ্তি ঘটে সে সময়ের বাম রাজনীতির খ্যাতিমান পুরুষকূলের এ্যাডভোকেট মুহম্মদ হোসেন, এ্যাডভোকেট নুরুল হক, ডাক্তার আব্দুল মালেক, আলা ভাই ওরফে আলাউদ্দীনসহ নিবিড় বন্ধুতাবদ্ধ জন রেজওয়ানুল হক ইদু চৌধুরীর সঙ্গে ব্র্যাকেটাবদ্ধ ভোলানাথ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দশাশয়ী পুরুষ নুরুল হক বোমবার্ডের বউ আমার ছাত্রী ছিল। বোমবার্ডের শ্যালক মহসীন এবং শ্যালিকা মিকিও আমার ছাত্র/ছাত্রী। আমার মনে হয় আমার কালপঞ্জিতে সে সময়টা লেখাপড়ার একট স্বর্ণ যুগ না হলেও যুগটা রৌপ্য যুগের নিচে নয়।

এখান থেকেই বোমবার্ড আব্দুর রশীদ প্রিন্সিপাল ক্ষণে অক্ষণে-কুক্ষণে শব্দটা এখানে খাটবে না-পথচলা। আমি বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার মস্কোপন্থী মোজাফফর ন্যাপের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ঘোড়াঘাটের এ্যাডভোকেট লুত্ফর রহমান চৌধুরী এখনো সুস্বাস্থ্য নিয়ে জীবিত। বোমবার্ড ভাই বয়সে আমার চেয়ে বছর দুয়েক বড়। তাই আমার চিরায়ত বোমবার্ডদা মাঝেমধ্যে মুসলামানী ধাঁচে বোমবার্ড ভাই যিনি আমার সভাপতিত্বে চালিত সেকালের মোজাফফর ন্যাপের জেলা নির্বাহী কমিটির সদস্য এ সময়ে আমার কমিটির বিখ্যাত বাম নেতা গুরুদাস তালুকদার। ফুলবাড়ির রূপ নারায়ন দাদাও। রূপদাকে স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে অর্বাচীন মানব সন্তানের একজন হত্যা করে। সেই আততায়ী শরীফও (১৯৭৬-৭৭ এ আমার সঙ্গে দিনাজপুর জেলে ছিল) পৃথিবীতে আর নেই। সেও আততায়ী কর্তৃক নিহত হয়।

আমার মনে হয় ১৯৭৩ সালে আমি আওয়ামী প্লাবিত যুগে শেখ মুজিবের জীবমানে বিরল-বোচাগঞ্জ নির্বাচনী এলাকায় শেখের ক্যাবিনেট মন্ত্রী প্রফেসার ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে এম.পি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হই। সে বত্সর বোমবার্ড দাও এম পি নির্বাচন করেন। পীরগঞ্জের ডাক্তার মালেকও করে। আমরা সবাই মোজাফফর ন্যাপের বামপন্থী। শুধু ইদু চৌধুরী ভাসানী ন্যাপের বাম রাজনীতিবিদ। কিন্তু আমরা বামরা একে অপরের প্রাণ-বন্ধু। রাজনীতিবিদ বোমবার্ড, কবি বোমবার্ড, লেখক বোমবার্ড এবং পাঠক বোমবার্ড আর নেই। রুহিয়া সার্বিক জীবনাঙ্গনে নিত্য দিনের কুশিলব বোমবার্ড আর নেই।

“সেই শূন্য পানে চাই
আজি তার কোনো চিহ্ন নাই।’

মৃত বোমবার্ড তবুও সাময়িককালে বেঁচে থাকবে পরিচিতজনের প্রাণের আঙ্গিনায় নিত্য দিনের ধূলি কণায়। চিরদিনের কথা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু কবি বোমবার্ড বহুকাল বেঁচে থাকবে তার কবিতাগ্রন্থ “টাঙ্গন” কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে।

পয়ার ছন্দের টাঙ্গন কবিতার সুর ও ছবি মালা যৌবনবর্তী টাঙ্গনকে এবং এ কালের শীর্ণ টাঙ্গনকে টাঙ্গনের মৃত্যুর পরেও হয়তো তাকে জীবিত রাখবে বোমবার্ডের টাঙ্গন কবিতা।

বোমবার্ডদার জীবন সায়াহ্নকালে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে আমি তার সঙ্গে তিন-চারবার সাক্ষাত করেছি-বেদনা আনন্দের অনেক কথায় বলেছি। সেতাবগঞ্জেও আমার গ্রামের বাড়ি থাকে বহুবার মোবাইলে আলাপ করেছি। কিন্তু পরিতাপ যে তিনি যখন চিকিত্সার জন্য ভারতে আমি তখন করোনারি এনজিওগ্রাফি অপারেশন জনিত কারণে কয়েকদিন ধরে ঢাকায় জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালে দাদার শেষের কণ্ঠস্বর আমার কর্ণ কুহরে প্রবেশের আর সুযোগ পায়নি।

তিনি পৃথিবীর মৃত্তিকায় ঘাসের চাদরে আবৃত আমি পৃথিবীর ভূমিতে ঘাসের উপরে হেমন্তের উজ্জ্বল নীল আকাশের নিচে। আমার করোনারি তিনটি আর্টারি বাইপাস অপারেশন এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে যেকোনো সময় হবে। ওটি থেকে জীবন তটিনীর ধারায় ফিরে আসব আবার কিছু দিন পৃথিবী দেখব এ ভরশায় আছি..। যদি প্রত্যাশাপূর্ণ না হয়। তাহলে বোমবার্ডদার পেছনে যাত্রা অজানার দেশে-সেখানে বন্ধুত্বের অচ্ছেদ্য চিরন্তনতা।

শেষ কথা’কটি ইংরেজি কবি আমার প্রিয়তম কবি কিটসের ওড টু এ নাইটিঙ্গেল কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করছি- যে কথাগুলো আমার মৃত্যুর পর প্রযোজ্য হবে। নাইটিঙ্গেলের অমর সুর ও গানকে লক্ষ্য করে কবি বলেছে—
Still wouldst thou sing, and I have ears in vain—                
To thy high requiem become a sod.

অধ্যক্ষ আব্দুর রশীদ, সেতাবগঞ্জ দিনাজপুর

আরও পড়ুন