‘সাকরাইন’ পুরোন ঢাকার বর্ণিল আভিজাত্য

সোনিয়া তাসনিম খান Avatar

সুনীল আকাশের বুকে সাঁতরে বেড়াচ্ছে গোয়াদার, চোকদার, মাসৃদার, গরুদান, লেজলম্বা, চারুওয়াদার, পানদার, লেনঠনদার, গায়েল আরও কে কে! উঁহু, চমকে যাবার কোন কারণ নেই। এরা ক্ষ্যাপা শকুন কিংবা বোমারু প্লেন নয় কোন, তবে? এরা একবার ডানে কাটছে, তো আরেকবার বামে, একবার গোৎ খেয়ে বিস্তৃত গগনের শ্বেত মেঘদল ফুঁড়ে দিচ্ছে তো আরেকবার কেমন উড়োজাহাজের মত টাল খেয়ে নিচে নেমে আসছে। বিচিত্র নামে পরিচিত এরা আর অন্য কেউ নয়, ওরা সব বর্ণিল ঘুড়ির দল। দারুণ এদের কেতাই! আকাশ যুদ্ধ জয়ের সমরাস্ত্র যেন এসব রঙ বেরঙের সমদ্বিবাহু ত্রিভূজেরা। বাহারি রঙা কাগজ, পলিব্যাগ ও বাঁশের অংশে সজ্জিত এসব রঙিন ঘুড়িগুলো কেমন অনায়সে প্রজাপতির মত পাখনা মেলে দেয় অন্তরীক্ষে। পাতালে ঠাঁয় হয়ে থাকা নীরব সৈনিকদের মত দালানের ছাদ সেজে ওঠে আকর্ষণীয় ঢঙে। কিশোর কিশোরী থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধদের চোখে মুখে খেলে যায় আনন্দ ঝিলিক। হাতে খেলতে থাকে বাহারি নাটাই। অনুমান সঠিক। বলছিলাম, পুরোন ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসবের কথা। যে উৎসব যুগ যুগ ধরে নিজেদের অস্তিত্বে বহন করে চলেছে পুরোন ঢাকাবাসী। মূলত পৌষ সংক্রান্তি বা পৌষের শীতের আমেজকে এক অনন্য মাত্রায় অলংকৃত করবার জন্য এই উৎসবটি পালন করা হয়। পঞ্জিকা অনুসারে, বাংলা পৌষ মাসের শেষ ও মাঘ মাসের শুরুতে ঐতিহ্যবাহী এই ঘুড়ি উৎসব পালন থাকে ঢাকাবাসীরা। তবে বাংলা ক্যালেন্ডার ও পঞ্জিকার তারিখের কিছুটা পার্থক্যের কারণে দুদিন ব্যাপী এই উৎসব আয়োজন করা হয়। দিনভর ঘুড়ি আর আবেশী সন্ধ্যায় বর্ণিল আতশবাজি আর রঙ বেরঙের ফানুস উড়িয়ে সাকরাইন উৎসব উদযাপন করে পুরান ঢাকার লোকেরা। 

‘সাকরাইন’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘সংক্রান্ত’ ঢাকাইয়া অপভ্রংশে “সাকরাইন” এ রূপ নিয়েছে। যার আভিধানিক অর্থ হলো বিশেষ মুহুর্ত। অর্থাৎ বিশেষ মুহুর্তকে সামনে রেখে যে উৎসব পালিত হয় তাকে বলা হয় “সাকরাইন” এই সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশেই এই উৎসব পালন করা হয়ে থাকে। তবে অবশ্যই সেটা হয় ভিন্ন ভিন্ন নামে। বাংলায় এই দিনটি পৌষ সংক্রান্তি এবং ভারতীয় উপমহাদেশে মকর সংক্রান্তি নামে পরিচিত। এছাড়াও নেপালে এটিকে মাঘি, মায়ানমারে থিং ইয়ান, থাইল্যান্ডে সংক্রান বলা হয়। 

এবার জানা যাক, “সাকরাইন” উৎসবের পেছনের গল্প সম্পর্কে। ইতিহাসে বর্ণিত, পুরোন ঢাকায় এই উৎসব পালন হচ্ছে প্রায় ৪০০ বছর ধরে। ১৭৪০ সালের এই দিনে মোঘল আমলে নায়েব-ই-নাজিম নওয়াজেশ মোহাম্মদ খানের আমলে ঘুড়ি উড়ানো হয়। সেই থেকে এই দিনটি কেন্দ্র করে বর্তমানে এটি একটি অন্যতম উৎসব ও আমেজে পরিণত হয়েছে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই আনন্দ সহকারে দিনব্যাপী উৎসবে মেতে ওঠে। সকাল থেকেই শুরু হয় বর্ণিল ঘুড়ি ওড়ানোর ধূম। রংচং এ পতঙ্গের মত এসব কাগুজে খুশিগুলোর বাঁই বাঁই গতিতে যেন রঙের আঁকিবুঁকিতে সেজে ওঠে আকাশ। কেউ সগর্বে পত পত ছন্দ জাগায় তো কারও কারও হয়ে যায় ভো-কাট্টা। বাতাসে ভেসে আসে সেই ছেলেমানুষি হর্ষ ধ্বনি “এই বাকাট্টা, বাকাট্টা…ধর,ধর।” সন্ধ্যে নামলেই পুরানো ঢাকার এক টুকরো আকাশ হাজার হাজার আলোয় ঝলমলিয়ে উঠে। সেই সাথে স্বপ্নের মত উড়াল দেয় রং বেরং এর ফানুস। আতশবাজির ফুলঝুড়ির উন্মাদনা জাগে শূন্যে। অনেকে আবার আদিমতার ঢঙে মুখে আগুন দিয়ে খেলা দেখায়। মুখে কেরোসিন নিয়ে আগুনের তৈরি লেলিহান রশ্মি এক উচ্ছ্বাসপূর্ণ কলতান সৃষ্টি করে। উল্লেখ্য যে, ঢাকা ছাড়াও মূলত বাংলাদেশের অনেক গ্রামাঞ্চলে নতুন শস্য রোপন করে ঋতুরাজ বসন্তের রাজসিক অভিষেক পালন করা হয়। জ্যোতিষ শাস্ত্রে এটি একটি ক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এই দিন সূর্য তার নিজ কক্ষপথ থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে বিধায় এই দিনটিকে মকর সংক্রান্তি বলে।

“সাকরাইন” মানেই এক অনন্য শৈল্পিক নিদর্শন। এই উৎসবের ঘুড়িদের মাঝেও রয়েছে রকমফের। প্রতিযোগিতায় উতরে যাবার জন্য বর্ণিল চোখ ধাঁধাঁনো রঙের সাথে এদের মাপও হওয়া চাই সঠিক ভাবে। নাটাই ও ঘুড়িতে জুড়ে দেওয়া হয় বাহারি রঙের সুতো। সেসব সুতোর মাঝে রক সুতো, ডাবল ড্রাগন, কিং কোবরা, ব্ল্যাক গান, ডাবল গান, সম্রাট, ডাবল ব্লেট, মানজা, বর্ধমান, লালগান, টাইগার উল্লেখযোগ্য। কথিত আছে, পূর্বে জমিদার বাড়ির লোকেরা এই আয়োজনে ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য যে নাটাই ব্যবহার করত সেসব ছিল চান্দির তৈরি। আর সাধারণের হাতে শোভা পেত বাঁশের নাটাই। এখন অবশ্য এমনটা আর আলাদা করে দেখা যায় না। এছাড়াও পূর্বে সাকরাইনে পুরোনো ঢাকায় শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইদের জন্য নাটাই, বাহারি ঘুড়ি, পিঠের ডালা উপহার হিসেবে দেওয়ার রীতি ছিল। আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি থেকে আসা এসব ডালার মাঝে কার ডালা কত নান্দনিক তার একটা নীরব প্রতিযোগিতা চলত তখন। তবে কালের আবর্তে নতুন নতুন নানা রীতি রেওয়াজের দৌরাত্মে এখন এসবের অনেক কিছুই হারিয়ে গিয়েছে অতীত সময়ের গর্ভে। তবে আজও এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সপ্তাহব্যাপী পুরান ঢাকার রাস্তার সব অলিগলি আর খোলা ছাদে মহা সমারোহে চলে সুতো শুকানো আর তাতে মাঞ্জা দেবার ধূম। 

প্রাণের উৎসবকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলতে বাড়িতে বাড়িতে সব মজার খাবারের আয়োজন করা হয়। শীতের পিঠাপুলি, মুড়ি গুড়, পায়েস এসবের প্রদর্শন চলে দিনভর। হুল্লোড় করে দল বেঁধে চাঁদা তুলতে উদ্যোমী হয়ে পড়ে সব রসিক ছেলেপুলেরা। এই উৎসবের সবচাইতে আকর্ষণীয় অংশটুকু হল বাহারি ঘুড়ির মালিকদের মাঝে ঘুড়ি ওড়ানোর তুমুল প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা মূলত একসাথে ঘুড়ি ওড়ানোর পর যিনি যত বেশি উড়ন্ত ঘুড়ির সুতো দিয়ে অন্যের ঘুড়ি কাটতে পারবে এবং শেষ অবধি নিজের ঘুড়ি অক্ষত রাখতে পারবে তিনি হবে সেই রাজকীয় সমর ক্ষেত্রের বিজয়ী বীর। পরিশেষে বিজয়ীদের পুরস্কৃত করার মধ্য দিয়ে এই আয়োজনের মুকুটে এক অনন্য পালক সংযোজন করে নেওয়া হয়। 

পুরোন ঢাকার সবজায়গাতে “সাকরাইন” এর জাঁকজমক পূর্ণ আমেজ থাকলেও সুত্রাপূর, লক্ষীবাজার, গেন্ডারিয়া, সদরঘাট, তাঁতিবাজার, হাজারীবাগ, নবাবপুরে এই উৎসবের উন্মাদনা বেশি পরিলক্ষিত হয়। সকাল থেকে রাত অবধি চলে আনন্দফোয়ারার ফুলঝুড়ি।

তবে আধুনিকতার নামে বর্তমানে ডিজে, প্রোজেক্টর, সাউন্ড সিস্টেম এই ঐতিহ্যের জৌলুসকে অনেকাংশে ফিকে করে দিয়েছে। সেই সাথে ঘটাচ্ছে ভয়ানক শব্দ দূষণ। ফলে ঐতিহ্যবাহী এই সংস্কৃতি হারাচ্ছে তার আভিজাত্য। খর্ব হচ্ছে ইতিহাসের এক অমূল্য অনুসঙ্গ।

তবে সে যাই হোক না কেন, সাকরাইন মানেই রঙের উৎসব, আনন্দ জোয়ারে ভেসে যাওয়ার উৎসব। বর্ষ পরিক্রমার এই লগ্নে যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসা এই বাহারি, বর্নিল পৌষ সংক্রান্তি নি: সন্দেহে আমাদের সংস্কৃতির এক গর্বিত ধারক হিসেবেই আমাদের মাঝে অসীম আনন্দের নির্যাস ছড়িয়ে যাবে অনন্তকাল ধরে। 

তথ্যসূত্র: ইন্টারনেট, পত্রপত্রিকা, বই পুস্তক

সোনিয়া তাসনিম খান : লেখক ও  গল্পকার

মতামত