বিধ্বংসী প্রহর, পর্ব— ৫

আজ সাতদিন হলো পিন্টুর মা হাসপাতালে। চিকিৎসকের ভাষ্য- তার হার্ট অ্যাটাক করেছে। ইসিজি রিপোর্ট এসেছে ‘অ্যাবনরমাল’। ইকো রিপোর্টও খারাপ— ইজেকশন ফ্রাকশন ৪০% মাত্র। কোলস্টেরলের পরিমাণ অস্বাভাবিক বেশি। জরুরিভাবে তার এনজিওগ্রাম করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এনজিওগ্রামের সময় স্টেন্টিং করা সম্ভব হলে রিং পরিয়ে দেবে, অন্যথায় বাইপাস সার্জারি করতে হবে। যা করার দ্রুত করাই শ্রেয়, কেননা দ্বিতীয়বার ম্যাসিভ অ্যাটাক করলে রোগি নাও বাঁচতে পারে।
পিন্টুর ছোট বোন স্বর্ণা সকাল থেকে রাত অবধি মায়ের কাছে থাকছে। অন্যান্য কাজ পিন্টু করছে। পিন্টু চিন্তায় পড়ে গেছে।
এ পর্যন্ত বেশ কিছু টাকা খরচ হয়েছে, হাতে সামান্য কিছু আছে, কিন্তু এখন তো দুই/ তিন লাখ টাকার প্রয়োজন। এতো টাকা কোথায় পাবে? এ সময় মালিক অথবা জেরিন থাকলে তাকে সাহায্য করত। আচ্ছা নিধিকে বলে দেখবে? ওর কাছে তো জেরিন ম্যাডাম সব চাবি দিয়ে গেছে।
পিন্টু নিধির কাছে এলো। মায়ের অবস্থা নিধি জানে। পিন্টুর কথা শেষ হলে তার মুখের দিকে ভালো করে তাকালো নিধি। কেমন মলিন হয়ে গেছে ! হাতটা ছুঁয়ে বললো, ‘ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে। কথা হলো আমার কাছে এতো টাকা নেই। আমি আশা করি তোমাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে পারব।
বাকিটা তুমি জোগাড় করতে পারবে না ?’ পিন্টু মাথা নাড়লো। বলল, টাকা সংগ্রহের আর কোন উৎস তার নেই।
পিন্টু বলল, ‘জেরিন ম্যাডাম থাকলে আমি নিশ্চিত হেল্প পেতাম।’
নিধি বলল, ‘তা ঠিক।’
‘আচ্ছা ওনাদের সব চাবি তোমার কাছে না ?’
‘হ্যাঁ, আমার কাছে।’
‘তুমি আলমারি খুলে দেখলে আমার বিশ্বাস একটা উপায় হবে।’
নিধি একটু ভাবলো। তারপর বলল,
‘এটা কতোটা ঠিক হবে পিন্টু। বিশ্বাস করে চাবিগুলো দিয়ে গেছে।’
‘আরে চাবি তো প্রয়োজন হবে বলেই দিয়েছে, নাকি ?’
‘তুমি বলছো ?’
‘হ্যাঁ, সমস্যা হবে না।’
পিন্টুকে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখে নিধি জেরিন ম্যাডামের কক্ষের ব্যক্তিগত আলমারি খোলে। এর আগে এই বিশেষ আলমারিটা সে খোলে নি। নিধি দেখলো— ভেতরে কাপড়চোপড় ইত্যাদি ছাড়াও রয়েছে ম্যাডামের ব্যবহৃত স্বর্ণালঙ্কার, চেকবই, সঞ্চয়পত্র, কিছু ডলার এবং টাকা। নগদ টাকা রাখা আছে ১০০০/-টাকা নোটের বান্ডিল চারটা, ৫০০/- টাকা নোটের বান্ডিল দুটো, ১০০/- টাকার বান্ডিল দুটো এবং খুচরো কিছু টাকা। নিধি
গুণে দেখলো— উনিশ হাজার সাতশ’।
নিধি ভাবলো, বাহ্ ! ম্যাডামের তো অনেক টাকা ! আলমারি থেকে নিধি একটা ১০০০/- টাকার এবং একটা ৫০০/- টাকার বান্ডিল তুলে নিলো পিন্টুর জন্য। ভাবলো আরও পঞ্চাশ হাজার টাকা সে নিজের কাছ থেকে দেবে।
নিধি নীরব। নিস্তব্ধ কক্ষ।
হঠাৎ পিন্টু বলে উঠলো, ‘দেড় লাখে কিচ্ছু হবে না।’
অপ্রত্যাশিত এই কান্ডে পিন্টু হতভম্ব হয়ে গেলো। এ কী করলো নিধি !! সে না তাকে ভালোবাসে ! হাতটা উঠিয়ে আঙ্গুলগুলো নিজের গালে ঠেকালো। ব্যথা পেয়েছে সে। এবার ক্ষুব্ধনেত্রে তাকালো। নিধিও তার দিকে চোখ রাখলো। কিছুটা শান্ত এখন। এক কদম সামনে এসে বললো, ‘সরি।’
পিন্টু নি:শব্দ। নিধি আবার বললো, ‘তুমি না ড্রয়িং রুমে ছিলে ? এখানে কেন এলে ? তাও না বলে ! আসলে হঠাৎ আওয়াজ শুনে আমি চমকে গেছি।’ পিন্টু এবারও কোন কথা বললো না। মুখ ভার করে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। নিধি ‘শোনো’ বলে পেছন পেছন গেলো। ততক্ষণে পিন্টু চলে গেছে।
রাতে একটু জলদি শুয়ে পড়লো নিধি। মনটা খারাপ। ভাবে, রাগের মাথায় কী করে বসেছে ! আসলে হঠাৎ ক্ষেপে গেলে ওই মুহূর্তে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করা তার জন্য কষ্টকর। পিন্টুর মনটা ভালো দেখে তার সাথে আন্তরিকতা হয়েছে, পরে ভালোবাসা হয়েছে। সুবিধামত সময়ে বিয়েরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। সুখী সংসারের ভবিষ্যত পরিকল্পনাও করে রেখেছে। এসময় কী করে ফেললো সে ! পিন্টু তাকে ক্ষমা করবে তো !
চেষ্টা করতে করতে একটু ঘুম আসে নিধির। হঠাৎ কলিং বেলের শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায়। বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে। ঘড়ি দেখে। রাত এগারোটা। এসময় কে এলো ? পিন্টু কি আবার এসেছে ? তাকে যতদূর দেখেছে, সে এখন আসবার লোক নয়। তাহলে কি রিফাত ? কিন্তু রিফাত এলেও সে দরজা খুলবে না। নিধি চুপ করে শুয়ে থাকে। ওদিকে কলবেল বেজেই চলেছে।
নিধি ভাবে, যদি কোন জরুরি বার্তা থাকে ! এবার সে উঠে পড়ে। ওড়নাটা গায় জড়িয়ে দরজার দিকে যায়। বলে- ‘কে ?’ আবার উচ্চস্বরে বলে- ‘কে ?’
কোন জবাব নেই। নিধি ধীরে ধীরে দরজাটা খুললো। তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। দরজার সম্মুখ দিয়ে একটা বড় ইঁদুর দৌঁড়ে গেলো। এরপর আর বাইরে তাকালো না। দরজা বন্ধ করে দিলো।
নিধির ভয় ভয় করছে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেলো। এরপর রেজাউদ্দিন সাহেবের রুমে ঢুকলো। মানুষ নেই, রুমটা খা খা করছে। তাঁর বিছানার দিকে একনাগাড়ে তাকিয়ে রইলো। যেন খালুজান তাকে ইশারায় ডাকছে, একটু ধরে বাথরুমে নিয়ে যাবার জন্য।
দু’দিন হয়ে গেছে। পিন্টু কোন ফোন করে নি। অগত্যা নিধি নিজেই মোবাইলে কল দিলো। ওপাশে কল রিসিভ করলো।
‘হ্যালো।’ পিন্টুর ফোনে নারী কন্ঠ !
নিধি বলল, ‘হ্যালো। এটা পিন্টু সাহেবের ফোন না ?’
‘জী।’
‘উনি কোথায় ?’
‘এক্স রে রুমে। মাকে নিয়ে গেছে।’
‘ও আচ্ছা। আপনি কে ?’
‘আমি তার ছোট বোন।’
‘ও, স্বর্ণা ?’
‘হ্যাঁ। আপনি ?’
‘আমার নাম নিধি। আমি…।’
‘আপনাকে চিনি তো ! ভাই আপনার কথা অনেক বলে।’
নিধি একথা শুনে একটু আশান্বিত হলো। তাহলে পিন্টু সেদিনের ওই অপ্রীতিকর কান্ডটা ফাঁস করে নি ! ওর মনটা সত্যিই ভালো। বলল—
‘তোমার মা’র এনজিওগ্রামের কিছু হলো ?’
‘জী, পরশুদিন সকাল দশটায়।’
নিধি ভাবে, যদি তখন রিং পরানোর দরকার হয় টাকা পাবে কোথায় ? নাকি জোগাড় করে ফেলেছে ! কিন্তু কিভাবে ? নিধি বলল—
‘আচ্ছা ওনাকে বলবে যে আমি পরশুদিন সকালে আসবো। ও,টিতে নেয়ার আগে।’
‘আপনি আসবেন ? তাহলে তো ভালোই হবে। আচ্ছা আমি বলবো।’
‘এবার রাখি।’
বেলা ১১টা। রাজমিস্ত্রী এসে নিধির সাথে দেখা করলো।
গরম খবর নিয়ে। বললো, ‘জানেন আমি রেজাউদ্দিন স্যারকে দেইখা আসছি।’
নিধি অবাক ! বলে কী !
‘কোথায় দেখেছো ?’
‘আট নম্বর রোডের এমএমসি হাসপাতালে।’
[চলবে…..]
