‘দগ্ধা অথবা না-গল্পের ছায়া’ একটি শিল্পমান সমৃদ্ধ গল্পগ্রন্থ

বেশিরভাগ পাঠক একটা বইয়ের সহজ-সরল সুন্দর একটা নাম চায়, চায় সুন্দর মনকাড়া প্রচ্ছদ। এ দুটো চাওয়া পূরণ হলে-ই তারা বইটা হাতে ধরতে আগ্রহী হয়। পাঠকের এই চাওয়াটাকে ব্যক্তিগতভাবে আমি সম্মান করি, গুরুত্ব দেই। কারণ, সবাই তো আর বইয়ের লেখার মান দেখে কিংবা পাঠকের পিপাসা থেকে বই পড়ে না, পড়বে না। বইয়ের একজন সেলসম্যান হিসেবে এটা আমার নিবিড় পর্যবেক্ষণ। সেকারণেই ভবিষ্যতের জন্য এ-বিষয়টা জানিয়ে রাখলাম।
লেখক জোবায়ের মিলনের প্রথম গল্পের বই দগ্ধা অথবা না-গল্পের ছায়া কে অনেক নতুন ও তরুণ পাঠকের চোখ এগিয়ে গেছে এই নাম ও প্রচ্ছদের কারণে, এসব কারণে বলেকয়েও অনেক পাঠককে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করা যায় না। সত্যি বলতে, বর্তমান সময়ে এটাই নিরেট সত্য ও বাস্তব। কেউ চাইলেই এই সত্যকে পাশ কাটাতে পারে। তা পাঠক, লেখক, প্রকাশক, বোদ্ধাগণ পাশ কাটাতেই পারেন। এটাও যার-যার ব্যক্তিগত চিন্তা বা ভালোলাগা, না-লাগার ব্যাপার।
যাক সেসব মামুলি ব্যাপার-স্যাপার।
এই বইটা আমি পড়েছি, পড়েছি কারণ, এটা একটা গল্পের বই; আর গল্পের বই পড়তে আমি ভালোবাসি।
প্রচ্ছদ ও নামকরণ দেখে একটা বইকে আমি দূরে সরিয়ে রাখি না, রাখতে পারি না। আমি জানি, এই দিক দুটোকে এক পাশে সরিয়ে রেখে একজন সত্যিকারের পাঠক বইয়ের ভেতরে ডুব দেয়, আর ডুব দিয়ে মনি-মুক্তা খুঁজে ফেরে। বইটা পড়া শেষে সে মনি-মুক্তা পায়, কখনও কখনও সে হতাশও হয়। তবুও সে বইয়ের পাতায়-পাতায় ডুব দিতে ভুলে যায় না। কারণ, এটাই বিদগ্ধ পাঠকের নেশা।
এখন প্রশ্ন, লেখক জোবায়ের মিলনের গল্পের বই দগ্ধা অথবা না-গল্পের ছায়া পড়ে আমি কী পেলাম?
সব পেয়েছি, সব। ভালোলাগা, মুগ্ধতা। বইয়ের প্রতিটি গল্পে নয়, বরং প্রতিটি শব্দে লেখক আমাকে মুগ্ধতা উপহার দিয়েছে। সবচে আনন্দের ব্যাপার যে, এটা লেখকের প্রথম গল্পের বই বলে মনেই হয় না, মনে হয়, লেখক এর আগেও আরও অনেক গল্প লিখেছেন! বাজারে তাঁর আরও গল্পের বই আছে। সবচে বড় ব্যাপার যে, লেখায় কোনও খামতি নেই।
লেখক প্রতিটা শব্দে-শব্দে খেলেছেন। তাই, আগেভাবে আরেকটা কথা বলে রাখতে চাই, নয়ত পরে ভুলে যাবো, এই বইটা পড়ার আগে আমার ধারণা ছিল, এ লেখকও হয়ত গড়পরতা গল্প লিখেছে। গল্পে নতুন কোনও ভঙ্গি, নতুন স্বর, মুগ্ধতার কিছু পাবো না। সাদামাটা লেখাই লিখেছেন হয়ত। কিন্তু আমার ধারণা ঠিক হয়নি। উল্টো এখন লেখককে তার লেখার মানের কারণে তাঁকে আমার একজন বয়স্ক, ঋদ্ধ, পাক্কা লেখক বলে মনে হচ্ছে। এখনকার কতক বাচ্চা, কাঁচা লেখকের মতো পুতুপুতু, সস্তা, বস্তাপঁচা প্রেমকাহিনি, ন্যাকামি, সস্তা ইমোশনকে পুঁজি করে কাহিনি বর্ণনা করে-করে পাতার পর পাতা লিখে ৫০০/৬০০ পৃষ্ঠার পান্ডুলিপি প্রকাশকের হাতে তুলে দেননি।
বইয়ের বারোটি ছোটগল্প ওইসব মোটা মোটা বইয়ের তুলনায় হাজার গুণ ভারি। গুণে, মানেও সেরা।
লেখক জোবায়ের মিলনের এই দগ্ধা অথবা না-গল্পের ছায়া বইটি একটি শিল্পমান সমৃদ্ধ রচনা।
পৃথিবীর বিখ্যাত যেসব লেখকদের বই পড়ে আমরা মুগ্ধ হই, কিংবা অনেক লেখক যেমন মনেমনে বলে, ইশ, আমিও যদি এরকম করে লিখতে পারতাম! জোবায়ের মিলনের বইটাও ঠিক তেমন একটা বই।
এই ব্যাপারে আরও একটা কথা নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি, কতক বই পড়ে আমি মনেমনে বলে ফেলি, এরচেয়ে আমি ভালো লিখতে পারতাম। আবার কতক বই পড়ে বলি, নাহ, এর চে আমি ভালো লিখতে পারি না। তেমনি
জোবায়ের মিলনের দগ্ধা অথবা না-গল্পের ছায়া বইটি পড়ে বলছি, তাঁর চেয়ে আমি ভালো লিখতে পারতাম না। এটা আমার নির্মোহ মতামত।
আরে, বইয়ের গল্পগুলো নিয়ে আলাদা করে আলাপ করার কিছু নেই, ছোট ছোট গল্প, কাহিনি ফাঁস করে দিলে আর বাকি থাকল কী? গল্প নিয়ে আলোচনা করা মানেই হলো পাঠককে গল্প থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া।
প্রথম গল্পটা সৎ থাকার গল্প। সৎ হয়ে ওঠার গল্প। গল্পের শেষটায় লেখক পাঠককে দ্বিগুণ চমকে দিয়েছেন।
দ্বিতীয় গল্পটা মালিক ও শ্রমিকের চিরকালের দ্বন্ধ নিয়ে। যেখানে শ্রমিকরা বরাবরই হেরে যায়। গল্পের শেষ বাক্যটা বুকের ভেতর মোঁচড় দেয়।
এরপর করোনা নিয়ে গল্পটা সমাজের বাস্তব চিত্ররূপ। কিন্তু লেখকের কাজই হলো সাধারণ সে গল্পটাকে অসাধারণ করে তোলা। সে কাজটাই লেখক গল্পের শেষ প্যারাটাতে করেছেন। এখানেই লেখকের ক্ষমতা।
‘আবু ইসহাকের এক বিকাল’ গল্পটাও সৎ থাকার গল্প। যে গল্পে আবু ইসহাককে আমরা জিততে দেখি। দেখে ভালো লাগে, কিন্তু আমরা অনেকেই নিজেরা এমন করে জিততে চাই না। এটাই দুঃখ।
‘কাঠপেন্সিল’ গল্পের নাম ‘মায়া, ও মায়া’ হলে কেমন হতো লেখক? আরে, এটা এমনিই বললাম, সিরিয়াস হওয়ার দরকার নাই। গল্পটাতে মায়ায় ভরপুর। মন খারাপ হয়ে যায়। মন ভিজে যায়। গল্পটা সাদামাটা সুন্দর।
‘আদিম—অনস্বীকার্য’ গল্পটা বইয়ের সেরা গল্প (আমার চোখে)! লেখক শব্দ নিয়ে, বাক্য নিয়ে, উপমা, দৃশ্য, স্বর, ভঙ্গি নিয়ে রীতিমতো লেখেছেন। দারুণ। দারুণ। চেনা গল্প। কিন্তু লেখকের লেখার দক্ষতায় তা হয়ে উঠেছে এক অন্যান্য শিল্প।
এরপর ‘অন্তশীলা এবং একটি চুক্তিবিন্যাস’ গল্পটাও লেখকের দক্ষ একটি কাজ হয়ে থাকবে বলে মনে করি। দারুণ গল্প।
‘দায়মোচন’ গল্পটা এভারেজ। ‘নেকড়ে নদী ও কাবেরী রায়’ গল্পটাও। তবে কাবেবী রায়ের সংলাপটা ভালো লাগছে।
শেষ গল্প ‘দগ্ধা অথবা না-গল্পের ছায়া’ এর সমাপ্তিটা অনুমেয়, কিন্তু সুন্দর, মায়াময়, চোখের ভেতরটা চিকচিক করে ওঠে..
সবাই গল্প লেখে, সব গল্প, গল্প হয় না, হয় কাহিনি। কিন্তু এ বইটার সবগুলোই গল্প। সার্থক ছোটগল্প। জোবায়ের মিলন ছোটগল্প ভালো লেখেন। তাঁর গল্প নিয়ে আমার সুচিন্তিত মতামত।
আরেকটা সুন্দর ব্যাপার, লেখকের জন্মতারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি, আমার ১০ ফেব্রুয়ারি! হা হা… লেখক ও পাঠক মিলে ২০+১০=৩০!
বই : দগ্ধা অথবা না-গল্পের ছায়া
লেখক : জোবায়ের মিলন
ধরনা : গল্পগ্রন্থ
প্রচ্ছদ : নিয়াজ চৌধুরী তুলি
প্রকাশন : স্বপ্ন ‘৭১ প্রকাশন
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২৪ খ্রি.
মূল্য : ২৫০ টাকা।
বইটি পাওয়া যাবে কাঁটাবনের স্বপ্ন ‘৭১ অফিসে ও রকমারি ডটকমে।
সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন : +৮৮০১৭৩৭৩৭৩৮৬০।