‘শেষ বিকেলের মেয়ে’—যে উপন্যাস চমকে দেবে পাঠককে

যদি সুযোগ থাকত জহির রায়হানকে প্রশ্ন করতাম—’শেষ বিকেলের মেয়ে’ বড়ো গল্প থেকে রূপান্তরিত উপন্যাস কি না। প্রতীকীভাবে মকবুলকে শেষ বিকেল ধরে আগানো যায় কি না বিশ্লেষণে। মকবুল বুড়োর পারিবারিক পরিমণ্ডলে এক সীমাহীন কন্যাদায় স্পষ্টভাবেই পরিলক্ষিত। দেখানো হচ্ছে কাসেদকে শেষ বিকেলে নিজের বাসায় নিয়ে যান মকবুল। সেখানে তার এক মেয়ের সাথে কাসেদের অনুভবগত পরিচয়। এ মেয়েটি খুব প্রকাশিত কোনো চরিত্র নয়। বাঙালি মধ্যবিত্তের সহজাত রক্ষণশীলতা এক্ষেত্রে এসেছে, ভালোভাবেই এসেছে।
কাসেদের অফিসের বিপত্নীক বসের সাথে বিয়ের পর মেয়েটার রক্ষণশীলতা কমতে দেখি আমরা। তবে তা খুব বড়ো কোনো পরিবর্তন না আনলেও চোখে পড়ার মতোই হয়েছে। লক্ষ্য করি, ধনিক শ্রেণীর প্রতিভু তখন সে। বলতে চাচ্ছি, মধ্যবিত্ত জীবনে অভিভাবকের উপস্থিতি-অনুপস্থিতি একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক রক্ষণশীলতা প্রসঙ্গে। এ সংকট পাড়ি দিতেই বোধহয় মকবুল এবং কাসেদের মায়ের মৃত্যুর কৌশলে হেঁটেছেন জহির রায়হান। তাতে সুগম হয়েছে রক্ষণশীলতার নাগপাশ থেকে বের হবার পথ।
আমরা ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসের ডলি, সালমাদের স্মরণ করতে পারি এ প্রসঙ্গে। ডলি ত উত্তরাধুনিকতার নিদর্শন। সালমা চরিত্রের স্বামীর অবর্তমানে এক চাচার উপস্থিতি তার মধ্যে রক্ষণশীল মনোভাব ধরে রেখেছে।
আবার, গ্রাম্য পরিবেশের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে আম্বিয়ার যতদিন বাপ-ভাই না মরেছে পারিবারিক নিগড় থেকে বেরিয়ে মন্তুর প্রেমের সারথি হবার সুযোগ করতে পারেনি সে। ওদিকে স্বামীর মৃত্যুর পর টুনি বলছে—তা আর হয় না মিয়া! এভাবে মন্তু এবং আম্বিয়ার সকল বাঁধন ছিঁড়ে যাবার পর তারা ঘর বাঁধে।
রক্ষণশীলতা ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র সালমার মধ্যেও যা দেখি, তাতেও অভিভাবকের উপস্থিতি প্রভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ।
মকবুলের মৃত্যুপ্রসঙ্গে আরেকবার ফিরি। স্পষ্ট হয়নি তার স্থলাভিষিক্ত কে হলো। তার অসুস্থতার সময়টাতে অফিসের কলিগদের মধ্যে পদ নিয়ে আগ্রহ দেখা গেছে। পরোক্ষভাবে এটা কর্মস্থলে অন্তঃরাজনীতির প্রতি ইঙ্গিত করে। নিঃসন্দেহে বস চরিত্রটি ইতিবাচক। প্রসঙ্গত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ উপন্যাসের পদ্মঝি এবং ‘অনুবর্তন’ উপন্যাসের মিঃ আলম চরিত্রদুটোকে মনে পড়ে।
কাসেদের মায়ের চরিত্রে ধর্মপ্রাণ নারী এসেছে। এসেছে স্নেহময়ী শাসকের ব্যক্তিত্ব।
জহির রায়হান লিখেছেন— বাবা বলতেন, বেশ হলো, এতদিনে মেয়ের শখ মিটলো তোমার।
মা বলতেন, মিটবে না? খোদার কাছে কত কেঁদেছি, কত বলেছি আমায় একটি মেয়ে দাও। দেখলে তো, খোদার কাছে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। তবু তুমি একবেলা নামাজ পড় না। কেন পড় না বলো তো? তোমার কি পরকালের একটুও ভয় হয় না?
আবার ইহকাল পরকাল নিয়ে এলে কেন বলো তো? বাবা খেপে উঠতেন, বেশতো কথা হচ্ছিলো।
মা ম্লান হেসে বলতেন, নামাজের নাম নিলেই তোমার গায়ে জ্বর আসে কেন বলতে পারো?
আবার, মা হিসেবে স্নেহের শাসন দেখি—
ভেতরে আসতে অনুযোগভরা কণ্ঠে মা বললেন, দ্যাখো, ভিজে কী অবস্থা হয়েছে দ্যাখো। কী দরকার ছিলো এই বৃষ্টিতে বেরুবার?
কাসেদ কোনো উত্তর দেবার আগেই মা আবার বললেন, ঠাণ্ডা লেগে তুমি একদিন মারা যাবে। এই বলে দিলাম দেখো, তুমি একদিন বৃষ্টিতে ভিজেই মারা যাবে।
‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র তসলিমের মাকে মনে পড়ে? মনে পড়ে তাঁর স্বল্প উপস্থিতির সন্তানবাৎসল্য?
মায়ের মধ্যে দেখি ছেলের বউ ঘরে আনবার চিন্তা—জাহানারা, শিউলি উভয়ের ব্যাপারেই সচেতনতা দেখা গেছে ক্ষেত্রবিশেষে। তবে নাহারের ব্যাপারে এমন ভাবনার প্রকাশ হয়নি স্বাভাবিকভাবেই। যদিও তাদেরকে সন্তানের আদরেই বড়ো করা, আপন-পর ব্যবধানের হিসেবই পরিণতি ডেকে আনে দুজনের।
নাহার চরিত্র যেমন খোলসে আটকে থেকেছে বেশিটাই, তেমনি জাহানারা প্রায় খোলসের বাইরে থেকে হঠাৎই খোলসে আশ্রয় নিয়েছে। সরে গেছে কাসেদের জীবন থেকে। সালমা ত আগেই সরেছে।
খালুর চরিত্রে সহজাত মধ্যবিত্তীয় প্রতিক্রিয়াশীলতা দেখেছি কাসেদের চাকরির ব্যাপারে। পরে এ চরিত্রে তেমন বৈচিত্র্য দেননি জহির রায়হান।
ধারার বিপরীতে দাঁড়ানো একমাত্র চরিত্র এ উপন্যাসে বোধকরি শিউলি। সবচে বেশি করে আকর্ষণ করেছে আমাকে শিউলিই। তাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ চরিত্র হিসেবে দেখিয়ে, মনে হয়েছে একটু বঞ্চিতই করেছেন পাঠককে। অভিভাবকশ্রেণির সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে বিতর্কটা উস্কে দেওয়া যেত। সেক্ষেত্রে মনে হয় এ ধরণের চরিত্রের গুরুত্ব আরেকটু বাড়ত। বাড়া উচিত বলেই মনে করি, তাই এ প্রত্যাশা। তবে এটা উপন্যাসের কোনো দুর্বল দিক নয়। জহির রায়হান হয়তো ওটুকুই যথেষ্ট বিবেচনা করেছেন।
কাসেদের জীবনে জাহানারা, শিউলি, সালমাদের ছাপিয়ে নাহারের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার আখ্যান ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’। বলাবাহুল্য শেষের এই চমকটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। এখানেও বলতে হচ্ছে—নাহারের চরিত্রের আড়ষ্টতা, রক্ষণশীলতা অবশ্যই কিছু ইঙ্গিতপূর্ণ ছিল। থাকলেও, এতবড়ো রূপান্তর সত্যিই অভাবিত।
জহির রায়হানের অপরাপর উপন্যাসের তুলনায় ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ কিছুটা হালকা মেজাজের লাগল কেন, বুঝতে পারছি না। সম্ভবত কাসেদের চরিত্রে প্রেমভাবের দীর্ঘসূত্রিতা এর একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এর বাইরে সবটাই খাঁটি জীবনের গল্প হলেও তৃপ্তি-অতৃপ্তির এই দ্বৈরথ হয়তো সহজে শেষ হবার নয়।