‘পল্লী-সমাজ’—চিরায়ত অচলায়তন

কেন জানি না পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে—’দেবদাস’ যেখানে শেষ, তার পর থেকে ‘পল্লী-সমাজ’ শুরু হয়েছে। রমেশ হয়ে ফিরে এসেছে দেবদাস। পার্বতীর ছাড়াছাড়ি হয়েছিল ভুবন চৌধুরীর সাথে। সে ঘরে একটা কন্যা জন্মাবার পর পার্বতীর সৎমা রূপ ফুটে উঠেছিল। পাগলপ্রায় ভুবন মেয়েটাকে রেখে পার্বতীকে ছেড়ে দিয়েছিল।
দেবদাস মরেনি সেবার। তার দাহকার্যের আগেই কোনো কারণে জীবন ফিরে পেয়ে তার চন্দ্রমুখীকে মনে পড়ায় ফিরে গেছিল সে কাউকে কিছু না বলে। হ্যাঁ, শুধু কিছু টাকা আর হাতের আংটিটা দাহকারকে ধরিয়ে দিয়ে হাঁটা দিয়েছিল সে সেদিন।
মৃত মানুষ অমন জলজ্যান্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ায় ভড়কে গেছিল সেদিন ওরা। টাকা-আংটি কে নেয়? পুলিশের কাছে ছুটে গিয়ে কোনোমতে দিয়েই দে দৌড়!
‘পল্লী-সমাজ’ উপন্যাসের সূচনা অংশে বোধকরি রমেশকে ধূসর চরিত্র হিসেবে দেখিয়ে গেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ধীরেসুস্থে রমেশ সাদা হয়েছে, সেই সাথে বেণী-ধর্মদাস-গোবিন্দদের পল্লী-সমাজ কুৎসিত চেহারায় উপস্থিত হয়েছে পাঠকের সামনে।
“এ গাঁয়ে যে আবার—আর এ গাঁয়েই কেন বলি, সব গাঁয়েই—এ ওর সঙ্গে খায় না, ও তার সঙ্গে কথা কয় না—একটা কাজকর্ম পড়ে গেলে আর মানুষের দুর্ভাবনার অন্ত থাকে না। কাকে বাদ দিয়ে কাকে রাখা যায়, এর চেয়ে শক্ত কাজ আর গ্রামের মধ্য নেই।”
বিশ্বেশ্বরীর এই কথাটা বাপের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে গ্রামসুদ্ধ মানুষের মুখোশ ছেলের (রমেশ) সামনে খুলে যাবার যোগাড় প্রসঙ্গে এসেছে। গ্রামীণ উপন্যাস আরো পড়লেও এই কূটকৌশল, অসাধুতা, ভণ্ডামির চিত্র সেসবে মোটাদাগে পাইনি। যতটুকুও ছিল, তা পার্শ্বোপাদান হিসেবে সাময়িক। সময়ের সাথে গল্প এগিয়েছে। গল্পেই মিলিয়ে গেছে সেসব ঋণাত্মক আলোচনা। জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের পরীর দিঘি বেষ্টিত গ্রামটির মানুষের মধ্যে ঐক্যই দেখেছি, সালেহার চরিত্রের অস্বাভাবিকতা অতটা গুরুত্ব দেইনি। ‘বোবা কাহিনী’র তাম্বুলখানায় দেখেছি আজাহেরের সমস্যা মেটাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে গ্রামবাসী। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চাঁপাডাঙার বৌ’ ভিন্ন সুর তুললেও এতটা সর্বগ্রাসী মনে হয়নি। তবে এ কথা স্বীকার্য যে প্রত্যেক গ্রামেই কমবেশি পশ্চাৎপদতা, অন্ধতা, অজ্ঞতার ছোঁয়া একটু হলেও আছে, থাকে। ‘পল্লী-সমাজ’–এ কেবল ঋণাত্মক দিকগুলোই প্রকটিত। সে বিচারে অন্যান্য সমশ্রেণির উপন্যাস থেকে এর স্বাদ ভিন্ন।
‘মেজদিদি’ যখন পড়ি, বলেছিলাম নিম্নবর্গের মানুষের কিছুটা অস্তিত্ব রয়েছে কাহিনিতে। সেই ‘কিছুটা’ ‘পল্লী-সমাজ’–এ এসে আরেকটু বেড়েছে। এখানে জেলেনীর ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলা ব্রাহ্মণের বাকি-খাওয়ার প্রবণতা মুচকি হাসছে। জাতপাতের প্রসঙ্গ অবশ্য শুরু থেকেই ঢোল বাজিয়েছে উপন্যাসে।
বনমালী পাড়ুই চরিত্রের অবতারণায় ‘অনুবর্তন’-অভিজ্ঞতা ফিরে এসেছে কিছুটা। যদুবাবু-ক্ষেত্রবাবুরাও বেতন ঠিকঠাকমতো পেতেন না।
শুরুর দিকে রমেশ চরিত্র যত বিকাশ পেয়েছে ততই দশের ভালো করবার জন্য সৎ চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে তার মধ্যে। পরে ভুল ভেঙে যায়—তার মাধ্যমেই গ্রামের মানুষের মনস্তত্ত্বে প্রকট সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার কৌশল ভালো লাগার মতো।
গ্রামের মানুষের মধ্যে পরশ্রীকাতরতা, স্বার্থপরতা, অন্ধ শাস্ত্রনির্ভরতা, ষড়যন্ত্রপরায়ণ মনোভাব, অশিক্ষা—এসবের প্রভাবে রমেশ যখন মুখ ঘুরিয়ে নেয় গ্রাম থেকে, তখন বিশ্বেশ্বরী চরিত্রের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা।
মাতৃস্নেহের রকমফের দেখেছি বিশ্বেশ্বরী চরিত্রে। তিনি তার ছেলের বিপক্ষে যেতে পারেন না, আবার ছেলের অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন, এমনটাও বলার সুযোগ নেই।
উপন্যাসে এসেছে—
“… রমা, এক সন্তান যে কি, সে শুধু মায়েই জানে। বেণীকে যখন তারা অচৈতন্য অবস্থায় ধরাধরি করে পাল্কিতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে গেল, তখন যে আমার কি হয়েছিল, সে তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না।…”
“বর্ষা শেষ হইয়া আগামী পূজার আনন্দ এবং ম্যালেরিয়াভীতি বাঙ্গলার পল্লী জননীর আকাশে, বাতাসে এবং আলোকে উঁকিঝুঁকি মারিতে লাগিল, রমেশও জ্বরে পড়িল। গত বৎসর এই রাক্ষসীর আক্রমণকে সে উপেক্ষা করিয়াছিল; কিন্তু এ বৎসর আর পারিল না।…”
এরকম একটা অবস্থায় গ্রামীণ প্রতিবেশের বেশকিছু অসংগতি, সংস্কার, প্রথা, রীতিনীতির মুখে পড়ে যারপরনাই ভুক্তভোগী হয় রমেশ। ক্রমে দেখা গেছে গ্রামের লোকেরা নিজেদের ভালোটা বোঝে না—তাদেরই চিন্তাভাবনার পশ্চাৎপদতার প্রভাবে। সমগ্র উপন্যাসেই রমেশের আদর্শিক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়েছে। এর আড়ালে চাপা পড়ে গেছে রমেশ আর রমার মধ্যকার সম্ভাব্য প্রেমটি।
এরকম একটা অবস্থায় গ্রামীণ প্রতিবেশের বেশকিছু অসংগতি, সংস্কার, প্রথা, রীতিনীতির মুখে পড়ে যারপরনাই ভুক্তভোগী হয় রমেশ। ক্রমে দেখা গেছে গ্রামের লোকেরা নিজেদের ভালোটা বোঝে না—তাদেরই চিন্তাভাবনার পশ্চাৎপদতার প্রভাবে। সমগ্র উপন্যাসেই রমেশের আদর্শিক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়েছে। এর আড়ালে চাপা পড়ে গেছে রমেশ আর রমার মধ্যকার সম্ভাব্য প্রেমটি।
“সম্মুখে বসিয়া আহার করাইয়া পান দিয়া বিশ্রামের জন্য নিজের হাতে সতরঞ্চি পাতিয়া দিয়া রমা কক্ষান্তরে চলিয়া গেল। … রমা বিশেষ কিছুই এখানে তাহার আহারের জন্য সংগ্রহ করিতে পারে নাই। নিতান্ত সাধারণ ভোজ্য ও পেয় দিয়া তাহাকে খাওয়াইতে হইয়াছে। এই জন্য তাহার বড় ভাবনা ছিল পাছে তাহার খাওয়া না হয় এবং পরের কাছে নিন্দা হয়।…”
রাবীন্দ্রিক চরিত্র হৈমন্তী লোক খাওয়াতে ভালোবাসতো।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কুসুম, মানী, অনঙ্গ বৌদের বানিয়েছেন অসীম মায়া দিয়ে। ঘরে চাল বাড়ন্ত, তাতেও অতিথি খাওয়ানোয় এঁরা অন্তপ্রাণ হবেন।
স্বয়ং শরৎ ‘মেজদিদি’, ‘বড়দিদি’, ‘দেবদাস’, ‘শ্রীকান্ত’, ‘বিলাসী’সহ বহু লেখায় অন্নপূর্ণা নারীর নানান রূপভেদ দেখিয়েছেন।
আমরা পল্লীকবির কথাসাহিত্যে এবং স্মৃতিকথায় এন্তার দেখি এমন নারীমূর্তি। বিশেষ করে মা চরিত্রে পিঠা বানানোর গুণ দেখিয়ে তিনি পাঠককে মুগ্ধ করেছেন একাধিক লেখায়।
সাম্প্রতিক সমকালীন চরিত্র ইন্দুবালার কথা বলা যেতে পারে।
মোটাদাগে বাঙালির খাবারের আয়োজনে নারী এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার অনুষঙ্গ। বললে ভুল হবে না বোধকরি—শরৎই সাহিত্যে এ ধারার উদ্গাতা। এ ব্যাপারটিকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেই ‘পল্লী-সমাজ’–এ রমেশ-রমার প্রেমটি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। অবশ্য তিনি সমাজকে অস্বীকার করতেও পারেননি।
স্থানের ঐক্য বজায় রাখতে গিয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে জীবনমুখী বাস্তবতার অবতারণা ঘটিয়েছেন, সে উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। রমেশ আর রমার বিয়োগান্তক কাহিনির ব্যত্যয় ঘটালে হয়তো ঘটানো যেত তারকেশ্বরের ঘটনায় জোর দিয়ে। কিন্তু বোধকরি সচেতনভাবেই সে কাজ করেননি শরৎ।
আত্মরতিপরায়ণ বেণী ঘোষাল এবং তার সহযোগী খলচরিত্রগুলোর বিকাশে শ্রেণিপার্থক্যের অবতারণা। সেখান থেকেই বিশেষভাবে মনে রাখার মতো ব্যাপার হয়েছে ‘পল্লী-সমাজ’–এ চিত্রিত শ্রেণিসংগ্রাম। ‘মেজদিদি’ উপন্যাসিকায় যে সম্ভাবনার ইঙ্গিত রচনা দীর্ঘায়িত না করে দেখিয়েছেন শরৎ, ‘পল্লী-সমাজ’ তার বাস্তবায়ন দেখিয়েছে।
সমাজের কথা মাথায় রেখে বলি, নারীদের জন্য যে কাজ তুলনামূলকভাবে কঠিন হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে, পুরুষদের জন্য তার চেয়ে সহজ তা, সে সমাজে। গুরুত্বপূর্ণভাবে, শরৎ সমাজকে পুরোপুরি অস্বীকৃতি জানিয়ে নিজের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি, আগেই বলেছি। যতটুকু কুঠারাঘাতে নড়েচড়ে বসানো যায়, সেটুকুতে কার্পণ্যও করেননি।
সমাজের কথা মাথায় রেখে বলি, নারীদের জন্য যে কাজ তুলনামূলকভাবে কঠিন হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে, পুরুষদের জন্য তার চেয়ে সহজ তা, সে সমাজে। গুরুত্বপূর্ণভাবে, শরৎ সমাজকে পুরোপুরি অস্বীকৃতি জানিয়ে নিজের বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি, আগেই বলেছি। যতটুকু কুঠারাঘাতে নড়েচড়ে বসানো যায়, সেটুকুতে কার্পণ্যও করেননি।
শ্রেণিপার্থক্যে যারা শোষিতের প্রতিনিধি, তাদের প্রতি নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন বিশ্বেশ্বরী। এ ব্যাপারটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘হলুদ নদী সবুজ বন’ উপন্যাসে দেখা যায়।
রমেশের চরিত্রে যে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রচিন্তা প্রকটিত, তার কাছাকাছি চিন্তাধারায় ঢালিউডে সিনেমা হয়েছে– ‘স্বপ্নের পৃথিবী’। ‘পল্লী-সমাজ’ শুরুর দিকে না টানলেও তেমন, পাঠে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হলেও, পাঠশেষে তৃপ্ত করেছে বটে! শরৎকে সহজ বলে জানলেও চেনাপরিচিত এ চিরায়ত ভাষা শুরুতে কেন দুর্বোধ্য লেগেছে—সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন!
রেজওয়ান আহমেদ, শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।