বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক উপন্যাস প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’

বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক প্যারীচাঁদ মিত্র। যাঁর ছদ্মনাম ছিল টেকচাঁদ ঠাকুর। তিনি বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’এর মাধ্যমে। এটি বাংলা ভাষায় সফল উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। প্যারীচাঁদ মিত্রের তখন বয়স ৪০ বছর।১৮৫৪ সাল। বাল্যবন্ধু প্রসিদ্ধ গণিতবিদ রাধানাথ শিকদার একটি পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন। পত্রিকাটি নাম ছিল ‘মাসিক’। এখানে বন্ধুর আহ্বানে লিখতে শুরু করেন ‘আলালের ঘরের দুলাল’। কয়েকটি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পর ১৮৫৮ সালে এটি বই আকারে প্রকাশিত হলে কলকাতায় সাহিত্যঅঙ্গনে ব্যাপক আলোচিত হতে লাগে। তখন উপন্যাস নামে সেইভাবে বাংলা সাহিত্যে পরিচিত ছিল না। প্যারিচাঁদ মিত্রই বাংলা সাহিত্যের ‘উপন্যাস’ শব্দ নতুনভাবে সংযোজন করেন। তখন এমন বড় গল্পগুলোকে ‘নভেল’ নামে প্রচলিত ছিল।
‘আলালের ঘরের দুলাল’ এই উপন্যাসটি সাহিত্যবোদ্ধের মধ্যে আলোচিত হওয়ার অন্যতম কারণ হলো, গুরুগম্ভীর সাধুর বদলে সমাজের সাধারণ জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত চলিত ভাষার প্রয়োগ। হালকা চালের ভাষার বিন্যাস করা হয়েছে। শব্দযোজনা দেখলেই বোঝা যায়, এটি করা হয়েছে স্বপ্রণোদিতভাবে, সমাজের সর্বস্তরের পাঠকের সুখপাঠ্য করে। পরর্বতীতে প্যারিচাঁদের এই ভাষা প্রসিদ্ধ হয়েছিল ‘আলালী ভাষা’ নামে।
সাহিত্য সমালোচকগণের মতে, এটি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সামাজিক নকশা। গ্রন্থটি সম্পূর্ণ সামাজিক পটভূমিকায় রচিত। নব্যশিক্ষিত ইয়ংবেঙ্গলদের কার্যকলাপ ও পরিণতি এ গ্রন্থের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এখানে দেশীয় বন্ধ্যা শিক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিশৃঙ্খলতা ও পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণ নিয়ে লেখকের অভিমত প্রকাশ করেছেন। তবে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার আলোকে উচ্চ আদর্শ সম্পন্ন জীবন গঠনকে লেখক স্বাগত জানিয়েছেন। প্যারীচাঁদ মিত্র এই নবলব্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে লক্ষ্য করেছেন যে ধর্ম ও নীতিহীনতাই উচ্ছৃঙ্খলতার মূল কারণ। সুতরাং ধর্মীয় ও নৈতিক জীবনযাত্রা প্রণালীর মধ্যেই রয়েছে এ থেকে মুক্তির পথ। এ কথা প্রমাণ করার জন্যই তিনি লিখেছেন আলালের ঘরের দুলাল।
আলালী ভাষারীতি বাংলা গদ্যের মাধ্যম হিসেবে টিকতে পারেনি। কিন্তু পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে যে আদর্শ গদ্যরীতির উদ্ভব ঘটেছিল তার পিছনে এ আলালী রীতির অবদান অনস্বীকার্য। আর এখানেই প্যারীচাঁদ মিত্রের সার্থকতা।
প্যারীচাঁদ মিত্র ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ ছদ্মনামে এ উপন্যাসটি পত্রিকায় লেখেন। আলালের ঘরের দুলাল উপন্যাস কিনা এ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। কেউ বলেন এটি বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস, আবার কারো মতে এটি উপন্যাস নয়, উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত। আলালের ঘরের দুলাল সার্থক উপন্যাস না হলেও বাংলা ভাষার উপন্যাস রচনার প্লাটফর্মটি তৈরি করে দেয়। এ গ্রন্থটি ‘দি স্পয়েড চাইল্ড’ নামে ইংরেজীতেও অনূদিত হয়েছে।
আলালের ঘরের দুলালের কাহিনি
ধনী বিষয়ী বাবুরামের অতি আদরের পুত্র মতিলাল আবাল্য কখনও ধর্মীয় ও নীতির শিক্ষা পায় নি। শিক্ষার ব্যাপারেও পিতা ছিলেন উদাসীন। উপরন্তু কুসঙ্গ তাকে অধঃপতনের শেষ ধাপে নিয়ে যায়। পিতার মৃত্যুর পর প্রাপ্ত সব সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলে। পরে দুঃখের জীবনে তার বোধদয় ঘটে এবং হৃদয় মন পরিবর্তিত হয়। অন্যদিকে মতিলালের অনুজ রামলাল আদর্শ চরিত্র। বরদাবাবুর একান্ত স্নেহছায়ায় বড় হয়ে তার সকল নির্দেশ মান্য করে সে সর্বজনের প্রশংসা অর্জন করেছে। মতিলালের চৈতন্যদয় ও আদর্শ জীবনের প্রতি আকর্ষণের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটেছে উপন্যাসের। মূল ঘটনা অপেক্ষা এ বিচিত্র ক্ষুদ্র পল্লবিত ঘটনাই গ্রন্থটির আশ্চার্য সফলতার কারণ। বস্তুত: বরদাবাবুর মত মূর্তিমান নীতিপাঠ, বেনী বাবুর মত সজ্জন অথবা আদর্শ যুবক রামলাল এরা কেউই আলালের মত মূল আকর্ষণীয় নয়। এদের মধ্যে সুশিক্ষা থাকতে পারে কিন্তু উপন্যাসের যা প্রধানতম উপকরণ জীবনের স্বাদ তা এই চরিত্রগুলোতে নেই। আলালের অবিস্মরণীয় সাফল্য এনে দিয়েছে মতিলাল স্বয়ং এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ হলধর, গদাধর ইত্যাদি। এছাড়াও ধূর্ত উকিল বটলর, ধরিবাজ মুৎসদ্দি বাঞ্ছারাম, তোষামোদকারী বক্রেশ্বর বাবু ইত্যাদি চরিত্র জীবন্ত। তবে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলো মোকাজন মিঞা বা ঠকচাচা। চরিত্রটি ধূর্ততা, বৈষয়িক বুদ্ধি ও প্রাণময়তা নিয়ে এ গ্রন্থের সবচেয়ে জীবন্ত চরিত্র।
দ্বিতীয়বারের ভূমিকা : শ্রীপ্রাণনাথ দত্ত চৌধুরী
আলালের ঘরের দুলাল—ইতি পূর্ব্বে এই সুললিত উপন্যাসটি একবার রোজারিও কোম্পানির যন্ত্রণালয়ে মুদ্রিত হয়, কিন্তু তাহাতে বহুতর বর্ণাশুদ্ধি ও অস্পষ্ট মুদ্রণ জন্য পাঠকগণের অনেক পাঠ ব্যাঘাত হইত। এক্ষণে ঐ মুদ্রিত পুস্তক সমস্ত নিঃশেষ হওয়াতে গ্রন্থকার এতৎ গ্রন্থের সত্ত্ব সুচারু যন্ত্রালয়াধিকারীকে দিবায় তিনি নিমতলা নিবাসী শ্রীযুক্ত গিরীন্দ্রকুমার দত্ত মহাশয়ের কৃত কয়েকখানি লিথোগ্রাফ চিত্র দিয়া ইহা পুনর্ব্বার শুদ্ধ ও স্পষ্টরূপে মুদ্রিত করিতেছেন। বোধ করি এইবার পাঠকগণ ইহার বিশুদ্ধ মুদ্রণ ও সদ্ভাব সম্পন্ন চিত্র গুলিন দেখিয়া পূর্ব্বাবাপেক্ষা অধিকতর সন্তুষ্ট হইবেন। “কিমিবহি মধুরাণ মিত্যাদি’ শ্লোক দ্বারা যদিও সুন্দর বস্তুর অলঙ্কারের অনাবশ্যকতা প্রকাশ করে তথাপি কৃত্রিম অপরিচ্ছন্নতার অপ্রশস্তি ও অলঙ্কারের সৌন্দর্য্য স্বীকার করিতে হয়। অত্র স্থলে “আলালের ঘরের দুলালের” গুণাগুণ বাখ্যাকরা আমাদিগের কর্ত্তব্য বিবেচনায় তদ্বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ লিখিতেছি। যখন বাঙ্গালা ভাষায় ইংরাজদিগের নবেলের ন্যায় রচিত গ্রন্থের অসদ্ভাব ছিল যখন জ্ঞানপ্রদীপ, বেতালপঞ্চবিংশতি বত্রীশসিংহাসন প্রভৃতি গ্রন্থ পাঠ করিয়াই পাঠকগণের অপ্রশস্ত অন্তঃকরণ সন্তুস্ট হইত, তখন কাহারও এরূপ বোধ ছিলনা যে অমিত্রাক্ষর কবিতা বা সর্ব্ব রসাধার সৎভাব পূর্ণ নব২ নবন্যাস (Novel) হইতে পারে। কিন্তু এক্ষণে শ্রীযুক্ত মাইকেল মধুসূদন দত্তের তিলোত্তমাদি কাব্য পাঠে সজ্জন সমূহ বিলক্ষণ বুঝিয়াছেন, যে বাঙ্গালায় অমিত্রণক্ষর কাব্যের মধুরতা অত্যদ্ভুত এবং শ্রীযুক্ত টেকচাঁদ ঠাকুরের আলালের ঘরের দুলালাদি গ্রন্থই বাঙ্গালা নবন্যাশের মনোহারিত্ত্ব ও হিতকারিত্ত্বের পরিচয় স্থল ৷ কবিবর মাইকেল যে রূপ বাঙ্গালায় অমিত্রাক্ষর কবিতার শ্রেষ্ঠা নবপদ্যাতিতে নবন্যাস রচনাবিষয়ে সুধী শ্রেষ্ঠ টেকচাঁদ ঠাকুরও সেই রূপ। ইনিই বঙ্গভাষানুরাগীদিগের অন্তর হইতে “বারাণশী নগরীতে প্রতাপমুকুট নামে” “মিথিলা নগরে গুণাধিপ নামে” ইত্যাদি প্রকার পরম্পরাগত গৌরচঙ্গিক-প্রিয়তা দূর করিয়াছেন, এবং পাঠকসমূহকে নিতান্ত বালকগণের শ্রবণ-প্রিয় পিতামহীর কথিত এক রাজা ও তার দো সো দুই রাণীর গল্পের ন্যায় গল্পপাঠে অনর্থক কালাতিপাত হইতে নিবৃত্ত করিবার পথ প্রদর্শন করিয়াছেন। প্রশংসিত টেকচাঁদ ঠাকুর মহাশয় বাঙ্গালায় অতি সরল ও সর্ব্বসাধারণের অনায়াসে বোধগম্য রচনা-পদ্ধতি প্রচার করিয়াছেন। বর্ত্তমান গ্রন্থে যদিও কাদম্বরীর উৎকট-পদ প্রয়োগ-পটুতা, শকুন্তলার ললিত-পদবিন্যাস মাধুর্য্য, বাসবদত্তার অনুপ্রাস ছটা ও তিলোত্তমার ভাব ঘটা নাই; যদিও ইহার আখ্যায়িকা ভাগ দুর্গেশনন্দিনীর ন্যায় বিস্ময় ও কৌতূহলোদ্দীপক নহে; যদিও ইহাতে সঞ্জুক্তা-স্বয়ম্বরের ন্যায় কোন পুরাণ ইতিহাসিক ব্যাপার বর্ণিত হয় নাই; যদিও ইহাতে কপালকুণ্ডলার ন্যায় জঢ় স্বভাব সৌন্দর্য্য-বিশিষ্টরূপে বর্ণিত হয় নাই ; এবং যদিও ইহা সীতার বনবাসের ন্যায় বিশুদ্ধ সাধুভাষায় গ্রথিত নহে; তথাপি ইহাকে উল্লিখিত গ্রন্থ সমস্তের অধিকাংশাপেক্ষা উত্তম বলিয়া গ্রহণ করিতে হয়। ইহা অস্মদ্দিগের কথোপকথনে ব্যবহৃত ভাষায় রচিত, এবং ইহার প্রাঞ্জলতা এত অধিক যে বাঙ্গালিমাত্রেই অনায়াসে বুঝিতে পারে। ইহাতে সজীব ও সান্ত্বর স্বভাব অর্থাৎ মনুষ্য স্বভাব যে প্রকার কৌশলে ও পারিপাট্যের সহিত চিত্রিত হইয়াছে, সেরূগ বাঙ্গালা ভাষায় আর দেখা যায় না। এক্ষণে অনেকেই নবন্যাস রচনায় প্রবর্ত্ত হইয়াছেন, কিন্তু তাঁহাদিগের রচিত গ্রন্থ গুলির কার্য্যাদির সমস্তভাগ কালোচিতও সম্ভব নহে এবং পরিচ্ছদাদিরও বৈপরীত্য অনেক দেখা যায় অধিক কি তাঁহাদিগের রচিত গ্রন্থ পাঠে সময় ও স্থান সম্বন্ধ কিছুই অবগত হওয়া যায় না, এবং তাঁহাদিগের বর্ণিত নায়কনায়িকাদি কাহারও মূৰ্ত্তির প্রতিবিম্ব পাঠকগণের চিত্তদপণে পড়ে না। “আলালের ঘরের দুলাল” সে রূপ নহে ইহাতে আখ্যায়িকার সমকালিক দেশাচার ও অবস্থাদি দর্পণে পতিত প্রতিবিম্বের ন্যায় স্পষ্ট এবং সর্ব্বঙ্গ সুন্দররূপে চিত্রিত হইয়াছে। পাঠকগণ পাঠ করিতে করিতে মনে করেন যেন সমস্ত সন্মুখে দেখিতেছেন। ইহাতে বালকগণের শিক্ষা বিষয়ে পিত্রাদির অযত্নের দোষ এবং আত্মশুদ্ধি ও ধৰ্ম্মবুদ্ধির শুভকরীত্ব স্পষ্টরূপে দর্শিত হইয়াছে। ইহার রচনা নানা রসাশ্রয়, ললিত, প্রাঞ্জল, সব্যঙ্গ, সন্তোষপ্রদ ও জ্ঞানগর্ব্ভ এবং ইহার নায়কনায়িকাদি সমস্ত ব্যক্তিই সম্ভব স্বভাব-সম্পন্ন মনুষ্য। পাঠকগণ যত্ন করিলে এখনও পল্লি গ্রামবাসী অনেক বাবুরাম বাবু ও মতিলালকে দেখিতে পারেন, এবং মতিলালের মাত, ভগিনী ও স্ত্রীর স্নেহ ও সরলতা রয়ী প্রতিমূর্ত্তি সজ্জন-বৃন্দ নিজ নিজ অন্তঃপুরেই দেখিতে পারেন। যাঁহারা কখন আদালতে গিয়াছেন, এবং অভিযোগাদি করেন, তাঁহারা ঠকচাচা প্রভৃতির আদর্শ অবশ্যই দেখিয়াছেন। বাহুল্য ভয়ে আমি এই স্থানেই নিবৃত্ত হইতে বাধিত হইলাম, কারণ এই গ্রন্থের গুণাগুণ বিস্তারিত ব্যাখ্যা করিতে হইলে গ্রন্থাপেক্ষা একখানি বড় গ্রন্থ হইতে পারে। “কি মধিকং বিজ্ঞবরেষু বিজ্ঞাপ্যমিতি”।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক প্যারীচাঁদ মিত্রর ২০৭তম জন্মদিন। তিনি ১৮১৪ সালের ২২ জুলাই কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামনারায়ণ মিত্র। তিনি কাগজ ও হুন্ডি ব্যবসায়ী ছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্র বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্রের ভ্রাতা কিশোরীচাঁদ মিত্র৷ তাঁদের আদিনিবাস অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার পাণিসেহালা গ্রাম৷ ১৮৮৩ সালের ২৩ নভেম্বর তিনি কলকাতায় মারা যান।