গওহর নাইম ওয়ারার ‘একাত্তরের সামাজিক ইতিহাস: প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান’

ইতিহাস শব্দটি শুনেই আমরা সাল-তারিখের কথা ভাবতে শুরু করি। কারণ ইতিহাসবিদেরা সাল-তারিখের ছাচেই ইতিহাস রোমন্থনে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু ইতিহাসকে যদি তুলে ধরার প্রয়াস নেয়া হয় সেই ইতিহাসেরই অংশ হয়ে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীদের থেকে? সেক্ষেত্রে সাল-তারিখের চেয়েও মুখ্য হয়ে উঠবে সেই প্রত্যক্ষদর্শীদের নিজেদের অভিজ্ঞতা যা অভিজ্ঞ একজন লেখক অনুলিপি বা অনুলেখন করে ফেলতে পারবেন গল্প বলার আঙ্গিকে। অন্তত তাই উপলব্ধি হল গওহর নাইম ওয়ারা রচিত ‘একাত্তরের সামাজিক ইতিহাস : প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান’ বইটি পাঠ করে।
বইটি কোনো গল্পগ্রন্থ না হলেও একাত্তরে যুদ্ধকালীন বিভিন্ন সত্য ঘটনা বা সত্যগল্পের সমাহার। যারা গল্প বলছেন তারা নিজেরাও সেই গল্পের চরিত্র বা বই এর শিরোনাম অনুযায়ী প্রত্যক্ষদর্শী। এই চরিত্রগুলো নিজেদের গল্পগুলো বলছেন সমাজের বিভিন্ন অংশ হতে। এরা সকলেই যুদ্ধ দ্বারা আক্রান্ত কিন্তু সকলেই যে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত এমন নয়। যার কারণে তাদের মাধ্যমে লেখক প্রয়াস নিতে পেরেছেন রণক্ষেত্রের এবং রাজনৈতিক হিসাব নিকাষের বাইরে থেকে সমাজের বিভিন্নক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধকেও নতুন ভাবে উপলব্ধি করার। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় বিজ্ঞানী রেজাউর রহমানের কথা যার বয়ান লেখকের নিজস্ব ভাষায় উঠে এসেছে বই এর ‘অবরুদ্ধ দেশের জীবনযাত্রা’ অধ্যায়ে’। বিজ্ঞানী রেজাউর রহমান চাকরি করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পাশেই অবস্থিত আনবিক শক্তি কমিশনের অফসে। কিন্তু তাকে আসা যাওয়া করতে হতো কাপাসিয়ার গহীন এক গ্রাম থেকে। নিরাপত্তাজনিত কারণে সেখানে তিনি রেখেছিলেন তার মা এবং ছয় বোনকে। অনেক সময়ে অফিস শেষ করে যেতে পারতেন না। থেকে যেতেন ঢাকার কোন আত্মীয় স্বজনের বাসায়। তবে মাসের প্রথম দিন বেতন পেয়ে তিনি কোন বিকল্প ভাবতে পারতেন না। যেহেতু গ্রামের বাজার হাট সব বন্ধ ছিল, তাকে ঢাকা থেকেই এক মাসের বাজার করে নিয়ে যেতে হত যা পরবর্তীতে তার নিজের কাছেই কল্পনাতীত মনে হয়েছিল যদিও তা তিনি দিব্যি করে গিয়েছেন যুদ্ধকালীন সময়ে। এই পুরো মাসের বাজার করে গহীন গ্রামে তা নিয়ে যাওয়াটাও তার কাছে মনে হয়েছিল এক ধরণের মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের চোখ রাঙ্গানির মধ্যে দিয়ে মানুষের এ ধরণের প্রতিদিনের প্রতিকূল গল্পের প্রতিলিপি হল ‘একাত্তরের সামাজিক ইতিহাস : প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান’। বই এর প্রাক কথায় লেখক একাত্তরের সামাজিক ইতিহাসকে সংজ্ঞায়ন করতে গিয়ে বলেছেন-
সামাজিক ইতিহাস কোন এক বীরের বীরত্বগাথা নয়, কোন বাহীনির চমৎকার অভিযানের বর্ণনা নয় অথবা কোন রাজনৈতিক দলের অর্জনের দলিলও নয়। এ ইতিহাস সাধারণ মানুষের দিনযাপনের ইতিহাস, প্রতিদিনের প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে টিকে থাকার আর স্বপ্নটাকে টিকিয়ে রাখার ইতিহাস।
বইটিতে বেশিরভাগ ঘটনাপ্রবাহ ব্যক্ত হয়েছে ব্যক্তিবিশেষের অভিজ্ঞতার আলোকে। তবে কিছু ঘটনাপ্রবাহ ছিল যা ব্যক্তিবিশেষের বয়ান থেকে প্রতিনিধিত্ব করেছে কোন নির্দিষ্ট এলাকাকে। যেমন গাইবান্ধার কথা, শরণখোলার কথা, বরগুনার কথা শিরোনামে বইটিতে অধ্যায় রয়েছে। তবে সবক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহ ঐ অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং সংযুক্ত হতে পেরেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা শরণার্থী অর্থনীতির সঙ্গে। ‘যুদ্ধ মানুষকে অমানুষ করে’ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে ‘কক্সবাজারের কথা’ যেখানে জানা যায় মায়ানমারের সীমান্ত নিকর্টবর্তী হলেও কক্সবাজারের মানুষ মায়ানমার সীমান্ত অভিমুখী হবার উৎসাহ পায়নি। পাকিস্তানের পক্ষে মায়ানমারের নীরব সমর্থন থাকায় সেদেশে হয়নি কোন শরণার্থী ক্যাম্প। আবার ‘এক শিশু শরণার্থীর বয়ান’ অধ্যায়ে সেই শিশুটির বয়ানেই ইঙ্গিত দিয়েছেন শরণার্থীর অর্থনীতির দিকে যেখানে শিশুটির বড় ভাই শরণার্থী ক্যাম্পের ভেতরেই একটি দোকান দিতে সমর্থ হয় আর তার বাবা দোকানের জন্য নানা মালপত্র এনে দিতে থাকে।
যুদ্ধকালীন সমাজে মানুষের শরণার্থী হওয়া, শহর ছেড়ে মানুষের গ্রামে চলে যাওয়া এবং গ্রাম থেকে শহরের চলে আসার বিষয়গুলো ঘুরে ফিরে এসেছে। পাঠক হিসেবে মনোযোগ দিতে গিয়ে প্রথমে মনে হয়েছিল এই ধরণের অভিপ্রয়ান (migration) এর গল্পগুলো , যেমন শহর থেকে গ্রামে অভিপ্রয়াণ (urban to rural migration), গ্রাম থেকে শহরে অভিপ্রয়াণ (ruran to urban migration), বা বাংলাদেশ থেকে ভারতে মাইগ্রেট করে মানুষের শরনার্থী বা রিফিউজি হয়ে যাওয়ার বিষয়গুলো সময়ানুক্রমিকভাবে choronologically) উপস্থাপন প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বইটি শেষ করে মনে হল যুদ্ধের কারণে যুদ্ধকালীন শহুরে ও গ্রামীন উভয় সমাজেই মানুষের মোবিলিটি ছন্দ (mobility pattern) এক ধরণের অস্থিরতায় ছেয়ে গিয়েছিল। সেই অস্থিরতা অভিপ্রয়াণের মাধ্যমে চলে গিয়েছিল শরণারথী শিবির পর্যন্ত যেখানে, লেখকের ভাষায়, শিশুদের শৈশব সীমিত হয়ে গিয়েছিল রেশনের লাইনে। লেখক সম্ভবত এই অস্থিরতা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন নির্দয়ভাবে তাই যুদ্ধকালীন অস্থিরতাকে প্রতিনিধিত্ব করা বয়ানগুলো যেভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে তা সময়ানুক্রমিক না হলেও সুসংহত অবশ্যই।
ব্যক্তি অভিজ্ঞতার আলোকে এই বইয়ের বয়ানগুলো অভিপ্রয়াণের পাশাপাশি আলোড়ন ঘটিয়ে গিয়েছে যুদ্ধকালীন সময়ে নারীদের স্বাতন্ত্র্য সংগ্রাম থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের অবমূল্যায়ন করার ঘটনা পর্যন্ত। ‘যারা জীবনের স্পন্দন টিকিয়ে রেখেছিল’ অধ্যায় দিয়ে শুরু হওয়া বইটিতে প্রথমেই বলা হয়েছে বাগেরহাটের কিছু নারীদের নারিকেলের কাঁচা ডালের রস থেকে লবণের বিকল্প আবিস্কারের কথা। যুদ্ধের আগের বছরই দেশের উপকূলকে লণ্ডভণ্ড করে দেয় ঘূর্ণীঝড় গোর্কি আর তারপর চেপে বসে যুদ্ধ যা ত্বরান্বীত করে দেশের লবণসংকটকে। লেখকের ভাষায়, দেশের লবণসংকটে নারীদের সেই লবণের বিকল্প আবিস্কার দেশব্যাপী ছড়িয়ে যায় কোন কমিউনিকেশন কন্স্যালট্যান্ট প্রদত্ত স্ট্র্যাটেজী ছাড়াই যা থেকে এই দেশের মানুষের সৃজনশীলতার শক্তির জায়গা উপলব্ধি করা যেতে পারে।
বইটি পড়ে মনে হতে পারে এখানে একাত্তরের যুদ্ধকালীন সময়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার বয়ানগুলো সন্নিবেশিত হয়েছে কেস আকারে। কেস স্টাডিজ (Case studies) বা ঘটনা পর্যালোচনা সামাজিক গবেষণার একটি জনপ্রিয় গুণগত গবেষণা পদ্ধতি qualitative research methodology যা বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ঘটনা অনুসন্ধান করে থাকে। তবে এই বইয়ে কেসগুলো উপস্থাপনের মধ্যেই সীমিতি। বইয়ের প্রাক-কথায় বলা হয়েছে একটি সাপ্তাহিকের আহ্বানে ২০১১-১২ সালে এই সামাজিক ইতিহাস সংকলনের উদ্যোগ নেয়া হয় যেখানে পাঠকদেরও আহ্বান করা হয় লেখা পাঠানোর জন্য। ফলে এই বইটি কোনো গবেষণা প্রকল্প নয় কিন্তু পাঠকদের অংশগ্রহণ থেকে উচ্চারিত ঘটনাগুলো একাত্তর নিয়ে ভবিষ্যতের যেকোনো সামাজিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে।
লেখক : সাদরিল শাহজাহান
Sadril41@gmail.com
বইয়ের নাম : একাত্তরের সামাজিক ইতিহাস: প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান
লেখকের নাম : গওহর নাইম ওয়ারা
মূল্য : ৩৬০ টাকা
প্রকাশনী : প্রথমা
বিষয় : প্রবন্ধ সংকলন