স্বরোচিষ সরকারের ‘বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর চর্চা’

২০০৪ সালে বিবিসি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০জন বাঙালি নির্বাচন করার উদ্দেশ্যে মাসব্যাপী এক জরিপ পরিচালনা করে। নির্বাচিত শীর্ষ বাঙালির তালিকায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবস্থান ছিল অষ্টম। অবশ্য, এই জরিপ ফলাফল বিদ্যাসাগরকে তাঁর কর্মের চেয়ে মহীয়ান করে না কারণ বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ, বৃদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং বাংলা ভাষার আধুনিক গড়নের সঙ্গে বিদ্যাসাগরের কর্ম মিশে আছে। তবে, ১৯৭১-এ জন্ম নেওয়া বাংলাদেশের সাথে ১৮৯১-এ প্রয়াত বিদ্যাসাগরের সম্পর্ক সৃষ্টি কতটা যৌক্তিক, পাঠকের মনে এমন প্রশ্ন উত্থাপন করে বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর চর্চা বইটি অভিনব গবেষণা ধারণার অবতারণা করে।
বইটির মুখবন্ধের প্রথম দুটি বাক্য বাংলাদেশ ও বিদ্যাসাগরের সম্পর্কের মূলসূত্রটি উম্মোচিত করে পাঠকের পাঠ-পূর্ব প্রশ্ন ও প্রত্যাশার ধুম্রজাল মিলিয়ে দেয়, “ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মসূত্রে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের লোক নন। তবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যে তিনি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।” এই দুই বাক্য স্পষ্ট করে দেয় বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর চর্চার প্রয়োজনীয়তার কথা এবং পরবর্তী পাঁচ-ছয় বাক্যে পাঠক পুরো বইটির একটি সারসংক্ষেপ পেয়ে যান। এমন ঋজু নির্মেদ উপস্থাপন শৈলী ন্যুনতম কথায় পাঠকের কাছে লেখকের বক্তব্য উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে এক শক্তিশালী অস্ত্র। বইটি মূলত ৫টি প্রবন্ধের সংকলন। প্রবন্ধগুলির মধ্যে তিনটি – ‘বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর চর্চা‘, ‘বাংলাদেশে বিদ্যাসাগরের উত্তরাধিকার‘ ও ‘বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর‘ – সরাসরি বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর চর্চার বিষয়টি তুলে ধরেছে। অন্য দুটি প্রবন্ধ – ‘আভিধানিক বিদ্যাসাগর’ ও ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণবিন্যাস বর্ণসংস্কার ও বর্ণানুক্রম’ – কিছুটা দূরকল্পিত মনে হলেও, এখানেও বাংলাদেশে বিদ্যাসাগরের প্রাসঙ্গিকতার বিষয়টি উঠে এসেছে।
“ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মসূত্রে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের লোক নন। তবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যে তিনি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।”
বিদ্যাসাগরের প্রতি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের একাংশের অভিযোগ ছিল যে তিনি বাংলাকে সংস্কৃতায়নের কঠিন শেকলে আবদ্ধ করিয়েছেন। কিন্তু ‘আভিধানিক বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে বিদ্যাসাগরের প্রায় অনালোচিত দুই অভিধান বিশ্লেষণের সময় বিস্ফোরক তথ্যের মুখোমুখি হতে হয়। অসমাপ্ত অভিধান শব্দমঞ্জরি ও অপ্রকাশিত পা্ণ্ডুলিপি “শব্দসংগ্রহ” বিদ্যাসাগরের অভিধানচর্চার উদাহরণ। অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিটির ৭০৭১ শব্দের মধ্যে আরবি-ফারসি শব্দের সংখ্যা ১১৯৬ যা শতকরা হিসেবে প্রায় ১৭ ভাগ। অথচ সমকালের মুসলমান লেখকদের মধ্যে আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগে এগিয়ে থাকা প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখায় ও অন্যান্য মুসলিম লেখকদের লেখায় এর শতকরা হার ছিল যথাক্রমে সাত ও তিন ভাগ। স্বরোচিষ সরকার এক্ষেত্রে যথার্থই মন্তব্য করছেন যে, তৎসম ও আরবি-ফারসি বিষয়ে সমকালের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্ব থেকে বাংলা গদ্যকে মুক্তির পথ দেখানোর জন্যই বিদ্যাসাগর হয়েছেন বাংলা গদ্যের জনক। তবে বিদ্যাসাগর নিজ গদ্য চর্চার ক্ষেত্রে কেন শব্দমঞ্জরি-র সংস্কৃতনির্ভরতায় আটকে থাকলেন, তার লেখায় কেন নিজ পাণ্ডুলিপি “শব্দসংগ্রহ”-এর প্রভাব পরিস্ফুট হলো না, এ বিষয়টির ব্যাখ্যা আমরা পাই না। মূলত বিদ্যাসাগর ছিলেন সমন্বয়বাদী ও আধুনিক। ১৯৯২ সালে বাংলা একোডেমি গৃহীত প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম যে বহুলাংশে বিদ্যাসাগরের অপ্রকাশিত অভিধানে কার্যরত বুদ্ধিমত্তার উত্তরাধিকারী, তা বোঝা যায়। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রচলিত জনপ্রিয় অভিধানগুলো যে প্রয়োগবাক্য ব্যবহারে বিদ্যাসগরের সমকক্ষ এখনো হতে পারেনি, এ বিষয়টির প্রতি লেখক নির্দেশ করেছেন। বাংলাদেশে বর্ণমালার প্রসঙ্গ আসলেই বিদ্যাসাগরের শিশুপাঠ্য বর্ণতালিকার ঐতিহ্য মনে আসে। বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণমালার ক্ষেত্রে কিছু ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণবিন্যাস বর্ণসংস্কার ও বর্ণানুক্রম’ প্রবন্ধে উদাহরণগুলি পাই: ঋ, ৯৯ এবং ক্ষ বর্ণকে বর্ণমালা থেকে বাদ দেওয়া; ড়, ঢ়, য়, ৎ এবং চন্দ্রবিন্দুকে অন্তর্ভুক্ত করা। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী কম্পিউটারে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে ইউনিকোডে বাংলা বর্ণের ড়, ঢ় এবং য় এর জন্য বাংলাদেশের প্রস্তাব হলো তিনটিকেই স্বতন্ত্র বর্ণ হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, যেখানে বিকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে ড, ঢ এবং য এর নিচে নোক্তা ব্যবহার করা। বাংলাদেশের প্রস্তাবের পেছনে বিদ্যাসাগরের প্রেরণার কথাটি লেখক অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করছেন।
বইটির অন্য তিন প্রবন্ধে বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর চর্চার প্রকৃতি ও উত্তরাধিকারের অলিগলির খোঁজ মেলে। স্বাধীন বাংলাদেশে ৯০ এর দশকে এসে বিদ্যাসাগর চর্চায় যে গতি পায়, তার বিস্তারিত বিবরণ আমরা দেখতে পাই প্রথম প্রবন্ধে। লেখকের তথ্যসূত্রে দেখা যায়, ১৯৭২ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধ সংখ্যা মাত্র ৮টি। অথচ, কেবল ৯০ এর দশকে তা বৃদ্ধি পেয়ে সংখ্যায় ৪০ ছাড়িয়ে যায়। এর পেছনের কারণ হিসেবে লেখক বিদ্যাসাগরের ১০০ম মৃত্যুবর্ষ হিসেবে ১৯৯১ সালের উপস্থিতির কথা উল্লেখ করছেন। এখানে স্মর্তব্য, ইতোপূর্বে ১৯৭০ সালে বিদ্যাসাগরের দেড়শোতম মৃত্যুবার্ষিকীতে অধ্যাপক গোলাম মুর্শিদ সম্পাদিত ‘বিদ্যাসাগর’ নামের স্মারকগ্রন্থ বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। আর, পাকিস্তান পর্যায়ে বিদ্যাসাগর চর্চার পরিবেশ যে অনুপস্থিত ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই কারণ তখন এমনকি রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত খারিজ করার প্রস্তাব উত্থাপিত হতো।
তাহলে প্রশ্ন আসে, বিদ্যাসাগরকে কি কেবল তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণের মাধমেই বাংলাদেশে তার চর্চা করা হয়? আমি মনে করি, এই প্রশ্নের পেছনের ব্যাখ্যাটিই যেন বইটির সবকটি প্রবন্ধকে একসূত্রে গেঁথেছে। ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর চর্চাকে লেখক দ্বিজাতিতত্ত্ব ও ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনৈতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাবে প্রভাবান্বিত পাকিস্তান পর্ব, বাংলাদেশের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে যেমন ভাগ করেছেন, তেমনি বিদ্যাসাগরকে বাংলাদেশের বাঙালির ভাষানির্মাতার ও সংস্কারকের মর্যাদা দিয়েছেন।
দ্বিজাতিতত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যাসাগরকে সম্পর্কিত করার বিষয়টি প্রথমে আরোপিত মনে হতে পারে; কিন্তু বইটি পড়লে এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ১৯৪৯ সালে সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের মন্তব্যে দেখি: “ইসলামী তমদ্দুনের নামগন্ধ বর্জিত বঙ্কিমী-বিদ্যাসাগরী ভাষা পাকিস্তানের তরুণ শিক্ষার্থীরা শিখিবে ইহার চাইতে পরিতাপের বিষয় আর কি হইতে পারে।” স্বাভাবিকভাবে, পাকিস্তান পর্বে বিদ্যাসাগর চর্চা ছিল একান্তই উদ্যোগী, সাহসী বুদ্ধিজীবি নির্ভর এবং উল্লেখযোগ্য উদাহরণটি হলো গোলাম মুর্শিদ সম্পাদিত ‘বিদ্যাসাগর’ নামের স্মারকগ্রন্থ যা পশ্চিমবঙ্গেও খুবই সমাদৃত হয়েছিল কারণ বিদ্যাসাগরের দেড়শোতম মৃত্যুবার্ষিকীতে পশ্চিমবঙ্গে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রকাশনা হয়নি। এ প্রসঙ্গে বইটি থেকে আমরা জানতে পারি যে, স্মারকগ্রন্থের লেখক ও সম্পাদক তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দাদের নিকট তালিকাভুক্ত হন। দ্বিজাতিতত্ত্বের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক ভুত যে তখন কতটা সক্রিয় ছিল, তা বিদ্যাসাগর চর্চার এই একটি উদাহরণ থেকে স্পষ্ট হয়ে পড়ে। দ্বিজাতিতত্ত্বের এই ভূত বাংলাদেশে এসেও লুপ্ত হয় না; ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে তা চলমান থাকে। এ কারণে ৮০-এর দশকে ও ৯০-এর প্রথমার্ধে পাঠ্যবইয়ে বিদ্যাসাগরের উপস্থিতি ও বাংলা ভাষার নির্মাণে তার অবদানের কথা ক্ষীয়মান হয়ে থাকে। বাংলাদেশ প্রথম পর্বে বদরুদ্দিন উমরের বিদ্যাসাগর বিষয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচকতায় পরিবর্তিত হওয়ার বিষয়টি বেশ গুরুত্ব নিয়ে উচ্চারিত হয়েছে। উমর ৬০ এর দশকে বিদ্যাসাগরকে কৃষকের শ্রেণিশত্রু হিসেবে দেখলেও ১৯৭৪ সালে তাঁকে এক পরিপূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে অনুধাবন করেন। এরপর দ্বিতীয় পর্বে ৯০ এর দশকে বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর চর্চায় যে গতি পায় সেটি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিদ্যাসাগর বাংলাদেশে কখনো সরাসরি, সোজাসাপ্টাভাবে জাতীয় বা দার্শনিক-সাংস্কৃতিক ভিত্তির ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্বীকৃত হয়নি। তবে বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা এবং দ্বিজাতিতাত্ত্বিক পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের প্রসঙ্গগুলির মাঝে বিদ্যাসাগরের ভাষাতাত্বিক ও সংস্কারচেতনাভিত্তিক উত্তরাধিকার নিহিত আছে। বিদ্যাসাগরের আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমাজের যাবতীয় সংষ্কারকে বিচার করতে পারলে বাংলাদেশের উন্নয়ন আরো গতি পাবে, একথা নিশ্চিত।
পরবর্তী সংস্করণে পাঠক প্রত্যাশা করতে পারেন যে, বইটিতে একটি পরিশিষ্ট যোগ হবে এবং সেখানে বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর চর্চার উদাহরণগুলি একত্রিত হবে। তাহলে যেকোনো গবেষকের জন্য সেটি এক অমূল্য রিসোর্স হবে। বইটি সাদা কাগজে না হয়ে, কিছুটা ঘিয়ে রঙের কাগজে মুদ্রিত হওয়ায়, পাঠকের চোখের জন্য আরামদায়ক হয়েছে। সঙ্গে পৃষ্ঠার মানও ভালো। বাঁধাই একই সাথে টেকসই ও পাঠবান্ধব। বইটি বাংলাভাষী পাঠকের মাঝে বিদ্যাসাগর চর্চা, অভিধান রচনা ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস পুনর্গঠনের গবেষণাকে বেগবান করবে বলে প্রত্যাশা করি।
বইয়ের নাম: বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর চর্চা
লেখক: স্বরোচিষ সরকার
প্রকাশক: মাদার্স পাবলিকেশন্স, ঢাকা
পৃষ্ঠা: ১০৪
মুদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা
হাসিনুল ইসলাম : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি, সরকারি নজরুল কলেজ, গোপালগঞ্জ