পাতা উল্টাই : ত্রিকালদর্শী এক দার্শনিক-শিক্ষাবিদের অবিস্মরণীয় মহাকীর্তি

পাতা উল্টাই বাংলাদেশের বিশিষ্ট দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন (১৯৩৬-২০১০)-এর আত্মজৈবনিক গ্রন্থ। নিভৃতচারী এই লেখকের সুদীর্ঘ জীবনের অসামান্য উপলব্ধির সারসংক্ষেপে এতে বিধৃত হয়েছে। নির্মোহ জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতা নিষ্ঠার সাথে উত্তরপুরুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার এ এক অপূর্ব নিদর্শন। ক্ষুদ্রাকার এ মহাগ্রন্থে অধ্যায়সংখ্যা ঊনিশ: ১. যে কারণে এই লেখা, ২. নিজের কথা বলার ইতি-নেতি, ৩. নিজে নিজের মুখোমুখি, ৪. প্রয়াত প্রিয়জনের প্রতি শ্রদ্ধা, ৫. আমার প্রয়াত পিতা এখন মহাজাগতিক মানুষ, ৬. কত ছোটবেলার কথা, ৭. আমার স্কুলজীবনের প্রথম দিন, ৮. মামা-বাড়ি ও মামু ভাগিনার গল্প, ৯. চল্লিশের দশকের ঢাকায়, ১০. ঢাকা থেকে দিনাজপুর, ১১. দিনাজপুরের মুখ, ১২. প্রয়াত পিতার ডায়েরি, ১৩. একাত্তর এগিয়ে আসছে, ১৪. খণ্ডচিত্র একাত্তর, ১৫. ময়মনসিংহের মুখ, ১৬. বিক্ষিপ্ত স্মৃতি, ১৭. স্মৃতির মানুষ, ১৮. জীবনসূত্র ও ১৯. কথা সাঙ্গ। গ্রন্থের প্রথমে আছে ব্যক্তিগত পরিচয় ও আত্মীয়তার সূত্রে জেগে ওঠা দার্শনিক জিজ্ঞাসা ও জবাব দানের চেষ্টা। জীবনপ্রবাহের সূত্রে বিভিন্ন স্থানে পরিভ্রমণের স্মৃতি, স্থানিক দৃশ্য, পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশের চুম্বক অংশের বর্ণনা, সংশ্লিষ্ট এলাকার আর্থসামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অবস্থার পর্যবেক্ষণ, বৈশিষ্ট্য চিহ্নিতকরণ এবং জনপদের ত্যাগী ও মানবিক বোধসম্পন্ন রুচিবান মানুষদের অস্তিত্ব আবিষ্কারের অন্তরঙ্গ বর্ণনা আছে গ্রন্থের মধ্যভাগে। আছে জাতীয় জীবনের অস্তিত্ব প্রকাশক ঐতিহাসিক পরিস্থিতির বিশ্লেষণ। গ্রন্থের শেষাংশে লেখকের দার্শনিক উপলব্ধি এবং মূল্যায়ন সূত্রাকারে উপস্থাপিত হয়েছে।
অধ্যাপক মোজাফফর হোসেনের দাদার বাবা ২২ গ্রামের মসজিদের ইমাম, পিতা পুলিশ বিভাগের ইন্টেলিজেন্স অফিসার। বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী ও ঢাকায় তাঁর কর্মজীবন অতিবাহিত হয়। প্রয়াত পিতার ডায়েরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে তিনি ভাবেন, বিজলী বাতিবিহীন ঘরে হারিকেনের স্বল্প আলোয় কতটা নিষ্ঠার সাথে তাঁর বাবা কাজ করতেন। যে পিতা আজীবন সততার সাথে মিতব্যয়ী, সুশৃঙ্খল ও সংগ্রামী জীবন যাপন করেছেন, যিনি নিজের কাজ নিজেই করতেন, সঙ্গীতের প্রতি যার ছিল গভীর অনুরাগ এবং শিষ্টাচার ছিল যার আমৃত্যু সঙ্গী। তিনি সন্তানদের সৎ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। অতি কষ্টে তাদের সাত ভাইবোনকে লেখাপড়া শিখিয়ে উদার ও মানবতার সেবায় দীক্ষিত মানুষ করেছেন, সাধ্যমতো প্রগতিশীল মানুষদের সহায়তা করার চেষ্টা করেছেন! পিতার নিষ্ঠাবোধ বাসা বাঁধে তাঁর মনে। তিনি অসুস্থ মাকে সহায়তার জন্য শিখে নেন রান্নাঘরের অনেক কাজ। ১৯৬৭ সালের ৫ এপ্রিল পিতার মৃত্যুর পর মা সংসারের হাল ধরেন, দুই বোনকে পাত্রস্থ করেন এবং ১৯৯৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।
অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন মনে করতেন, পূর্বপুরুষকে শ্রদ্ধা দেখানোর প্রকৃষ্ট উপায়, তাঁদের সত্তাকে নিজের মধ্যে গ্রহণ করে নিজেকে ঋদ্ধ করা। তাঁর মতে একজন প্রয়াত মানুষ হলো কসমিক মানুষ, কারণ মৃত্যুর পর তার দেহের অণু-পরমাণু মহাজগতের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়, এমনকি তা তরুলতা ও পশুপাখির দেহের অংশ হয়ে যায়, তাহলে মানুষের সাথে জীবজগতের তফাত কোথায়? তাই প্রতিটি মানুষের উচিত তার পারিপার্শ্বিক উদ্ভিদ, প্রাণীকূল তথা প্রকৃতির প্রতিটি সদস্যের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। এভাবেই সনাতন অথচ স্বতন্ত্র এক আধুনিক মূল্যবোধের অধিকারী হওয়ার পথের দিশারী হয়েছিলেন অধ্যাপক হোসেন।
চল্লিশের দশকের ঢাকা প্রসঙ্গে লেখক মূলত তাঁর ১৯৪৬-১৯৪৭ সময়কালে ব্রিটিশ আমলের ঢাকায় অবস্থানের স্মৃতি তুলে ধরেন। বাবার চাকরিসূত্রে তাঁরা তখন সূত্রাপুর থানার বাসিন্দা, তিনি নিজে জুবিলি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। বিশেষ করে ১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-বিক্ষুব্ধ এক শ্বাসরুদ্ধকর সময়ের মর্মস্পর্শী বর্ণনা উঠে এসেছে তাঁর লেখায়:
আমরা স্কুলে যাই না। যাব কোন সাহসে? দাঙ্গার চরম দিনগুলোতে শহরে থাকে ১৪৪ ধারা। চার-পাঁচজন লোক একসাথে রাস্তায় চলে না। পথে পথে তল্লাশি ছুরি, চাকু বা কোন মারণাস্ত্র আছে কি না। এমন সময় স্কুলগুলো সব এমনিতেই বন্ধ হয়ে যেতো। কোনো কোনো সময় উপরের ক্লাসের মুসলিম লীগের কিছু কিছু ছাত্র নেতা এসে মুসলমান ছাত্রদের আলাদা করে বাড়ি চলে যাওয়ার নির্দেশ দিতেন। এতে করে সেই ছোট সময়েই শিশুদের মনেও ধর্মীয় বিভেদ-চেতনা জন্মলাভ করে। … সে কী এক অস্বাভাবিক উন্মাদনা, বিকারগ্রস্ত মানসিকতার যুগ ছিল, যখন হাফপ্যান্ট পরা ছেলেরাও কথায় কথায় চাকু বের করতো। অন্তরঙ্গ খেলার সাথী ও বন্ধু মুহূর্তেই হয়ে উঠতো হিন্দু বা মুসলমান (পৃ. ৩০-৩১)।
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন মন্তব্য করেন, ধর্মীয় জাতীয়তার মোহ সেদিন পেয়ে বসেছিল ঐ সব ছোট ছোট ছেলেদেরও। মোহমুক্তি ঘটতে সময় লেগেছিল দুই যুগ। সা¤প্রতিক সময়ের প্রবণতা লক্ষ্য করে তিনি লিখেছেন, সেই ধর্মীয় জাতীয়তার মদটা আবার খানিক গিলিয়ে দেবার লোকেরও অভাব নাই। এখন ৪৭-এর মতো আবারো অনেকে রাজা উজির হবার আকাঙ্ক্ষা রাখে। এটাই তাদের রাজনীতি – রাজা হওয়ার নীতি। এভাবেই তিনি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বর্ণনার পাশাপাশি তাঁর সমাজ ও দর্শনকে আমাদের সাথে ক্রমান্বয়ে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকেন। তিনি লেখেন,
দাঙ্গাপূর্ব সময়ে মুসলমানেরা ভদ্র পোশাক হিসেবে ধুতি পরতো। হিন্দুরা লুঙ্গি পরতো না। দাঙ্গার সময়ে ধুতি লুঙ্গি পরে বাইরে যাওয়া কঠিন হয়ে গেল। কারণ ওতে উভয়েরই ধর্ম পরিচয় প্রকাশিত হওয়ার ভয় দেখা দিল, কখন কাপড় খুলে দেখাতে হয়! এমন অবস্থায় দেশে এলো বিজাতীয় পোশাক ফুলপ্যান্ট পরার চল। সেই থেকে বাংলায় ফুলপ্যান্ট পরার চল দেশভাগের পরেও (পৃ. ৩৬)।
এখানে আমরা লেখকের মনের দীর্ঘশ্বাস স্পষ্ট শুনতে পাই। তিনি যেন লেখনীর মাধ্যমে আমাদের বলছেন, দেখো কীভাবে আমাদের নিজেদের সংস্কৃতি, আচার, পোশাক, কৃষ্টি একে একে বিলুপ্ত হয় ব্রিটিশ ঔনিবেশিক ভেদনীতি ও বিদেশিদের উস্কে দেওয়া সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে। আমাদের ওপর বিদেশীদের চাপিয়ে দেয়া এই অপসংস্কৃতির ধারাবাহিকতা কতটা প্রবল ও মর্মন্তুদ হয়েছিল, তার প্রমাণ আমরা আরো একবার দেখেছি ১৯৭১ সালে, জীবন বাঁচাতে বর্বর পাকিস্তানি সৈনিকদের আরো একবার কাপড় খুলে দেখাতে হয়েছে আমাদের!
এখানে আমরা লেখকের মনের দীর্ঘশ্বাস স্পষ্ট শুনতে পাই। তিনি যেন লেখনীর মাধ্যমে আমাদের বলছেন, দেখো কীভাবে আমাদের নিজেদের সংস্কৃতি, আচার, পোশাক, কৃষ্টি একে একে বিলুপ্ত হয় ব্রিটিশ ঔনিবেশিক ভেদনীতি ও বিদেশিদের উস্কে দেওয়া সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে। আমাদের ওপর বিদেশীদের চাপিয়ে দেয়া এই অপসংস্কৃতির ধারাবাহিকতা কতটা প্রবল ও মর্মন্তুদ হয়েছিল, তার প্রমাণ আমরা আরো একবার দেখেছি ১৯৭১ সালে, জীবন বাঁচাতে বর্বর পাকিস্তানি সৈনিকদের আরো একবার কাপড় খুলে দেখাতে হয়েছে আমাদের!
অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন পিতার ও নিজের কর্মসূত্রে বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহে কাটিয়েছেন জীবনের অধিকাংশ সময়। বিশেষ করে দিনাজপুর যেন তাঁর প্রথম প্রেম বা স্বপ্নভূমি – ১৯৫৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রায় সিকি শতাব্দী যেখানে অতিবাহিত করেছেন। লেখনীতে তাই দিনাজপুর উঠে এসেছে রূপ-যৌবন আদ্যপান্তসহ। তিনি কৈলাশরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। দিনাজপুর কলেজে কিছুকাল অধ্যয়ন এবং সুরেন্দ্র কলেজে অধ্যাপনার সূত্রে প্রায় দুই দশক পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বকালীন সময়, যুদ্ধাবস্থার প্রাথমিক দিনগুলি এবং যুদ্ধপরবর্তী অবস্থা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। তাই দিনাজপুরের স্মৃতি সততই তাঁর কাছে অবিস্মরণীয়।
পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকে দিনাজপুর শহরের অবস্থা, কাটারিভোগ চালের সুখ্যাতি, ভূমিনির্ভর সামন্ত অর্থনীতি, খাদ্যাভ্যাস, অধিবাসীদের মনোভাব, শিক্ষাদীক্ষা, সংস্কৃতিচর্চা, উৎসব, ধমীয় পুজোপার্বণ, শহরের পাঠাগার, সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগ, পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর আক্রমণ, বিহারি সম্প্রদায়ের নিম্নমানের আচরণ ও সংস্কৃতি, সহকর্মী ও সমমনাদের সাথে সৃজনশীল আড্ডা, পড়াশুনা, পাক্ষিক কাঞ্চন পত্রিকা, হা-হুতাশ সমিতি- ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় স্থান পেয়েছে আলোচনায়। তবে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয় হলো গ্রন্থের পুরোভাগ জুড়ে রয়েছে দিনাজপুর শহরের অগ্রসর চিন্তাচেতনার ব্যক্তি, তাদের চিন্তাচেতনার ধরণ, আবেগ, অনুভূতি, অভ্যাস, কাজ ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা।
বাংলাদেশের গর্ব, প্রাচ্যের বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, হিমাংসু ঘোষ, কমরেড গুরুদাস তালুকদার, অধ্যাপক ব্রজেন্দ্রনাথ দাস, নাট্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রাজেন তরফদার, অনুভা গুপ্ত, বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ও মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্র পাঠক অধ্যাপক ইউসুফ আলী, খান বাহাদুর আমিনুল হক অসংখ্য বরেণ্য ব্যক্তির সম্পর্কে আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে গ্রন্থটিতে (পৃ. ৩৭-৪৫)।
বাংলাদেশের গর্ব, প্রাচ্যের বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক ও শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, হিমাংসু ঘোষ, কমরেড গুরুদাস তালুকদার, অধ্যাপক ব্রজেন্দ্রনাথ দাস, নাট্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রাজেন তরফদার, অনুভা গুপ্ত, বাংলাদেশ সরকারের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী ও মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্র পাঠক অধ্যাপক ইউসুফ আলী, খান বাহাদুর আমিনুল হক অসংখ্য বরেণ্য ব্যক্তির সম্পর্কে আলোচনা উপস্থাপিত হয়েছে গ্রন্থটিতে (পৃ. ৩৭-৪৫)।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ দু’টি অধ্যায় আছে গ্রন্থটিতে। প্রথমটিতে একাত্তরের ঠিক আগে আগে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের আক্রমণাত্মক মনোভঙ্গির উদ্ধত প্রকাশ লক্ষ করা গেছে টুপি-দাড়ি-আলখাল্লাওয়ালা কয়েকজন ট্রেনযাত্রীর মুখে। তারা ট্রেনের কামরায় প্রকাশ্যে বয়ান করছেন, ‘মহান আল্লাহতালা বলেছেন, মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা করবা, তাদেরকে বন্দি করবা, অবরুদ্ধ করবা এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাদের লেইগা ওঁৎ পাইত্যা থাকবা (পৃ. ৪৮)।’
আমরা পরবর্তীতে দেখেছি, এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীই মুক্তিযুদ্ধের সময় পুরো একাত্তর সাল জুড়ে সারাদেশে মুশরিক, কাফের আখ্যা দিয়ে দেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর গণহত্যা, লুটতরাজ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ চালিয়েছিল বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী হয়ে। তারা ঘাতকের বেশে বাঙালি নিধনের উদ্দেশ্যে অন্ধকারে ওঁৎ পেতে বসে থেকেছে; রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নক্সা বাস্তবায়ন করেছে ঠাণ্ডা মাথায়।
এ গ্রন্থের ‘খণ্ডচিত্র একাত্তর’ শীর্ষক অধ্যায়টি (পৃ. ৫১-৬৪) নানা কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য সাধারণ দলিল হিসেবে পরিগণিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। অধ্যায়টিতে আছে ৫টি উপ-অধ্যায়। প্রথমে বর্ণনা করা হয়েছে দিনাজপুর শহরের ২৫শে মার্চ পরবর্তী ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা, গোলাগুলির আওয়াজ, টহলদার সেনাদের বুটের আওয়াজ, পরিবার ও পরিজন নিয়ে ভয়াল ও ভয়ার্ত রাত্রিযাপন, ছাত্র-জনতা-পুলিশ-ইপিআরের প্রথমে স্বতঃস্ফূর্ত ও পরে সংগঠিত যুদ্ধ এবং একসময় পরিবারের নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে শরণার্থী হওয়ার প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে।
লেখক গুরুত্বের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে শরণার্থী হিসেবে পশ্চিম দিনাজপুর ও মালদহ জেলায় অবস্থান, ভাদু নামের এক সিপিএম কর্মীর বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ এবং ভাদু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অপরিসীম ত্যাগ স্বীকারের কথা আলোচনা করেছেন। ভাদু প্রায় নিরক্ষর ও নিঃস্ব এক মেহনতি মানুষ। তার মানবতাবাদী চেতনা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন এবং জীবন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি লেখককে বিমুগ্ধ করেছে। ভাদু চরিত্রের সংবেদনশীলতার চরম প্রকাশ ঘটে কালিয়াচকে ভাদুর বাড়িতে বসবাসের পাট চুকিয়ে লেখক যখন সপরিবারে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হন, সেই মুহূর্তে।
ভাদু লেখককে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে এবং বলে, ‘তোমাদেরকে আশ্রয় দেওয়াই আছিল তোমাদের জন্য হামার মুক্তিযুদ্ধ (পৃ. ৫৪)।’ একজন দরিদ্র অথচ ধনী ভাদু চরিত্রের মাধ্যমে লেখক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের মানুষের নৈতিক ও সক্রিয় সমর্থনের অন্তরঙ্গ চিত্র অঙ্কন করেছেন।
ভাদু লেখককে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে এবং বলে, ‘তোমাদেরকে আশ্রয় দেওয়াই আছিল তোমাদের জন্য হামার মুক্তিযুদ্ধ (পৃ. ৫৪)।’ একজন দরিদ্র অথচ ধনী ভাদু চরিত্রের মাধ্যমে লেখক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের মানুষের নৈতিক ও সক্রিয় সমর্থনের অন্তরঙ্গ চিত্র অঙ্কন করেছেন।
ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মনস্তত্ত। অনুসন্ধান করতে গিয়ে লেখক দেখেছেন, ওপারের অধিকাংশ মুসলিমই তাদের বিপদের আশ্রয় পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কায় ছিল দ্বিধান্বিত। ‘জয় বাংলার মানুষ’দের প্রতি তাদের প্রশ্ন, ‘আপনারা আমাদের পাকিস্তানটা ভেঙ্গে দিলেন। একটা মাথা গোঁজার ঠাই ছিল আমাদের (পৃ. ৫৫)।’ লেখক উপলব্ধি করেছেন ভারতের সরকার ধর্মনিরপেক্ষ হলেও ওখানকার হিন্দু সম্প্রদায় ভারতীয় মুসলিমদের সঙ্গে আচার আচরণে ততটা সহজ ছিল না, যদিও তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অকুণ্ঠ সমর্থন দান করেন; কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানে সরকার সাম্প্রদায়িক হলেও জনগণ ছিল অসাম্প্রদায়িক, ফলে বাঙালিদের পক্ষে একযোগে লড়াই করা সম্ভব হয়, সকলেই সে যুদ্ধে রক্তদান করে। লেখক ভারতীয় সমাজের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং একই বিষয়ে পুরাতন ও নতুন প্রজন্মের মানুষের মানসিক পার্থক্যও প্রত্যক্ষ করেন। তিনি দেখেছেন সেখানকার নতুন প্রজন্ম অনেক উদার ও সংস্কারমুক্ত, পক্ষান্তরে পুরোনোরা সেগুলো আকড়ে ধরে থাকতেই ভালোবাসে।
লেখক প্রত্যক্ষ করেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতি বিদ্যমান, যা আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একবারে বিপরীত। পার্টি অফিস এবং পার্টিনেতাদের সাজসজ্জা অতি সাধারণ, সাধারণ মানুষের মাঝে তাদের মতো সহজ সরল জীবন যাপন করা ঐ রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তারা সবাই পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে শরণার্থীদের সহায়তার কাজে নিবেদিতপ্রাণ। তবে পার্টির নীতি আদর্শের প্রতি ঐকান্তিক ও অবিচল হলেও আচার আচরণে মুসলিম বামপন্থি রাজননৈতিক নেতা কর্মীদের মধ্যে এক অদ্ভূত বৈপরীত্যও তিনি লক্ষ্য করেন। তিনি ব্যাখ্যা করে দেখান যে সম্প্রদায়গত বঞ্চনা শিকার হয়ে মুসলিম জনসাধারণ হয়ে পড়লেন পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল, আবার শ্রেণিগত শোষণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা হলেন সমাজতন্ত্রী তথা বামপন্থি।
দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি লক্ষ্য করেছেন তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা চরম ত্যাগ স্বীকার করে দেশপ্রেমের আবেগে আপ্লুত হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁরা ঘাট এলাকায় শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন, কপট মেকি ও যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিচ্ছেন, চটের কোট ট্রাউজার পরেও মুক্তিযুদ্ধ করার গৌরবে নিজেকে ধন্য মনে করছেন। এসব দেখে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ে লেখকের মন অভিভূত হয়েছে। লেখকের কাছে গ্রামবাংলার দামাল সন্তান এসব মুক্তিযোদ্ধাকে আধুনিক মননের লোক বলে মনে হয়েছে। তাঁর মতে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে সুটেড বুটেড হয়ে চলায় কোনো আধুনিকতা নেই, আধুনিকতা থাকে মানুষের মগজে, যেমন ছিল বিদ্যাসাগরের এবং আরজ আলী মাতুব্বরের। লেখকের মনে প্রচণ্ড দুঃখ, সামপ্রতিক প্রজন্মের এক বিরাট অংশ আজ বাংলায় কথাও বলতে পারে না। তাই ক্ষুব্ধ লেখকের প্রশ্ন, আমরা আজ কোথায় আছি এবং কোন কৃষ্ণগহ্বরে যাচ্ছি? তিনি স্বীকার করেন, সত্য বটে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে আমাদের আবেগের প্রাবল্য ছিল, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকালের আবেগ সব নিঃশেষ হলে আমাদের স্বাধীনতাই কি টিকবে (?) – অত্যন্ত সঙ্গত কারণেই তিনি এ প্রশ্ন তোলেন।
১৯৭৭ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছর সরকারি আনন্দমোহন কলেজে দর্শনশাস্ত্রে অধ্যাপনার সূত্রে ময়মনসিংহে অবস্থান করেছেন অধ্যাপক মোজাফফর। স্বপ্নের শহর দিনাজপুর ছেড়ে ময়মনসিংহে আসতে মনের সায় ছিল না বিন্দুমাত্র। তবুও পদোন্নতি এবং বদলির আদেশের কারণে অনিচ্ছা সত্তে¡ও তার ময়মনসিংহে আগমন। এ শহর প্রথমে মোটেও ভালো লাগে নি। তবে ঢাকা হয়ে ময়মনসিংহ আসার পথে ট্রেনে পরিচয় ঘটে প্রবীণ কমুনিস্ট কর্মী জোতিষ বোসের সাথে, তাঁকে ভালো লেগে যায়। অপরিচিত জায়গায় এ পরিচয় নতুন স্থানে আবাসন গড়তে ভরসা যোগায়। এরই সূত্র ধরে এবং নিজের অবস্থানের মাধ্যমে ময়মনসিংহে একে একে পরিচয় ঘটে সহকর্মী অধ্যাপিকা আজিজা খাতুন ও তার পরিবার, কমিউনিস্ট কর্মী প্রদীপ বোস, সমাজকর্মী এবং রবীন্দ্র ও গণসঙ্গীত শিল্পী আলোকময় নাহা ও তার স্ত্রী সুমিতা নাহা, উদীচী পরিবারের শিল্পীবৃন্দ, ত্রিশাল কলেজের অধ্যাপক খগেশ কিরণ তালুকদার, প্রখ্যাত তাত্ত্বিক ও লেখক অধ্যাপক যতীন সরকার, বাংলাদেশ পরিষদের পরিচালক আশরাফ আলী খান, ছড়াকার অধ্যাপক প্রণব চৌধুরী, রবীন্দ্র সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ও কৃষি বিশ্বদ্যিালয়ের অধ্যাপক নূরুল আনোয়ার এবং তাঁর মাধ্যমে ছায়ানটের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী লেখক ও রবীন্দ্র সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হক, অধ্যাপক গোলাম সামদানী কোরায়শী, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোস্তফা হামিদ হোসেন প্রমুখ আলোকিত মানুষের সাথে। এ ভাবেই ময়মনসিংহ শহর ভালো লেগে যায়।
‘কোনো অঞ্চল বিশেষের অন্তর হলো তার মানুষ। মানুষ ছাড়া মাটির মূল্য নেই, মূল্যায়ন হয় না। ময়মনসিংহের মানুষ … আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা তার অহংকার। প্রদর্শনের চেয়ে সৃজনশীল ভাবনা এবং কর্মকাণ্ডেই তার আনন্দ, জীবনযাত্রায় সারল্য এবং ভাবনা-চিন্তায় স্বচ্ছতা, গভীরতা ও ঋজুতার অনুশীলনই তার অন্বিষ্ট (পৃ. ৭১)।’
যে শহর এত সমস্ত উজ্জ্বল-জোতিষ্ক কৃতী সন্তানকে বুকে ধারণ করতে পারে, সে শহরকে ভালো না লেগে পারে? তাই তিনি ব্যাখা দিয়েছেন ময়মনসিংহ প্রথম দেখে আমার ভালো লাগে নি। ওটা ছিল বাহ্যিক দেখার ফল, ইলিউশন। অন্তর দেখা বা রিয়ালিটি দেখতে আমার কিছুটা সময় লেগেছিল। তাঁর মতে, ‘কোনো অঞ্চল বিশেষের অন্তর হলো তার মানুষ। মানুষ ছাড়া মাটির মূল্য নেই, মূল্যায়ন হয় না। ময়মনসিংহের মানুষ … আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা তার অহংকার। প্রদর্শনের চেয়ে সৃজনশীল ভাবনা এবং কর্মকাণ্ডেই তার আনন্দ, জীবনযাত্রায় সারল্য এবং ভাবনা-চিন্তায় স্বচ্ছতা, গভীরতা ও ঋজুতার অনুশীলনই তার অন্বিষ্ট (পৃ. ৭১)।’
ময়মনসিংহ সম্পর্কে এর চেয়ে বড় প্রশংসাপত্র আর কী হতে পারে? এই নিরেট বয়ান ও অকাট্য যুক্তিজাল বিস্তারের মাধ্যমে ব্যক্তি অথবা স্থানের মানস-মানচিত্র ফুটিয়ে তুলতে অধ্যাপক মোজাফফর হোসেনের মতো দার্শনিক ছাড়া আর কে ভালো পারে!
‘বিক্ষিপ্ত স্মৃতি’ এ গ্রন্থের ষোড়শ অধ্যায়। এখানকার আলোচনাকে বরং ‘ব্রিটিশ ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মানচিত্রের বিবর্তন’ আখ্যা দেয়া যেতে পারে। অধ্যায়টি হারানো দিনের আধুনিকতা ও বিনোদন, কালের যাত্রা, গানের ভেলায় বেলা-অবেলায়, আমার পড়া শেখা, ‘ভাববাদ খণ্ডন’ পড়া, সেকালের চলচ্চিত্র ও ছবি দেখা এবং অর্বাচীনের সাহস – এই সাতটি উপ-অনুচ্ছেদে বিভক্ত। উপমহাদেশের ত্রিকালদর্শী দার্শনিক অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন তাঁর কৈশোর ও যৌবন কালের হারিয়ে যাওয়া নস্টালজিক মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, জীবনাচার, আর্থসামাজিক অবস্থা, যুবমানসের বৈশিষ্ট্য, নৈতিকতা, পঠন ও চলচ্চিত্র দেখার অভ্যাস, এসবের বিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে স্নিগ্ধ তুলির পরশ বুলিয়ে এক নিটোল অথচ পরিপূর্ণ উপমহাদেশীয় ছবি এঁকেছেন।
বহুদর্শী লেখক আজীবন সাম্প্রদায়িকতার বিষবাস্পকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করেছেন। আমরা তাঁর শিশু মনকে সাম্প্রায়িক দাঙ্গার কারণে পীড়িত ও হতবাক হতে দেখি। তিনি মন্তব্য করেন, বিভাগপূর্বকালে রাজনীতিতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার দীক্ষা হয়েছিল, তারই বহুমাত্রিক ও বহুবর্ণিল প্রকাশ কেবল বেড়েই চলেছে। তিনি খেদের সাথে বলেন, মানুষ এখন চিহ্নিত হচ্ছে নানা সাম্প্রদায়িক তকমায়। জননেতা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবের বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার উদাহরণ উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন – এঁদের সারাজীবনের বক্তৃতায়ও প্রতিপক্ষকে জব্দ করার জন্য একটিও অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করতে হয়নি, এখনকার অনেক রাজনীতিকের কাছে যা ডাল-ভাত (পৃ.৭৮)। তিনি প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বামপন্থি তাত্ত্বিক রণেশ দাশগুপ্ত ও সত্যেন সেনের সান্নিধ্যের কথা, পাভলভীয় মনোবিজ্ঞানী ডা. ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, ইতিহাস গবেষক সৈয়দ আমীরুল ইসলাম, পশ্চিমবঙ্গের শক্তিধর লেখক কলিম খানের সাথে ব্যক্তিগত যোগাযোগের প্রসঙ্গ তুলে ধরে ঢাকায় ‘বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ’ গড়ে তোলার প্রসঙ্গও আলোচনা করেছেন এখানে। তাঁর মতে, যুক্তিবাদী মানুষরা জ্ঞানে, মননে, বিচার-বিবেচনায়, মানবিকতাবোধে মিলতে চায় সারা দুনিয়ার মানুষের সঙ্গে। এ মূল্যবোধই আজীবন চেতনায় লালন করেছেন অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন।
অধ্যাপক মোজাফফর সঙ্গীত বিষয়ে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ও অনুরাগের পরিচয় দিয়েছেন এ গ্রন্থে। সঙ্গীতজ্ঞ ও বিশ্বসাহিত্যের বরেণ্য ব্যক্তিদের প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি উল্লেখ করে সঙ্গীতে তাঁর পছন্দ অপছন্দের দিকগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করেন। বই পড়া সম্পর্কে অধাপক মোজাফফর হোসেনের একটি স্বতন্ত্র দৃস্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে। তিনি উপলব্ধি করেন, পাঠ্য এবং অপাঠ্যের নির্বাচিত সূচি অনুসরণ করা উচিত প্রত্যেকের, কারণ মানুষের জীবনকাল সীমিত। নিজের পড়াশুনা এবং লেখালেখির একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তিনি এখানে হাজির করেছেন যা পাঠ করলে তার সময়ের অমূল্য এবং অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থাদি এবং তার নিজের পড়াশুনার গভীরতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যাবে।
‘ভাববাদ খণ্ডন’ আলোচনায় লেখক প্রকৃতপক্ষে তাঁর প্রিয় বিষয় দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়নের ধারাবাহিক বর্ণনা দিয়েছেন। বিশেষ করে তিনি দেবীপ্রসাদ চট্টোপধ্যায়ের বস্তুবাদী দর্শনের বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। তিনি তাঁর ‘ভাববাদ খণ্ডন’ শীর্ষক অমূল্য গ্রন্থখানি খুঁজে বের করে ভাইবোন সকলে মিলে হাতে কপি করে যৌথ অধ্যয়নের এক অপূর্ব বর্ণনা হাজির করেছেন।
এখানে ‘সেকালের চলচ্চিত্র ও ছবি দেখা’ অংশটুকু চলচ্চিত্র গবেষকদের কাছে উপমহাদেশীয় সনাতন চলচ্চিত্র ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে প্রতিভাত হবে বলে আমার বিশ্বাস। এখানে আছে একাল ও সেকালের চলচ্চিত্র-রুচির তুলনামূলক বাছবিচার, চলচ্চিত্র সম্পর্কে সমাজের মানুষের ও শিক্ষিত অভিাবকদের মনোভঙ্গি, চলচ্চিত্রের প্রতি তরুণদের তীব্র আকর্ষণ, ভারতীয় চলচ্চিত্রের উন্মেষকালের মোটামুটি একটি কালপঞ্জি, চলচ্চিত্রের কলাকুশলী ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সম্পর্কে বিষদ ধারণা। তাঁর মতে এখনকার চলচ্চিত্র নিম্নরুচির সমস্যায় ভুগছে। তিনি এ সময়টাকে ব্যঙ্গ করে ‘পলিথিন যুগ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছন (পৃ.৯৯)। ঢাকায় বাংলা ছবির জন্মকাল এবং ’৭১ পরবর্তী ক্ষণকালকে তিনি প্রগতিপ্রবণ জীবনমুখী সূচনা হিসেবে উল্লেখ করে পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করেন এবং তা কাটিয়ে উঠতে প্রতিবাদী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
লেখক পাতা উল্টাই গ্রন্থের শেষাংশে প্রাচ্যের স্বনামখ্যাত দার্শনিক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ত্রৈমাসিক পত্রিকার সম্পাদক মীজানুর রহমান, কথাসাহিত্যিক নরেন্দ্রনাথ মিত্র, শ্রমজীবী মানুষের নেতা ও অক্লান্ত পাঠক খগেশ কিরণ তালুকদার, সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবী ও সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক, সহকর্মী ও শিক্ষক ব্রজেন্দ্রনাথ দাস, শিক্ষাবিদ কাজী আবুল হোসেন, দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর, কবি আতাউর রহমান, গণবীমা কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা সাফাত আহমেদ চৌধুরী এবং ইতিহাসবিদ সৈয়দ আমিরুল ইসলাম সম্পর্কে নিজের স্মৃতির উল্লেখযোগ্য অংশসমূহ আলোচনাভুক্ত করেছেন।
অবিস্মরণীয় শিক্ষক, লেখক ও দার্শনিক অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন জন্মেছিলেন ফরিদপুর জেলার ভাঙা উপজেলায়। পিতার ও নিজের কর্মসূত্রে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ব্রিটিশ-ভারতে জন্মগ্রহণ করে তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগ, পাকিস্তানের স্বৈরসামরিক শাসন এবং স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে জীবনযাপন করেছন। প্রত্যক্ষ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। পাতা উল্টাই তাই ত্রিকালদর্শী, নিরাভরণ, প্রচারবিমুখ ও জ্ঞানতাপস এক দার্শনিক-শিক্ষাবিদের কালোত্তীর্ণ এক মহাকীর্তি।
সামগ্রিক পর্যালোচনায় দেখা যায় লেখক গ্রন্থের সব অধ্যায়কে সমান গুরুত্ব দেন নি। বিশেষত নিজের প্রসঙ্গ আলোচনার ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় সংকোচ ও সংযম অবলম্বন করেছেন, যা কখনো কখনো আত্মনিপীড়নের পর্যায়ভুক্ত মনে হয়েছে। লেখকের সময়কে সম্যকভাবে উপলব্ধির জন্য পাঠকের স্বার্থেই লেখকের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গসমূহ এখানে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হওয়া প্রয়োজন ছিল। কারণ কখনো কখনো কোনো কোনো মানুষের জীবন আর তার ব্যক্তিগত থাকে না, তা সামাজিক সম্পদে রূপান্তরিত হয়। অধ্যাপক মোজাফফর হোসেন ছিলেন তেমনই এক বিশাল মাপের মানুষ, মৃত্যু যার নশ্বর দেহকে গ্রাস করলেও তাঁর চিন্তা ও আদর্শকে তা কখনো ম্লান করতে পারে না। গ্রন্থে কিছু মুদ্রণ প্রমাদ এবং পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। কাঠামো বিন্যাসেও কিছু দুর্বলতা রয়েছে বলে প্রতিভাত হয়। তবে এসব মামুলি বিষয় উপেক্ষা করলে, মূল্য বিচারে এ গ্রন্থকে কালোত্তীর্ণ আখ্যা দেয়া যায় অনায়াসে।
চূড়ান্তবিচারে আত্মজৈবনিক ঘটনাবলীর ক্ষুুরধার বিশ্লেষণ হলেও পাতা উল্টাই গ্রন্থটি মোটেও ব্যক্তিগত স্মৃতিকথা নয়। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহের দার্শনিক ব্যাখ্যা উত্তরপুরুষের নিকট হস্তান্তরের ঐতিহাসিক দায়বোধই এ গ্রন্থের মূল উপজীব্য। গ্রন্থের বয়ান শুরু সামন্ত মূল্যবোধের যুগের আবেগমন্থিত সম্পর্কের স্মৃতিচারণের দিয়ে, কিন্তু ক্রমান্বয়ে তা প্রসারিত হয়েছে ব্রিটিশ-ভারত, পাকিস্তানি সামরিক-স্বৈরশাসন ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভিযাত্রা – এই তিন কালের দার্শনিক পশ্চাদভূমি পর্যবেক্ষণ ও চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়ার দিকে। এ গ্রন্থের দ্যূতি নির্বাপিত হওয়ার নয়, মহাকালের ব্যপ্ত পরিসরে উজ্জ্বলতর বৈভব নিয়ে তা প্রক্ষিপ্ত ও বিকশিত হবে প্রতিটি বাঙালির জীবনে, বিশ্বপরিসরে।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন : লেখক ও গবেষক
পাতা উল্টাই, লেখক- মোজাফফর হোসেন,
প্রকাশ কাল ২০১০,
প্রকাশনা সংস্থা- বোধি (তক্ষশীলা),
মূল্য-১৭০.০০।