‘নদী ও নারী’— জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা সত্তা

মগ্নপাঠ শুরু করি মূলত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে। তাঁর লেখা আজ পর্যন্ত যত পড়েছি, দেখেছি একই অভিজ্ঞতাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন কাহিনিতে তুলে ধরেছেন। এই ব্যাপারটি আরও একভাবে করা সম্ভব। বহুমুখী সাহিত্য রচনায় জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো। আরেকটু স্পষ্ট করে বলা যায় একই ধরণের ঘটনাকে সাহিত্যের আলাদা বিভাগে কাজে লাগানো। এই কৌশলে লিখেছেন হুমায়ুন কবির (‘মেঘনায় ঢল’ এবং ‘নদী ও নারী’)। লিখেছেন জসীম উদ্দীন (‘কবর’ এবং ‘বোবা কাহিনী’)। ‘নদী ও নারী’র পাঠ বিশ্লেষণে তুলনায় ‘বোবা কাহিনী’ কেন প্রাসঙ্গিক সে কথায় পরে আসা যাবে। তিনটি স্পষ্ট ভাগে বিভক্ত উপন্যাসটির বিষয়ের দিক থেকে ভাগ আসলে দুটি, তা নামেই স্পষ্ট।
যে নদীর কথা বলা হচ্ছে সেটি পদ্মা। পদ্মায়ও মেঘনার মতো প্রলয়দোলায় ঢল ওঠে। প্রাণনাশে পদ্মা মেঘনার চাইতে কম যায় না।
‘… ভরবেলা গেলে, ভাটা পড়ে আসে, আঁধার জমিছে আসি, এখনো তবুও এলো না ফিরিয়া আমিনা সর্বনাশী। দেখ্ দেখ্ দূরে মাঝ-দরিয়ায়,কাল চুল যেন ঐ দেখা যায়—কাহার শাড়ির আঁচল-আভাস সহসা উঠিছে ভাসি? আমিনারে মোর নিল কি টানিয়া মেঘনা সর্বনাশী।’
‘মেঘনায় ঢল’ কবিতার তৃতীয় ও শেষ স্তবক।
নজু মিয়ার পর তার মা আয়েশাও পরলোকগত হয় পদ্মার জলধারায় মিশে।
নজুর ব্যাপারে আয়েষার আশঙ্কা ছিল পদ্মার ঝড়জলে ছেলে পাছে মারা পড়ে। ‘মেঘনায় ঢল’-এর আমিনা চরিত্রকে নিয়ে তার মায়েরও একই আশঙ্কা ছিল।
উদ্ধৃত স্তবকে আমিনার যে পরিণতি তা ‘নদী ও নারী’ উপন্যাসে আয়েশাকে বরণ করতে হচ্ছে। রাতের আঁধারে পদ্মার তীরে ভেসে উঠেছে তার চুলের গোছা।
এককভাবে পদ্মাই সর্বনাশ করেনি মালেকের। সমুদ্রপাড়ে বসবাসে বিরূপতাও রয়েছে। ‘নদী ও নারী’ আমাদের ভূমিতে মগ-হার্মাদ জলডাকাতদের আক্রমণের গল্প বলেছে। এ ব্যাপারটি ‘বোবা কাহিনী’ উপন্যাসে আমীর সাধুর পুথির আড়ালে এসেছে। পল্লীকবির ‘পল্লীবর্ষা’ কবিতায় এসেছে এ ইঙ্গিত। এসেছে জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে। ভেলুয়া সুন্দরীর সে পুথির শুরুটা এমন—
‘শুন শুন বন্ধুগণরে, শুন দিয়া মন।
ভেলুয়ার কথা কিছু শুন সর্বজন।।
কি কহিব ভেলুয়ার রূপের বাখান।
দেখিতে সুন্দর অতিরে রসিকের পরাণ।।
আকাশের চন্দ্র যেন রে ভেলুয়া সুন্দরী।
দূরে থাকি লাগে যেন ইন্দ্রকূলের পরী।।”
উপন্যাসে নারীর রয়েছে সর্বগ্রাসী ভূমিকা। প্রথম অংশে নজু মিয়ার আখ্যানে আয়েশা চরিত্রে একাধারে একজন মা এবং দাদিকে পাই আমরা।
সন্তানের মুখ দেখে মনের কথা পড়ে নেবার প্রচ্ছন্ন ক্ষমতা মোটামুটি প্রত্যেক মায়েরই আছে।
‘নদী ও নারী’ উপন্যাসের প্রথম ভাগে নজু মিয়ার আখ্যানে আয়েশার মধ্যে এ ব্যাপারটি তুলে ধরেছেন হুমায়ুন কবির। তাঁর ‘মেঘনায় ঢল’ কবিতার উপজীব্য আশঙ্কার জায়গাটিও আয়েশা চরিত্রে এসেছে। সত্যও হয়েছে আশঙ্কা।
এমন আশঙ্কাপ্রবণ মা দেখেছি হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসে। মেতর বউ খোকার অসুস্থতা নিয়ে যে কী পরিমাণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল, তা সচেতন পাঠকমাত্র বুঝতে পারেন।
আয়েশা নজু মিয়াকে কিছুতেই উত্তাল নদীতে যেতে দেবেন না। এর আড়ালে ছিল আশঙ্কামিশ্রিত মাতৃস্নেহের স্রোতধারা।
মালেক আর তার দাদির মধ্যে অটুট বন্ধন দেখেছি নজু মিয়ার অংশে। ‘পথের পাঁচালী’র ইন্দির ঠাকরুণ চরিত্র নিয়ে আশা বেঁধে রাখলাম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আসলে চরিত্র সৃষ্টির তাগিদ কম দেখা যায়। গ্রন্থমাধ্যম থেকে যত পর্দামাধ্যমে আগানো যায়, ‘হিরোইজম’ শব্দের মাহাত্ম্য চরিত্র সৃষ্টির প্রবণতাকে কমিয়ে দেয়।
আমরা নায়ক-নায়িকা/প্রেমিক-প্রেমিকার মানদণ্ডে সবকিছু বিচার করতে আগ্রহী। মাঝে মাঝে ইরানের সিনেমার অগ্রসরমান পরিস্থিতি আমাকে ভাবায়। এ সেপারেশন, চিলড্রেন অব হ্যাভেন, কালার অব প্যারাডাইস এর মতো ছবিতে চরিত্রের কী অমিত শক্তি! এদিকে এদেশে ‘নদী ও নারী’র মতো ক্লাসিকের প্রতিতুলনায় কোনো সমকালীন উপন্যাস পাওয়া ভার হয়ে যাচ্ছে।
হরিশংকর জলদাসের লেখায় ঠাকুরদা চরিত্র পাই প্রতিনিয়ত। ‘বাতাসে বইঠার শব্দ’ যে সততার প্রতিমূর্তি চন্দ্রনাথ হালদার, তিনি ‘জলপুত্র’-এর নিখোঁজ চন্দ্রমণি। চন্দ্রমণি জলদাস হরিশংকর জলদাসের সত্য পিতামহ। তাঁর সত্য নামেই তিনি ‘জলপুত্র’-এ নিখোঁজ হয়েও উপস্থিত। একই উপন্যাসের বরদাসুন্দরী এবং চাঁপারানী কথকের দুই ঠাকুমা। অবশ্য ঠাকুমা হিসেবে এদের বিকাশের যথেষ্ট সুযোগ কাহিনিতে ছিল না।
এদিকে রামগোলাম আর গুরুচরণের মধ্যে পূর্বপুরুষ-উত্তরপুরুষের সম্পর্ক নিকট ভবিষ্যতে প্রবাদতুল্য হবে বলে মনে করা যায়। কিন্তু দাদি-নাতির বন্ধন হরিশংকর জলদাসের লেখায় তেমন করে আসেনি। যদিও ‘রামগোলাম’-এর অঞ্জলি চরিত্রে অল্প পরিমাণে দাদিসত্তা দেখা গেছে।
বাংলাদেশের সিনেমায় অল্প কিছু দাদি চরিত্রের উদাহরণ আছে। সেই ‘সুজন-সখী’ (সাদাকালো-রঙিন দুটোই) থেকে শুরু করে ‘মায়ের অধিকার’ অথবা ‘অন্তরে অন্তরে’ কিংবা ‘দাদীমা’-দাদিরা ঘুরে ফিরে আনোয়ারা-ডলি জহুর-ফেরদৌসী মজুমদারেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
কুসুমের মধ্যে একটা মাতৃপ্রতিম স্নেহ মালেকের জন্য দেখা গেছে। সেটি দিনে দিনে বেশ শক্তপোক্ত হয়ে যখন স্থির একটা বন্ধনে রূপায়িত, তখনই সমাজ দাঁড়ায় বাধার দেয়াল হয়ে।
আয়েশা আর নুরুর মাঝে কুলসুম মালেকের অস্তিত্ব ঘিরে থাকা নারী। প্রকৃতির নিয়মে আয়েশার মৃত্যুতে কুলসুমের সাথে সখ্য। নিজের ছেলের মতো পেলেপুষে বড়ো করতে করতে একসময় আসগরের পরিবারের চাপে আজিজের সাথে বিয়ে। এই জায়গাটা কষ্ট দেয়। নীরবতাই সম্মতি—কথাটাকে বাজেভাবে ব্যবহার করে বাৎসল্য রসকে করুণরসের দিকে ঠেলে দিতে হলো এভাবে?
নুরুর আখ্যানে মোটামুটি দুটো ভাগ—শিশু নুরু আর বয়ঃপ্রাপ্ত নুরু। শৈশবে দুজনের বন্ধনে সখ্যরস দেখা গেছে। এ সময় তাদের মধ্যে একটা চমৎকার মনস্তাত্ত্বিক মিল দেখা যায়। শিশু মনস্তত্ত্ব এরকম মিলকে স্বাভাবিকই বলে। ‘বোবা কাহিনী’ উপন্যাসে বছির-ফুলী-নেহাজদ্দী-বড়ুদের বন্ধন এক্ষেত্রে যেমন তুলনীয়, তেমনি ‘পথের পাঁচালী’র অপু-দুর্গার।
বয়সের সঙ্গে নুরু, মালেক— উভয়েরই মনোজগতের পরিবর্তন ঢালাওভাবে দেখানোর প্রয়াস লক্ষ্যণীয়। একপর্যায়ে তাদের প্রেমের ব্যাপারটিও স্পষ্ট হয়। এ প্রেমের সাথে মিল খুঁজে পেয়েছি ‘শামুক’ (হাসান আজিজুল হক) এবং ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’ (কল্লোল লাহিড়ী) উপন্যাসদুটিতে চিত্রিত প্রেমের। তিনটির কোনোটিরই মিলনান্তক পরিণতি না থাকলেও বেশ সৌম্য শান্ত আর স্নিগ্ধ ছিল এ সকল বন্ধন। মাহবুব-উল হক রচিত ‘মফিজন’ উপন্যাসে বয়ঃসন্ধিকালীন অব্যক্ত প্রেম দেখানো হচ্ছে—
‘… মফি তাহাকে টানিয়া তুলিল। তাহাকে হাত ধরিয়া টানিল খেলিতে, তাহার গলার উপর বাহু বাঁধিয়া টানিল বেড়াইতে, আর নিজে গল্প বলিয়া তাহাকে বাধ্য করিল ‘সায়’ দিতে। …”
এ লেখাটুকুও প্রতিতুলনায় অপ্রাসঙ্গিক বিচার করতে পারছি না।
হরিশংকর জলদাসের ‘মোহনা’ দেখিয়েছে কৈবর্তদের দুটো ভাগ- হালিক আর জালিক। তাহলে কুবেররা জালিক কৈবর্ত হলে মকবুল-মন্তুরা হালিক কৈবর্ত।
‘নদী ও নারী’র নজু মিয়া, আসগরও সেই ভাগেরই মানুষ। গরুর অভাবে তাদের লাঙল কাঁধে তুলতে হয়। এ ব্যাপারটি জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসে একটু অন্যভাবে এসেছে —
“বাড়ির ওপারের জমিটাতে লাঙল না দিলে নয়। অথচ হাল যে একটা ধার পাবে, সে সম্ভাবনা নেই। লাঙল অবশ্য যা হোক একটা আছে ওর। অভাব হলো গরুর। গরু না হলে লাঙল টানবে কিসে? আচ্ছা, এক কাজ করলে কেমন হয়! মকবুল ভাবলো, বউ দুটোকে লাঙলে জুড়ে দিয়ে…. দূর এটা ঠিক হবে না। লোকে গালাগাল দেবে ওকে। বলবে, দ্যাহো বউ দুইডা দিয়া লাঙ্গলও টানায়। …”
বহদ্দাররা যেমন গঙ্গাদের, বড় সাহেব আবদুস ছালাম যেমন রামগোলাম-কার্তিকদের হন্তারক তেমনি হাকিমরা অথবা গঙ্গাচরণ চাটুজ্জেরাও কম যান না ছুৎমার্গ বিচার করে নিম্নবর্গের লোকজনদের কাঁধে চড়ে বেঁচে থাকতে।
হুমায়ুন কবিরের হাকিমের সঙ্গে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গঙ্গাচরণের প্রভূত মিল পাচ্ছি স্বার্থপরতায়। দুর্ভিক্ষের আগে গঙ্গাচরণ চালটা কলাটা কখনোই কিনে খায়নি নতুনগাঁয়ে।
এদিকে ধুলদির হাটের গুজবে কান দিয়ে নজু মিয়ার কাছে কুমিরের কলজে-গুর্দা চেয়ে বসে হাকিম। হালচাষী পঞ্চায়েতকে গড়গড়ায় তামাক খেতে দেয় ছুৎমার্গ ভুলে। যখনই তার স্বার্থসিদ্ধি হলো না, দূর দূর করে তাড়াতে পিছপা হয় না হাকিম।
এই হাকিমের কাছ থেকে মায়ের জন্য মালিশ নেবে নজু মিয়া?
তার ‘হাকিম না তোর মাথা’ – সংলাপের এ অংশে এক ধরণের ক্রোধ স্পষ্ট।
আবার ‘পদ্মানদীর মাঝি’তে গণেশ কুবেরকে গীত ধরতে বললে কুবের বলে—হ, গীত না তর মাথা।
এখানে এক ধরণের অবহেলামিশ্রিত বিরক্তি প্রকটিত। এতেও কি দূরদৃষ্টিতে আড়ৎদারের প্রতি ঘৃণার উপাদান নেই? নেই নিম্নবর্গীয় বঞ্চনার জীবনের প্রতি প্রচ্ছন্ন অভিশাপ?
অভিশাপ কি প্রকৃতি মানুষকে কম দেয়? ‘নদী ও নারী’ উপন্যাসে আকাল এবং বন্যার সহাবস্থানে মানুষের অসহায়ত্ব চিত্রিত হয়েছে।
তিন বছরের আকালে অভাবের চূড়ান্ত। ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাসে বিশ্বাস মশায়ের কথা মনে পড়ে। অভুক্ত প্রতিবাদী গ্রামবাসীর আক্রমণে গ্রাম ছাড়তে হয় তাকে। এদিকে আসগর গোলা উপুড় করে দেখায় সকলকে—তার কাছে মজুদকৃত কোনো ধান নেই। খাবারের আশা, খরচের ভয় – যুগপৎ দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচার জন্য আথালের বলদ-গোরু জবাই করার ইতিহাস উঠে এসেছে।
নাম : নদী ও নারী
লেখক: হুমায়ুন কবির
প্রকাশনী: : বাংলা একাডেমি
পৃষ্ঠা সংখ্যা : 191
ISBN : 984-07-5518-2
প্রথম প্রকাশ: মার্চ, ২০১৬
‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে জহির রায়হান লিখেছিলেন -“সেই তেরশ’ সনের বন্যা। অমন বন্যা দু-চার জন্মে কেউ দেখেনি। মাঠ ভাসলো, বাড়ি ভাসলো, ভাসলো কাজীর কুশান।কিছু বাদ নাই। ঘর বাড়ি গোয়াল গরু সব। এমনকি মানুষ ভাসলো। জ্যান্ত মানুষ। মরা মানুষ। …”
অনুরূপ একটা অবস্থায় ‘নদী ও নারী’ উপন্যাসে আসগর আলী তার পরিবার নিয়ে নৌকায় ভাসান দিয়ে ঘর ছাড়লেন। এর পরই মালেকসংক্রান্ত জটিলতা। তার মাঝে মগ জলদস্যু সরদারের মধ্যে মানবতার ব্যাপারটি লক্ষ্যণীয়। ফিরে যখন আসে মালেক – তাকে ঘিরে সে কী উৎসব!
জিয়াফত, জোমাত, মেজবান, মাইট্ট্যাল প্রভৃতি নামে গ্রামবাসী খাওয়ানোর প্রথা এদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত আছে। বাঙালির খাদ্যাভ্যাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন পাওয়া যায় এসকল খাবার অনুষ্ঠানে। বেশ কয়েকটি গবেষণামূলক লেখা বাঙালির খাবারের অতীত-বর্তমানের ওপর পেলেও ‘জিয়াফত’ নিয়ে সেভাবে পাইনি কোথাও। অথচ এই ব্যাপারটি গ্রামবাঙলার বাঙালিদের প্রাণের আয়োজন বলা যেতে পারে।
নদী ও নারী উপন্যাস থেকে যেটুকু পেয়েছি এ বিষয়ে, তাকে প্রামাণ্য ধরা যেতে পারে। একটু ঘুরে আসি জিয়াফতের আয়োজন থেকে-“উঠোনে দস্তরখানা পেতে সকলের খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। এত লোকের জন্য বাসন কোসন জুটবে কোথায়, তাই কলাপাতা কেটে তাতেই খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। মেহমানরা সবাই বসে গেলে আজিজ একটা বড় বাসন ভরে নুন নিয়ে এল-সকলের পাতে নুন পড়বার পর বড় বড় গামলা ভরা গরম ভাত এল। মোটা লাল চালের ভাত, কিন্তু খেতের ধানের চাল, তাতে তখনো ভাপ উঠছে। সে ভাতের গন্ধ আর স্বাদের তুলনা কোথায়? বাটি বাটি সালুন এল, গোস্ত দিয়ে রাঁধা ডাল, তারপরে মাছ ভাজা, রাঁধা মাছ, কত রকমের তরিতরকারি, শাকসবজি। সবাইর শেষে সেমাই, ঘন দুধ আর নতুন গুড়। গাঁয়ের লোক পেট ভরে খেল-আসগর মিয়া আয়োজনের ত্রুটি করেনি। এ রকম জিয়াফত সে তল্লাটে কখনো হয়নি।”
চল্লিশা প্রসঙ্গ এসেছে কোনো কোনো উপন্যাসে। এ মুহূর্তে মনে পড়ছে ওয়াদুদ খান রচিত ‘করুণাহীন করোনার দিন’ উপন্যাসের কথা। এসেছে বিয়ের খাবারের বিবরণ – জহির রায়হানকে ডিটেইল করতে দেখেছি ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে। আবু ইসহাকও সম্ভবত এ ব্যাপারটি এনেছেন ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ উপন্যাসে।
গ্রামাঞ্চলে পীর-ফকিরের এন্তার প্রভাব ছিল তখনকার দিনে। ফকির চরিত্রে তারই ছাপ। তার আস্তানায় ইলম শিক্ষার ব্যবস্থা। আমরাও একটু সেখান থেকে ঘুরে আসি—
নজুমিয়া বলল, হাঁ ভাই, কোরান যে পড়ছ তা তো বুঝলাম, কিন্তু আমি জাহেল পাড়াগেঁয়ে মানুষ, আমি তো কোরানের অর্থ বুঝতে পারি না। যে সুরা পড়ছ, তার মানে বুঝিয়ে দাও না ভাই।
ছেলেটি বলল, মানে, কোরান শরীফের মানে? খোদার কালাম পড়ছি, হেফজ করে করে মুখস্থ করছি, তার আবার মানের কথা ভাবে কে?
এ রকম অবস্থার বিবরণ অন্যভাবে এসেছে ‘বোবা কাহিনী’ উপন্যাসে। সেখানে ভুলভাল তাফসীর করে মাওলানাদের ওয়াজ-নসিহতরত দেখা যায় গ্রামাঞ্চলে।
আসগর চরিত্রের মধ্যে ইতিবাচকতার লক্ষণ স্পষ্ট। বাস্তববাদী মানসও প্রখর। অন্যদিকে নজু মিয়ার জনপ্রিয়তা কম না হলেও ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে তিনি পারেননি।
আসগরের শত্রুতা ভুলবার ইচ্ছে থাকলেও জীবদ্দশায় নজু মিয়া মিটমাটের আগ্রহ না দেখানোয় এগোতে পারেনি ব্যাপারটা।
বসির আর আজিজের চরিত্র দুটোও গুরুত্বপূর্ণ।
নজু মিয়ার মৃত্যুর পর মালেকের সাবালকত্ব অর্জন পর্যন্ত সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল বসিরের ওপর। এ দায়িত্ব পালনে সচেতনতা আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায় তার।
আজিজ চরিত্রে পত্নীপ্রেম দেখানোর চেষ্টা ছিল। একটা পর্যায়ে কুসুমের শোকে মাথা খারাপ হয়ে যায় তার। এমন নিবিড় দাম্পত্যপ্রেম একটু ভিন্ন কৌশলে জসীম উদ্দীনের লেখায় এসেছে। ‘বোবা কাহিনী’ উপন্যাসে আজাহের-আয়েসার আখ্যানে আমরা দাম্পত্য-প্রেম পাই।
বিয়ে যেমন নতুন সম্পর্কের জাল বিস্তার করে, তেমনি পুরোনো সম্বন্ধের জাল ছিঁড়েও ফেলতে পারে কখনো সখনো। কখনো বা জাল বিস্তারই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তিন ধরণের বাস্তবতাই অম্ল-মধুর অনুভূতির জন্ম দেয় মানুষের মনে। এই বাস্তব জীবনবোধে পরিপূর্ণ চিরায়ত উপন্যাস ‘নদী ও নারী’। নারী-পুরুষের চিরকালীন সহাবস্থানের এ কাহিনি আমার কাছে সুখপাঠ্য লেগেছে।
রেজওয়ান আহমেদ, শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য (৬ষ্ঠ আবর্তন), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।