সময়ের ইতিহাসকে ধারণ করে আছে যে বই

তৈমুর খান Avatar

দীপক সাহা ‘বদল জীবনের পালা'(দ্বিতীয় সংস্করণ জানুয়ারি ২০২২) গ্রন্থটিতে গল্প-গদ্যসহ প্রবন্ধ-নিবন্ধ একসঙ্গে সন্নিবিষ্ট করেছেন। এগুলি একসঙ্গে করার মূল কারণটি হচ্ছে করোনা কাল। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই একটি ভয়ঙ্কর সময় মানব সভ্যতায় বয়ে চলেছে। যার হাত থেকে জীবন রক্ষা তথা সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখার অদম্য প্রয়াস চালাচ্ছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা। এই পরিস্থিতির মোকাবিলার জন্যই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে লকডাউন এর সূচনা হয়। এই লকডাউন একটি মারাত্মক শব্দ। এর কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা, অর্থনীতি, সামাজিক পরিবেশ, শিক্ষাদীক্ষা সবকিছুই ধ্বংসের মুখে অগ্রসর হয়েছে। লেখক দীপক সাহা তাঁর অনুসন্ধানী সংবেদনশীল মন নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। মানুষের হাহাকার দীর্ঘশ্বাস চিৎকার এবং যন্ত্রণাকে পরখ করেছেন। তারই নিরিখে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে বাস্তবতাকে অনুধাবন করেই তিনি এই গ্রন্থখানি রচনা করেছেন।

যে ঘটনাগুলি প্রত্যক্ষ করা যায় বা বাস্তব অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করা যায়; সংবাদপত্রে বা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে যেগুলি আমাদের সামনে আসে, যেগুলির তথ্য ও পরিসংখ্যান স্বচক্ষে যাচাই করা যায়—সেগুলিকে তিনি সাবলীল গদ্যে প্রবন্ধ-নিবন্ধাকারে লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু যে ঘটনাগুলি আমাদের জীবনের অন্তরালে অবস্থান করে, হৃদয়ে মোচড় দেয়, বেদনার স্পর্শে চোখ ভিজে যায়, মনকে ভারাক্রান্ত করে—সেইসব মনস্তাত্ত্বিক অতি সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলিকে তিনি গল্প ও অণুগল্পে রূপায়িত করেছেন। সেগুলিও এক একটি শৈল্পিক সৌন্দর্যে পূর্ণতা পেয়েছে। লেখকের অসাধারণ মানবিক বোধের ব্যাপ্তি এবং হৃদয়স্পর্শী কথার জাদু যেকোনো শ্রেণির পাঠককেই আকৃষ্ট করবে।

 কী আছে তার গদ্যগুলিতে?

করোনাভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য সচেতনতা দরকার, সেই কারণে প্রথমে গুজব থেকে বাঁচতে হবে। কীসের মাংসে করোনা ছড়ায় তা না জেনে আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই। সিএএ বিরোধী আন্দোলন, কুসংস্কার বা ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস থেকে নিজেকে রক্ষা, ছোঁয়াছুঁয়ির দূরত্বে সামাজিক ও পারিবারিক অস্পৃশ্যতার সূচনা কতখানি যুক্তিযুক্ত এটা বিচার করতে হবে। করোনায় মৃত্যু মিছিল ও শেষকৃত্য কতখানি ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে এবং তা কতখানি অমানবিক হচ্ছে তা সহমর্মিতায় অনুধাবন করতে হবে। এসবের সঙ্গেই পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা, তাদের বাড়ি ফেরা নিয়ে রাজনীতিকরণ, করোনাকালে চাষিদের কী অবস্থা, কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক ও হকারদের জীবন-জীবিকা এবং হাহাকার কতখানি মর্মান্তিক তার নিখুঁত ছবি তুলে ধরেছেন। যানবাহন বন্ধ বলে সাইকেলের গুরুত্ব কতখানি তাও বুঝিয়েছেন। আম্ফান এর কবলে সুন্দরবনবাসীর দুর্দশা এই প্রসঙ্গেই বর্ণিত হয়েছে। বয়স্ক মানুষদের অসহায়তা, গৃহসহায়িকা থেকে গৃহশিক্ষক পর্যন্ত সবাই লকডাউনের শিকার। স্বাস্থ্য এবং নারীর প্রজনন ক্ষমতা কতখানি সংকটের মুখে তার অন্তর্তদন্ত উঠে এসেছে। শিশুশ্রমিক বৃদ্ধি, প্রান্তিক পড়ুয়াদের অনলাইনে শিক্ষায় বঞ্চিত হওয়া কোনও কিছুই বাদ যায়নি।

 গল্পগুলিতে কী আছে?

মোট আটটা বিভাগে একটি করে গল্প পরিবেশন করেছেন। প্রতিটি গল্পেরই মনস্তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট খুব জীবন্ত এবং মর্মস্পর্শী। মর্ত্যের লকডাউনকে কেন্দ্র করে স্বর্গে দেবতাদের ভাবনা এবং সংলাপ যা মর্ত্যবাসীকেই সচেতন করবে। যে মাস্টারমশাই ফুটবল খেলায় যে ছাত্রকে সাহায্য করে আর্মির চাকরিতে যেতে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তারই মৃত্যু সংবাদ পেয়ে চোখের জল ঝরান।

 স্কুল বন্ধ বলে স্কুলগাড়ির ড্রাইভার অসহায়তার মধ্যে পড়েছেন। মাকে ডাক্তার দেখানোর পয়সা নেই। অবশেষে ছোট্ট ছাত্রীর  লক্ষ্মীর ভাঁড়ের পয়সা দেওয়া দেখে আমাদেরও চোখ ভিজে যায়। বৃদ্ধ বয়সে বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি হয়ে সন্তানকে না পেলে কী অবস্থা হয় এবং সন্তান থাকলে কী অবস্থা হয় এই ঘটনাও গল্পে উঠে এসেছে। করোনাকালে সবাই যখন সঙ্গ ছাড়া তখন একমাত্র একটি পোষা কুকুরই সঙ্গী হয়ে ওঠে। প্রভুর জন্য ছটফট করতে থাকে। অনলাইনে এবং অফলাইনে পড়াশোনার পার্থক্য কতখানি তাও গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে। লকডাউনের সময় চালকুমড়ো পাড়তে গিয়েও বিড়ম্বনায় পড়তে হল—এও এক মজার গল্প।

দীপক সাহা ঝরঝরে গদ্য লেখেন। তাঁর জীবনমুখী দরদি কলমে একটা সময়ের জনজীবন, রাষ্ট্র, সমাজ এবং জীবনবীক্ষণ ইতিহাস হয়ে রইবে। সে কারণেই গ্রন্থটি স্মরণীয় এবং সংগ্রহযোগ্য।

বই: বদল জীবনের পালা
লেখক: দীপক সাহা
প্রকাশনা: ইলশেগুঁড়ি, হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
মূল্য-২০০ টাকা।

মতামত