অচেনা আকাশ উত্তরণের এক অনবদ্য কিশোর উপন্যাস

বইচারিতা ডেস্ক Avatar

ছোটগল্পের সঙ্গে উপন্যাসের মৌলিক পার্থক্যটুকু বুঝিয়ে দিতে পারলেই বোধ হয় “অচেনা আকাশ’ উপন্যাস লেখায় ঔপন্যাসিকের সফলতা বা বিফলতা সহজে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব।

একটা প্রকাণ্ড ঝাঁকড়া অশ্বত্থ গাছ উপন্যাসের সার্থক সমরুপ। পল্লবিত নানা জীবনের গ্রন্থিবন্ধন এর মতো মূল কাণ্ড শাখা-প্রশাখা সহ সমগ্র পত্রবাহার বুকে ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রত্যেকের নিবিড় যোগ সেই সুদৃঢ় কাণ্ডের সঙ্গে। গুঁড়ি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মতো অন্তরে অন্তরে সকলকে গ্রহণ করে ধন্য হয়। উপন্যাসের বস্তুগত দ্বান্দ্বিকতায় থাকে দ্বন্দ্ব সমাসের সুর। এখানে দ্বন্দ্ব মানে সংঘাত, দ্বন্দ্ব মানে মিলন। প্রকাণ্ড কান্ডকে কেন্দ্র করে সমগ্র গাছের বস্তুগত দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক এমনিই। ‘বস্তুগত’ শব্দটি প্রয়োগ করলাম এই কারণে যে উপন্যাস বা ছোটগল্প কবিতার মতো শুধু মননের অনুরণন মেলে ধরে না রিফ্লেকশন এর মাধ্যমে বরং তার প্রথম ও প্রধান কাজ হল মনের কঠোর বাস্তবতাকে পাঠকের সামনে মেলে ধরা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একেই বলেছেন সাহিত্যের বাস্তবতা। আজকাল ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে জাদুবাস্তবতা শব্দের প্রয়োগ যত্রতত্র দেখতে পাই। উপন্যাসের কাহিনি বা চরিত্র– সরল, জটিল, ঋজু, সোজা যাই হোক না কেন তাকে পৌঁছাতে হবে কান্ডে আলোকিত দ্বান্দ্বিক সূত্রের মূল পথ ধরেই।

বানানো গল্প বললে উপন্যাস এর প্রতি সুবিচার করা হয় না। আসলে উপন্যাস লেখক যে জীবনকে দেখেন, যে জীবনের বিচিত্র স্বাদ পেয়ে বিস্মিত ও উদ্বুদ্ধ হন, সেই বিস্ময়ের উদ্বোধনকে অনিবার্যভাবেই স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে পরিবেশন করতে চান। সেই পরিবেশনায় অবরুদ্ধ আবেগ মুক্তি পেলেই ঔপন্যাসিক তৃপ্তি অনুভব করেন। ‘অচেনা আকাশ’ উপন্যাসের মূল বিস্ময় লুকিয়ে রয়েছে বন-বাদাড় এর মতো নানান প্রতিকূলতা উপড়ে ফেলে গজাকে সামনের আলোয় মেলে ধরার মধ্যে। ঔপন্যাসিক সম্পূর্ণ স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে তা পরিবেশন করতে পেরেছেন গজার জীবনের বিস্ময়পর্বের নানা উত্তরণ দিয়ে। গজামায়ের বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার প্রাককালে দুটি পছন্দের ছবি চুরি করা তার জীবনে উদ্দীপনার মূল দুটি সূত্র। সন্ধ্যার অন্ধকারে ভবানী শংকর রায় ঘাড় ধরে পথের গজাকে আবার পথে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। স্কুলজীবনে সাদিকের তৈরি প্রবল প্রতিকূলতা, মুদি দোকানে গজাকে ফাঁসানোর জন্য রবীনের সূক্ষ্ম মাস্টারপ্লান– গজার জীবনে সবই ভাসমান

মেঘের মতো। গোয়ালের  সামনে নিমগাছের ছায়ায় রোদ ধরার খেলার মধ্য দিয়েই সে এইসব প্রতিকূলতা মাড়িয়ে  নিজেই সূর্য হয়ে উঠতে চেয়েছে। ভাসমান মেঘ কখনো পৃথিবীজোড়া নীল আকাশ হতে পারে না কিংবা সমগ্র আকাশ মুহূর্তে ঢেকে দেওয়ার সামর্থ্য তার নেই। ঔপন্যাসিক সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে গজাকে অসীম অনন্ত আকাশ করে তুলতে চেয়েছেন এ উপন্যাসে। সেই তো লেখকের মানসপুত্র, না পারলে সে বিশ্ববঞ্চিতদের সামনে সেরা মডেল হয়ে উঠতে পারবে কি করে? তাকেই হাসিমুখে সারাবিশ্বে সর্বজয়ী হয়ে উঠতে হবে। এ উপন্যাসে গজা কোন বিশেষ গ্রাম নয়, আঞ্চলিকতা নয়, কোন একটি দেশ নয়, সব দেশে যুগে যুগে বঞ্চিতদের জীবনে সে নতুন মাইলস্টোন। মনের অক্ষম আকাশকে সক্ষমতার আকাশে পরিণত করাই তার মূল মননবীক্ষণ।

সমস্যা ছাড়া যেমন জীবন হয় না তেমনি উপন্যাসও হতে পারে না। ই এম ফস্টার  যথার্থই বলেছেন, The Nobel is slogged with humanity, there is no escaping the uplift and the downpour, nor can they be kept out of criticism. আসলে মানবতাকে যদি ছেঁকে বিশুদ্ধ করে তোলা সম্ভব হয়, তাহলে ঔপন্যাসিকের পক্ষে থাকে শুধু বানানো শব্দগুচ্ছের প্রয়োগ। এভাবেই বিশ্ববঞ্চিত গজার উত্তরণকে ছাঁকুনির আলোয় চলমান সমস্যার উপরে মানবিকতার জৌলুস দিয়ে সার্থক করে তুলতে পেরেছেন ঔপন্যাসিক। বিষয়বস্তুর ভাষিক প্রকাশ এবং বিন্যাস কৌশল নিয়ে নানা আলোচনা থাকলেও গজার উত্তরণে মানবিক কারণে আমরা অভিভূত না হয়ে পারিনা।

উদার আকাশ প্রকাশক ফারুক আহমেদ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করলেন “অচেনা আকাশ” উপন্যাস প্রকাশ করে। বঞ্চিত অবহেলিত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন গজার মতো চরিত্র নির্মাণে লেখককে উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে প্রকাশক উদার মনের পরিচয় দিলেন। ইতিমধ্যেই উদার আকাশ প্রকাশন সংস্থা থেকে ১৩৩ টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

ঔপন্যাসিকের একটি অতিপ্রয়োজনীয় গুণ হলো বস্তুজগৎ থেকে  আহরিত তথ্যকে সামঞ্জস্য সূত্রে গেঁথে তোলার সক্ষমতা। সেই আবিষ্কারের পিছনে লেখকের ব্যক্তিগত ভিশন যে কত বেশি  ক্রিয়াশীল থাকে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আলোচ্য উপন্যাসে লেখক তাঁর অসীম মানসিক ক্ষমতার জোরে গজা,গজাসংশ্লিষ্ট সমস্ত জীবন এবং পর্ব পরিদৃশ্যকে আশ্চর্য দক্ষতায় জীবনীয়  করে তুলতে পেরেছেন বলেই তা যথার্থ শিল্পকর্ম হয়ে উঠতে পেরেছে। ঔপন্যাসিকের গভীরস্পর্শী দৃষ্টি, মাত্রাজ্ঞান, ঝোঁক বা মানবিক উপাদানের উপস্থাপনা এ উপন্যাসের গঠনকর্মকে এমন ভাবে নিয়ন্ত্রিত করেছে যে প্রিয় পাঠক ঔপন্যাসিকের ভিশনের দ্বারা সংক্রমিত না হয়ে পারবেন না। তখনো হয়ত যে বাধা পাঠকের মনে প্রশ্নের দেউলকে আরও উচ্চতায় দাঁড় করিয়ে দিতে পারে তা হল, এটা যদি কিশোর উপন্যাস না হয়ে…। এমনি ভাবনা জারিত পাঠককে মনে করিয়ে দিই, বাস্তব উপকরণ লেখক এর মূল সম্পদ এবং তার প্রাণময় প্রকাশেই  লেখকের  প্রকৃত কৃতিত্ব। মূল চরিত্রের বয়স কোন ম্যাটার করে না আর ম্যাটার করলে রোদ ধরার মধ্যে গজার জীবনে যে মৌলিক অনুধ্যান রয়েছে তা ছেলেটিকে কতখানি অনন্য করে তুলতে পারল সেটাই বুঝতে পারব কী? তাই পাঠককে বুঝে নিতে হবে ঔপন্যাসিকের মৌলিক কোন্ বিশেষ অনুভূতির মধ্য দিয়ে বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে সার্থক শিল্প হয়ে উঠতে পারলো কিনা।

ভার্জিনিয়া উলফ বলেছেন, চেতনার মধ্যে জীবনের প্রতি অণু-পরমাণুর প্রতিফলন বা প্রতীতিকে প্রকাশ না করলে জীবনের স্বাদ পরিপূর্ণ গভীরতা পায়না। অচেনা আকাশ উপন্যাসের শেষ অংশে দুচোখ জলে ভিজিয়ে স্কুলের সদর ফটক পার হয়ে রূপান্তরিত গজার  বিনীত অনুরোধ…

‘আমার আর কেউ নেই ছোট বাবু, আজ থেকে আপনাকে দাদা বলে ডাকব?

লেখকের এ নিরপেক্ষ ভিশনে  যেকোনো পাঠকের দুচোখ ভিজে উঠবে না কী? দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় কঠোর বিশ্বাসী– ঔপন্যাসিকের স্বঘোষিত উক্তি। সেই পরিক্রমার জোরেই গজার জীবন দর্শনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা বিশ্ববঞ্চিতদের মনস্তাত্ত্বিক অভিক্ষেপকে যেভাবে তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন তা অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য।

এতদিনের পঠন পাঠন এর উপর নির্ভর করে বলছি, অচেনা আকাশ উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠতম কিশোর উপন্যাস। কোনো পাঠকবন্ধু এর চেয়ে ভালো কিশোর উপন্যাস এর সন্ধান দিতে পারলে অবশ্যই ভুল স্বীকার করে নেব।

অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায় : কলকাতা, ভারত

অচেনা আকাশ
মুসা আলি
উদার আকাশ
ঘটকপুকুর, ভাঙড়, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা-৭৪৩৫০২
মূল্য: ২০০.০০

মতামত