মুহাইমীন আরিফের হাইকুগুচ্ছ ‘ইউক্লিডের আঙুলে বৃত্তের চাঁদ’ নিয়ে কলকাতার তিন কবির মন্তব্য

এবারে অমর একুশে বইমেলায় স্বপ্ন ’৭১ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে মুহাইমীন আরিফের হাইকুগুচ্ছ ‘ইউক্লিডের আঙুলে বৃত্তের চাঁদ’। বইটি প্রকাশের পর থেকে পাঠক মহলে এক অন্যরকমের সাড়া ফেলেছে।
বইটি সম্পর্কে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের গদ্যকার ও কবি প্রদীপ চক্রবর্তী বলেন, পৃথিবীর সবচে সংক্ষিপ্ত কাব্যরূপ ‘হাইকু’। ( ৫ – ৭ – ৫) = মোট ১৭, ‘অন’। তিনটি লাইনে। অন হলো জাপানি ধ্বনি-একক, Mora বা ‘কলা’র সমতুল্য। হাইকু কবিতা বেশিরভাগ প্রকৃতি, ঋতু, মুহূর্ত বা দার্শনিক সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত।
জেন ধর্মবিশ্বাস ও যাপনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক, গুরুত্বপূর্ণ হাইকুকরা এই ধর্মাবলম্বী। জাপানি কবিতা ‘রেঙ্গা’-র প্রারম্ভিক স্তবক ‘হোক্কু’র থেকে এর জন্ম। মাসাওকা সিকি এই হাইকু’র নামকরণ করেন। বর্তমানে সমগ্রবিশ্বে বিভিন্ন ভাষায় হাইকু’র চর্চা হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রথিতযশা হাইকুকবি হলেন, মো. মুহাইমীন আরিফ। তাঁর সাম্প্রতিক হাইকুগুচ্ছ নিয়ে যে বইটি প্রকাশিত হচ্ছে, তার নাম, “ইউক্লিডের আঙুলে বৃত্তের চাঁদ”। বইটিতে অসংখ্য উৎকৃষ্ট হাইকু কবিতা আছে। তাঁর হাইকুগুচ্ছ পড়ে মনে হলো, মাৎসুও বাসো, ইয়োসা বুসান, কোবায়াসি ইসা, সিকি, প্রভৃতি হাইকু সম্রাটের যথার্থ উত্তরসূরি তিনি। গভীর, নান্দনিক প্রকৃতি চেতনা, মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে এক প্রগাঢ় দার্শনিক সত্য, জ্যামিতিক উদ্ভাসন, তাঁর হাইকুগুচ্ছে আমরা দেখতে পাই। এই বইটি বহুস্তরীয় হাইকুর সমন্বয়ে স্বয়ং-স্বতন্ত্র যে দৃশ্যায়ন ও জীবনের অন্তর্লীন রহস্য-দৃশ্যমান জীবনের গভীরতর রিয়েলিটিকে তিনি যে দক্ষতায় তুলে ধরেছেন, তাতে বাংলাভাষার সার্থক হাইকুর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আমরা দেখতে পাই। এ ব্যাপারে তাঁর মৌলিকত্বকে অস্বীকার করা যায় না…।
পশ্চিমবঙ্গের আরেক কবি, গদ্যকার ও বাচিকশিল্পী সব্যসাচী হাজরা বলেন, জাপান যাত্রীতে রবীন্দ্রনাথ উদাহরণের মধ্য দিয়ে বলেছিলেন বাকসংযম ও তার সাথে ভাব সংযমের কথা। লিখেছিলেন—‘একে বলা যেতে পারে হৃদয়ের মিতব্যয়িতা’। কবি মো. মুহাইমীন আরিফ সেই সংযমের মধ্যেই নিজেকে যুক্ত করেছেন। সীমিত-পরিসরে খুঁজেছেন উৎসের বৈচিত্র্য। Haiku–এই প্রকাশেই তাঁর উচ্চারণ পাঠককে দিয়েছে অনাবিল তৃপ্তি। ছবির পর ছবি আঁকছ কে? কবিতায় এ যেন এক শব্দ-শিল্পের স্পর্শ। অনুভূতি… অনুভূতি… কবিতা যে ফর্মেই আসুক, সে ‘Haiku’ হোক বা ‘Tanka’, ‘Choka’ হোক বা ‘Katauta’, ইঙ্গিতময়তাই কবিতার প্রাণ। আরিফের কবিতা সেই প্রাণগুণে বাজছে মস্তিষ্ক ও প্রকৃতিতে… সৌন্দর্য স্বীকার করছি, শিকার করছি। আসুন পাঠক, ছুঁয়ে আসি কবির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি উজ্জ্বল-উচ্চারণ, মাপ ও কম্পাস।
‘কোয়ান’ ছোটকাগজের সম্পাদক অভিষেক রায় বলেন, মো. মুহাইমীন আরিফের ইউক্লিডের আঙুলে বৃত্তের চাঁদ ২২০টি হাইকুর একটি প্রণিধানযোগ্য সংকলন। হাইকুর ৫-৭-৫ ছকের চর্চা কবি করেছেন বইটির পাতায় পাতায়। কখনও কলাবৃত্তে কখনও মিশ্রকলাবৃত্তে কাজ করতে দেখা গেছে তাঁকে। হাইকুর মূল উপজীব্য যে প্রকৃতির গূঢ় ও বাঙ্ময় নিস্তব্ধতা, তা বইটির ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। পরিচিত দৃশ্যে যেভাবে তিনি অনির্দিষ্টের সন্ধান দিয়েছেন, তা মোক্ষম ও অব্যর্থ। যথা—
পাড়ের গাছ
পাতায় ছায়া খোঁজে
আড়ের মাছ
উপমাই কবিত্ব—এই কথা হাইকুর সংহত ফর্মের ক্ষেত্রে খাটে না। বীতশোক ভট্টাচার্য এক জায়গায় লিখেছিলেন যে জাপানী ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় ও জেন ধর্মের তটস্থ সংস্কৃতি ছাড়া অন্য সংস্কৃতিতে হাইকু লেখা অসম্ভবপ্রায়। একাধারে ছন্দজ্ঞান ও “হাইকু মুহূর্ত”-কে প্রস্ফুটিত করার মেধা, কবির এই দুই-ই প্রয়োজন। কবি মুহাইমীন আরিফের লেখায় পাই—
কচুপাতায়
বাতাসদোলা জল
ধ্রুপদী নৃত্য
অথবা—
মাছশরীর
জালের সুতোপ্যাঁচ
জেলের হাসি
ও আরও অজস্র হাইকু যা উপরিউক্ত দুইখানি মানদণ্ড অনুযায়ী উত্তীর্ণ। আমরা অনেকেই সমকালে হাইকু লেখার প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছি। সেখানে আলোচিত কবির এই সাফল্য সম্ভবত দু’টি কারণোপদিত—
এক.
তিনি প্রকৃতির সঙ্গে হৃদয়ে ঘনিষ্ঠ সংযোগ অনুভব করেন।
দুই.
তিনি হাইকুতে নিবেদিতপ্রাণ; অন্য ফর্মের কবিতায় তাঁকে প্রায় দেখা যায় না।
এখন বীতশোক বাবুর বক্তব্য সত্য হলে এই কথা স্বীকার করতে হয় যে বইটিতে কবি অসাধ্য সাধন করেছেন ও বাঙলা কাব্যসাহিত্যের নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। অন্যান্য ভাষা নিয়ে মন্তব্য করার মত হিমালয়সদৃশ পাণ্ডিত্য আমার নেই, কিন্তু অন্তত বাঙলায় এই বইটিকে আমি হাইকুর প্রথম সার্থক সংগ্রহ মনে করি। আমার ধারণা দুই বাঙলায় এর সুরভী ক্রমশ ছড়িয়ে পড়বে ও আমরা এর থেকে ‘সুধা নিরবধি’ পান করতে থাকব। আত্মমগ্ন কবি এখনও সুচতুর ও লোলুপ শিকারীর ন্যায় ভাষার গহন অরণ্যে প্রকৃতির গগনভেদী শূন্যতায় হাইকুর খোঁজে চেয়ে আছেন, বড়ই মধুর এ’ লিপ্ততার দৃশ্য!
নভোমণ্ডল
দূরবীক্ষণে চোখ
বৃত্তদর্শন
বই: হাইকুগুচ্ছ : ইউক্লিডের আঙুলে বৃত্তের চাঁদ
কবি : মো. মুহাইমীন আরিফ
প্রচ্ছদ : নিয়াজ চৌধুরী তুলি
প্রকাশনী : স্বপ্ন ’৭১ প্রকাশন
মূল্য :১৬০ টাকা
পাওয়া যাবে : বইমেলা স্টল: ৬০৮, লিটল ম্যাগাজিন চত্বর : ৩৬ খ সারি। এছাড়া রকমারি ডটকম ও প্রথমা ডটকমে।