‘ছুটি’—অনাদরক্লিষ্ট মনুষ্যসন্তানের কাহিনি

‘ছুটি’ শব্দটি প্রতীকী নামকরণ। মৃত্যু অর্থে শব্দটির প্রসারণ ঘটিয়ে রবীন্দ্রনাথ ফটিকের কাহিনির নামকরণ করেছেন এমন। অনুমান করা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর স্মৃতির অনুরূপ পরিণতি ফটিককে দিয়ে বরণ করিয়েছেন ‘ছুটি’ গল্পে। তবে তা ভুল অনুমান। প্রসঙ্গত স্ত্রীকে তিনি ‘ভাই ছুটি’ বলে সম্বোধন করতেন। কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাসের অনুমান প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ‘হৃদয়নদী’ উপন্যাসের ফরহাদ চরিত্রের মাধ্যমে।
সেখানে লেখাটি এভাবে এসেছে—
“… ছেলেকে অন্তিম মুহূর্তে ভবতারিণী হয়তো বলতে চেয়েছিলেন—আমার ছুটি হয়েছে বাবা, আমি এখন বাড়ি যাচ্ছি।”
আগ্রহী পাঠক চাইলে এ প্রসঙ্গে হরিশংকর জলদাসকৃত ‘আমি মৃণালিনী নই’ পড়ে দেখতে পারেন। অবশ্য সে লেখায় এরকম লাইন না পাওয়ারই কথা।
কিন্তু ‘ছুটি’ গল্পে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং অসুস্থ ফটিককে দিয়ে বলালেন—
“মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।”
গল্পটি বাঙলা ১২৯৯ সালে লেখা। ভবতারিণী দেবী মারা যান তার কয়েকবছর পর।
গল্পে ফটিক এক ডানপিটে গ্রাম্য বালক। সেখান থেকে মামার সাথে শহরে আসে ঘটনাচক্রে। কৈবর্তের গ্রাম থেকে শহর কলকাতায় এসে তার মানসিক দুরবস্থা এবং পরিণতিতে মৃত্যু আগাগোড়া একটা মনস্তাতত্ত্বিক ভিতের ওপর দাঁড়ানো। বয়ঃসন্ধিকালীন বালকের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশহীনতা সেখানে প্রকট।
শুরুতেই দেখা যাচ্ছে গ্রামে নদীর ধারে কেউ একজন একটা শালকাঠ ফেলে রেখেছেন সেটি দিয়ে নৌকার মাস্তুল দেবেন বলে। সেই কাঠ নিয়ে গ্রামের দস্যু ছেলেদের ব্যস্ততা।
বলা হচ্ছে—”যে ব্যক্তির কাঠ, আবশ্যক-কালে তাহার যে কতখানি বিস্ময় বিরক্তি এবং অসুবিধা বোধ হইবে, তাহাই উপলব্ধি করিয়া বালকেরা এ প্রস্তাবে সম্পূর্ণ অনুমোদন করিল।”
হয়তো সেই কাঠের ভাবী মালিক যে ব্যক্তি, তিনি নদীতে মাছ ধরার কাজে জাল বাইতে যেতেন নিজের একটা নৌকা হলে। তিনি বিরক্ত হয়ে আর কীইবা করতেন ফটিকদের? দুটো ধমক, তিনটে গালি, বড়োজোর বালকসর্দার ফটিককে ডেকে একটা চড়! দুদিন পর যেই সেই—গা–সওয়া হয়ে যেত সকলেরই সব।
সেই ফটিক মামার সাথে কলকাতায় গিয়ে মামীর যেসব দুর্ব্যবহারের শিকার, সেসবের সাথে গাঁয়ের জীবনে ফটিকের পরিচয় ছিল না বললেই চলে। মামীর অনাদরে শাসন ছিল প্রচ্ছন্ন, ওদিকে মায়ের শাসনে ছিল আদরের মিশ্রণ। দেখা যায়, অবাধ্য ফটিককে ঘরে ফেরাতে বাঘাকে পাঠাচ্ছেন।
বাঘা চরিত্রটি জাতে বাগ্দি। শুরুতে বলেছি কৈবর্তের গ্রাম। রবীন্দ্রনাথ খুব বেশি নিম্নবর্গীয় চরিত্র নিয়ে লিখেছেন, এমন কথা বলার মতো যথেষ্ট প্রমাণ আপাতত নেই আমার কাছে। তবে তাঁর লেখায় বাড়ির চাকর চরিত্রটি পাওয়া যায় নিয়মিত। ঠাকুরবাড়ির চাকরবাকরের প্রাচুর্য হয়তো এর গুরুত্বপূর্ণ কারণ। এদের সঙ্গে বালক রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ভালো ছিল।
একটা বাস্তবতা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের আমল ছিল জমিদারির আমল—নিজেও তিনি জমিদার ছিলেন। সে কারণে নিম্নবর্গ নিয়ে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ তখন ছিল, এমনটা বলারও সুযোগ নেই। এর মধ্যেও ছিদাম-দুখীরাম-রাধা-চন্দরাদের গল্প ‘শাস্তি’ উজ্বল ব্যতিক্রম।
রবীন্দ্রনাথ ‘দুই বোন’ উপন্যাসে লিখেছেন—
“মেয়েরা দুই জাতের, কোনো কোনো পণ্ডিতের কাছে এমন শুনেছি।
এক জাত প্রধানত মা, আর–এক জাত প্রিয়া।”
‘দুই বোন’ উপন্যাসে শর্মিলা চরিত্রে মাতৃরূপের যে নমুনা (চাকর পাঠানো) দেখিয়েছেন, তা ‘ছুটি’ গল্পের ফটিকের মায়ের চরিত্রের সাথে মেলে।
কলকাতার জীবনে ফটিক চারদেয়ালে বন্দিদশায় মামীর ভর্ৎসনা, মামাতো ভাইয়েদের অবহেলা, স্কুলের পড়ার চাপ সইতে না পেরে যে মানসিক অচলাবস্থার শিকার তা গল্পে রবীন্দ্রনাথ এভাবে লিখেছেন—
“প্রকাণ্ড একটা ধাউস ঘুড়ি লইয়া বোঁ বোঁ শব্দে উড়াইয়া বেড়াইবার সেই মাঠ, ‘তাইরে নাইরে নাইরে না’ করিয়া উচ্চৈঃস্বরে স্বরচিত রাগিণী আলাপ করিয়া অকর্মণ্যভাবে ঘুরিয়া বেড়াইবার সেই নদীতীর, দিনের মধ্যে যখন-তখন ঝাঁপ দিয়া পড়িয়া সাঁতার কাটিবার সেই সংকীর্ণ স্রোতস্বিনী, সেই-সব দল-বল উপদ্রব স্বাধীনতা, এবং সর্বোপরি সেই অত্যাচারিণী অবিচারিণী মা অহর্নিশি তাহার নিরুপায় চিত্তকে আকর্ষণ করিত।”
আমরা দেখি, সেই গ্রামস্থ সহোদর মাখনের মতো কলকাতার ভাইদের সাথে তেমন অধিকার সম্পর্কে ফটিক জড়াতে পারেনি। যে অধিকারে কাঠ গড়িয়ে ভাইকে ফেলে দেওয়া যায় মাটিতে অথবা যে উত্তরাধিকার সূত্রে নিজের ছিপ-ঘুড়ি-লাটাই ভাইকে হস্তান্তর করা যায় সেসবের চর্চা শহরে অবান্তর।
ফটিকের মা অথবা মামী—কারোর কাছেই ভাতের ব্যাপারে খোঁটা না শুনতে হলেও ফটিককে, দেখতে হয়েছে আন্তরিকতার তফাৎ। ঘরে ফটিকের অনুপ্রবেশ বিষয়ে বিশ্বম্ভর এবং তার তার বৌয়ের মধ্যে যে শীতল লড়াই চলে, তার আঁচ ফটিকের গায়েও লাগে। এ জায়গাটিতে আমরা ফটিকের আত্মসম্মানবোধের পরিচয় পাই—
“মামীর স্নেহহীন চক্ষে সে যে একটা দুর্গ্রহের মতো প্রতিভাত হইতেছে, এইটে ফটিকের সবচেয়ে বাজিত।”
এরকম বিরুদ্ধপরিবেশে যুদ্ধ করে যতদিন ফটিক টিকে ছিল কলকাতায়, তার মামা একটা অমেরুদণ্ডী চরিত্র হিসেবেই প্রতীয়মান ততদিন। অন্য সব চরিত্রই যথেষ্ট বিকাশ পেলেও মামার ব্যাপারে এমন দৃষ্টিকটু ঔদাসীন্য চোখে লাগার মতো। হতে পারে, তেরো-চৌদ্দ বছরের ছেলের জীবনবাস্তবতার রূঢ় দিকটি স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলতেই রবীন্দ্রনাথ এ কৌশল অবলম্বন করেছেন।