‘কবি’ নিম্নবর্গের সাংস্কৃতিক জীবনধারার প্রতিচ্ছবি

নিম্নবর্গের মানুষের জীবনবোধ, মৃত্যুচিন্তা, পেশা, যৌনতা, প্রেম, বিশ্বাস, রুচিবোধ-এ সব কিছুর ওপর ধারণা পাওয়া সম্ভব, এমন একটি চিরায়ত উপন্যাস ‘কবি’। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শক্তিমান কথাশিল্পে বাঙলার কবিগান আর ঝুমুর গানের শিল্পীদের বারোয়ারি জীবনের আখ্যান হয়ে উঠেছে ‘কবি’। এ আখ্যানের দুভাগে দুটো আলাদা প্রেমের উপাখ্যান শেষমেশ গিয়ে একবিন্দুতে মিলেছে আক্ষেপ হয়ে-
জীবন এত ছোট কেনে?
নিতাইচরণ বীরবংশীর বিদ্যাচর্চা সমসাময়িক অন্যদের তুলনায় ভালো ছিল। আর তাতেই বংশীয় ঐতিহ্য থেকে দূরে সরে লোকসাংস্কৃতিক জীবনে পদার্পণ করে। বংশের সকলের সাথে সেই থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন তার।
গ্রামের এক রেলস্টেশনের ধারের ব্যারাকে তার জীবন যে খুব ভালো কেটেছে তা বলা যাবে না। বরং অস্তিত্ববাদী তাগিদ নিজেই একসময় অনুভব করে নিতাইচরণ। কিন্তু কবিয়াল হয়ে কিছুতেই তার কুলিগিরি করতে মন টানে না। জীবিকার আরও কিছু উপায় সে নানা কারণে আগেই জলাঞ্জলি দিয়ে উঠেছে পুরোনো বন্ধু রাজার কাছে এই ব্যারাকে। রাজাও মাঝেমধ্যে বলত কাজকর্ম কিছু করবার কথা। পাত্তা দিত না নিতাই। তার ব্যারাকজীবনে বিপ্রপদ চরিত্রের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। নিতাইয়ের কবিত্বশক্তিকে হেলাফেলা করবার প্রয়াসে বিপ্রপদ তাকে কপিবর (হনুমান) বলে খেপাত। এ ব্যাপারটি চিরায়ত। সৃষ্টিশীল মানুষকে পেছনে টানা কিছু লোকের মজ্জাগত।
অধ্যবসায়ের প্রমাণ মেলে এই স্টেশন জীবনেই। অল্প কিছুদিন কুলিগিরিতে সততা এবং চৌকস কর্মগুণের পরিচয় দেয় নিতাই। কবিগানে তার দক্ষতাও এখানে প্রকাশ এবং প্রচার পায়। ঠাকুরঝির সাথে প্রেম হয়। নিতাইয়ের বর্ণবাদবিরোধী চেতনা প্রকাশ পায় ঠাকুরঝিকে ঘিরেই –
কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে?
প্রকৃতপক্ষে রাজার সংকীর্ণ বর্ণবাদী মন্তব্যেই এমন প্রতিবাদী প্রশ্ন নিতাইয়ের। রাজার মধ্যে নারী নির্যাতনের বীজও রয়েছে। নিজের স্ত্রীকে কঞ্চি দিয়ে পেটানোর বিবরণ পাওয়া যায় উপন্যাসে। এসব নিতাইকে বিচলিত করত।
নিতাইয়ের দ্বিতীয় প্রেম ঝুমুর দলের নাচওয়ালী দেহজীবী বসন্ত। তার এ প্রেমটা বিয়েতে গড়ায়। বসন্তবন্ধনে নিতাই অনেক বেশি স্বাভাবিক ছিল। তেমন কোনো ছেলেমানুষী আবেগ প্রকাশ করেনি।
ঠাকুরঝির ব্যাপারে পরিমিতভাবে ছেলেমানুষী বিশেষত্ব তার চরিত্রে পাওয়া যায়। সে অংশে যদি একবার চোখ বোলাই –
“অনেকক্ষণ নিতাই চুপ করিয়া রহিল। নির্জনে বসিয়া সে বারবার তাহার মনকে শাসন করিতে চেষ্টা করিল। বারবার সে শিহরিয়া উঠিল। তাহার অবাধ্য মন কিছুতেই শাসন মানিতে চায় না। অবাধ্য মন লজ্জা পায় না, দুঃখিত হয় না, সে যেন কত খুশি হইয়াছে, কত তৃপ্তি পাইয়াছে। ঘরের প্রতিটি কোণে যেন ঠাকুরঝি দাঁড়াইয়া আছে – অন্ধকারের মধ্যে ক্ষারে-ধোওয়া ধবধবে কাপড় পরিয়া সে যেন দাঁড়াইয়া আছে নিতাইয়ের মনের খবর জানিবার জন্য। নিতাই অধীর হইয়া উঠিল, তাড়াতাড়ি উঠিয়া ঘরের জানালাটা খুলিয়া দিল। উদাস দৃষ্টিতে সে খোলা জানালা দিয়া চাহিয়া রহিল রেলের লাইনের দিকে। রেলের সমান্তরাল লাইন দুইটা যেখানে মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছে মনে হয়, সেইখানে নিতাইয়ের আজ মনে হইল একটি স্থির স্বর্ণবিন্দু জাগিয়া রহিয়াছে, সে অচঞ্চল – সে নড়ে না – আগায় না, চলিয়া যায় না, স্থির। ঠাকুরঝি যেন ঘর হইতে বাহির হইয়া ওইখানে গিয়া দাঁড়াইয়া আছে। জানালা খুলিয়া দেওয়ায় রাগ করিয়া চলিয়া যাইবার পথে সে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া দেখিতেছে, কবিয়াল তাহাকে ডাকে কিনা!”
এ অংশে নিতাইয়ের মনে ঠাকুরঝির ব্যাপারে বিবশভাব প্রকাশের প্রয়াস পেয়েছেন তারাশঙ্কর।
সমগ্র উপন্যাসে, অথবা নিয়মিত বিরতিতে যদি নিতাইয়ের মধ্যে এমন ভাবই ধ্রুব থাকত, তবে এ চরিত্রটি একঘেয়ে লাগত। কিন্তু সেরকম কিছু হয়নি।
তারাশঙ্কর লিখেছেন –
“বেলা দ্বিপ্রহরের সময় ঠাকুরঝি আসিল ঘড়ির কাঁটার মত। রেললাইনে জাগিয়া উঠিল সোনার বরণ একটি ঝকঝকে বিন্দু, তাহার পর ক্রমশ জাগিয়া উঠিল কাশফুলের মত সাদা একটি চলন্ত রেখা। ক্রমে কাছে আসিয়া সে হইল ঠাকুরঝি। একমুখ হাসি লইয়া ঠাকুরঝি তাহার সামনে দাঁড়াইল।
– কবিয়াল!
নিতাই অশ্রু-উদ্বেল কণ্ঠে বলিল — ঘরে বাটি আছে, দুধটা রেখে যাও।
সে বুঝিতে পারিল না কেন তাহার চোখে অকারণে জল আসিতে চাহিতেছে।
– না। তুমি এস। আমি এতসব লারব বাপু! আর –
– কি আর?
– রোদে এলাম, বসব একটুকুন।
– না ঠাকুরঝি। এমনভাবে আমার ঘরে বসা ঠিক নয়। দেখ পাঁচজনে দুষ্য ভাববে।
ঠাকুরঝি স্তব্ধভাবে স্থির দৃষ্টিতে নিতাইয়ের দিকে চাহিয়া রহিল।
নিতাই বলিল – বিশ্রাম করবে যদি তো তোমার দিদির বাড়ি রয়েছে। আমি একা বেটাছেলে বাড়িতে থাকি। পাঁচজনের দুষ্য ভাবার তো দোষ নাই। দেখ তুমি বিবেচনা করে দেখ ঠাকুরঝি! তাহার মুখে নিরুপায় মানুষের সকরুণ হাসি ফুটিয়া উঠিল।
ঠাকুরঝি হনহন করিয়া চলিয়া গেল।
নিতাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল।”
এ অংশে তারাশঙ্করের বর্ণনাকৌশলে নিতাইয়ের ব্যক্তিত্বের ভার প্রকাশ পেয়ে চরিত্রের একঘেয়েমির সুযোগ বন্ধ হয়ে গেল।
বসন্ত এবং তার দল ঝুমুর গানে নাচের পাশাপাশি দেহ বেচে জীবিকা নির্বাহ করে। সে আয়ের ভাগ-বাটোয়ারা শেষে আয় খুব বেশি হয় না তার বা তাদের। সাথে আছে রোগশোকের চোখরাঙানি। ঘটনাক্রমে সিফিলিসে মৃত্যু হয় বসন্তর। বসন্ত আখ্যান এ উপন্যাসের অর্ধেকের বেশি জুড়ে আছে।
বসন্তর মরণযাত্রা পর্যন্ত নিতাই সাথে সাথে ছিল। রোগের দোহাই দিয়ে ত্যাগ করেনি। অথচ সাধারণত রাতপরীদের ইতিহাস পরিত্যক্ততার ইতিহাস।
তারাশঙ্কর কোনো শ্রেণিসংগ্রাম দেখাননি উপন্যাসে। তাহলে নিতাইকে হয়তো তার বংশের মান রাখতে বদ্ধপরিকর হতে হতো। বিবরণকৌশলে অবশ্য সে সুযোগ ছিল। শুরুর দিকে নিতাইয়ের পেশীবহুল শরীরের বিবরণ দিয়েছেন প্রসঙ্গক্রমে।
প্রেম মানুষকে পরিবর্তন করে – এ ধ্রুবসত্যের প্রমাণ কবি’র দ্বিতীয় প্রেম – বসন্তের কোকিলরূপে। বসন্ত একজন দেহজীবী হয়ে লজ্জা পাওয়া শুরু করে নিতাইয়ের প্রেমে পড়ে। মদের নেশাসহ অন্য সকল স্বাভাবিক দেহজীবী আচরণ ভুলে যায় সে। আর ওদিকে নিতাই তার কবিগানে খিস্তিখেউড়ের ব্যবহার করতে শুরু করে প্রেমের টানে, জেতার তাগিদে। একেবারে শুরুর দিকে নিতাইয়ের রুচিপছন্দের বিবরণ যা ছিল তা লোকসমাজের সকলের সাথে মিলত না। এসব আসরে সকলে সাধারণত অশ্লীল খিস্তিখেউড়ের তালে তালে নাচ দেখার আকর্ষণেই আসে।
নিতাইয়ের ব্যারাকজীবনে তার আর ঠাকুরঝির প্রেমের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় রাজার স্ত্রী। ফলে সেখান থেকে কলঙ্ক নিয়ে চলে যেতে হয় নিতাইকে। কিন্তু ঠাকুরঝির সংসার ভাঙার ইচ্ছে ছিল না নিতাইয়ের। এদিকে বসন্তর মৃত্যুর পর যখন কাশী হয়ে আবার বাড়ি ফেরে নিতাই তখন ঠাকুরঝিও আর বেঁচে নেই।
বসন্ত উপাখ্যান পড়তে গিয়ে মনে হচ্ছিল ঠাকুরঝির বিকাশ বুঝি কমই ঘটেছে উপন্যাসে। তাতে শাপেবর যেটা, নিতাইয়ের ভাববাদী বিশেষত্ব উন্মোচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে বোধকরি তারাশঙ্করকে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।
শেষদিকে বলা হয়েছে ঠাকুরঝি নিতাইয়ের খোঁজে পাগল হয়ে মরেছে। সিনেমাটিক কাহিনীর বুননে তার ঐ পাগলামির চিত্র যদি আঁকতেন তারাশঙ্কর, তাতে উপন্যাসের কলেবর অযথা দীর্ঘায়িত হতো। সচেতন লেখকসত্তার পরিচয় এটি।
এদিকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নিতাইয়ের কণ্ঠে বারমাসি গাওয়াচ্ছেন। এটা একটা ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ছিল। প্রথাগত পুরুষতন্ত্রের বিপরীতে একটা শক্ত জবাব!
‘কবি’র লেখনকৌশলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অননুমেয় ভাব বজায় রেখে তারাশঙ্কর তাঁর লেখায় পাঠক ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছেন – এ সত্য স্বীকার করতে হবে। উপন্যাস মোটাদাগে বিয়োগান্তক হলেও শেষ পর্যন্ত পাঠক পরিতৃপ্তিতে যে অশ্রুবিসর্জন করবেন, তা সুখপাঠ্য লেখা পড়বার আনন্দের। বেদনা কখনো সখনো আনন্দেরও হয়!
রেজওয়ান আহমেদ, শিক্ষার্থী,বাংলা ভাষা ও সাহিত্য (৬ষ্ঠ আবর্তন), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।