আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’

আহমদ ছফা (৩০ জুন, ১৯৪৩ – ২৮ জুলাই, ২০০১) একজন লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ ও গণবুদ্ধিজীবী ছিলেন। আজ এই প্রখ্যাত কথাসাহিত্যের শুভ জন্মদিন।
বইয়ের নামটা পড়লেই একটা বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়ে যায় পড়ার জন্য। আমারও হয়েছিল। রীতিমত উন্মুখ হয়েছিলাম আহমদ ছফার বইটি পড়ার জন্য। লেখক আমাকে হতাশ করেন নি।
যুক্তি আর দর্শনের মিলে লেখা প্রবন্ধটি বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের সম্পদ। বইটির নাম ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ হলেও বইটিতে ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে মোট ১২ টি প্রবন্ধ রয়েছে। আর বইটির ভূমিকাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে পৃথক একটি প্রবন্ধের মর্যাদা দিতে চাইব।
প্রতিটি প্রবন্ধ কমবেশি আমাদের চিন্তার খোরাক যোগাড়বার ক্ষমতা রাখে। তবে চারটি প্রবন্ধ আমার বিশেষভাবে ভালো লেগেছে। সেগুলো হলো—
বাঙালি মুসলমানের মন, শিক্ষার দর্শন, সুলতানের সাধনা এবং
দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক।
- বৌদ্ধধর্ম যুগের রাজত্ব অবসানের পরে মুসলিম বিজয়ের সময়ে এদেশের বড় সংখ্যার একটি বৌদ্ধ এবং হিন্দুদের অন্ত্যজ (ডোম, হড্ডি, হরিজন ইত্যাদি) জনগোষ্ঠী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। শত বছরের ইতিহাসে রক্তে এসেছে স্রোত। এক রক্ত আরেক রক্তের সাথে মিশে সৃষ্টি করেছে নতুন জনগোষ্ঠী। কিন্তু সেই সুপ্রাচীন সময় থেকে আজ অবধি বাঙলী মুসলমানের চিন্তাধারার মূল কাঠামোটি রয়ে গেছে অপরিবর্তিত। যা বাঙালি মুসলমানদের আধুনিক সময়ে অগ্রগতির প্রধান অন্তরায়গুলির একটি। ধর্মের প্রতি প্রবাহমান এবং পুঞ্জিভূত আবেগ এখানে অনেকক্ষেত্রে তথ্যের বিকৃতির বিরুদ্ধে আঙুল তুলতে বাঁধা দেয়। আর সেই কথাই লেখক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন নিজস্ব যুক্তি, বিশ্লেষণ আর দর্শনের মধ্য দিয়ে।
- শিক্ষার দর্শন প্রবন্ধে একটি নগ্ন সত্য লেখকের লেখায় প্রকটিত হয়েছে। রাষ্ট্র যন্ত্র প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে কখনোই নিখাদ বলা যায় না। রাষ্ট্র নিজস্ব প্রয়োজনে শিক্ষার বিষয়বস্তুতে হস্তক্ষেপ করে এমন কি পুরোপুরি সত্য নয় এমন ইতিহাসের আশ্রয় নেয়। যেমন পাকিস্তান তার শিক্ষার ব্যবস্থায় এমন তথ্যকে ( সে তথ্য যতই ভ্রান্ত হোক না কেন) পৃষ্ঠপোষকতা করবে যেখানে তাদের পরাজয় হবে গৌরবান্বিত আর বাঙালির বিজয় হবে তুচ্ছ (লেখক এখানে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের উদাহরণ ব্যবহার করেছিলেন) এমন কাজ শুধু পাকিস্তান নয়, প্রতিটি রাষ্ট্রযন্ত্র কম বেশি করে থাকে
- সুলতানের সাধনা, মাত্র ২৫ পৃষ্ঠায় লেখক ভারতবর্ষের চিত্রকলার উত্থান, ইতিহাস, ক্রম বিবর্তন সবকিছু বন্দী করেছেন। কে নেই এখানে? ভারতবর্ষের প্রথম ইউরোপীয় রেনেসাঁর বাইরে নিজস্ব ধারার চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা, তার যোগ্য উত্তর পুরুষ নন্দলাল বসু এবং যামিনী রায়ের কথা। আছে আমাকে চিত্রশিল্প জগতের প্রবাদ পুরুষ জয়নাল আবেদীনের সংগ্রামের স্বীকারোক্তি। আর তারপর শেখ মুহম্মদ সুলতানের কথা। যিনি শুধু তুলি আর ক্যানভাসের কাছে নিজেকে সম্পর্ণ করেছেন। ইতিহাসের কাছে নিজেকে অমর করে রাখার বন্দনা করেননি, জীবনের কাছে প্রাপ্তির প্রত্যাশা করেন নি। শুধু চেয়েছিলেন ছবি আঁকতে।
আমার কাছে এই প্রবন্ধটিকে সব থেকে বেশি সমৃদ্ধ মনে হয়েছে। এই প্রবন্ধটি পাঠককে চিত্রকলা বুঝতেও হাতেখড়ি দিতে পারে। তবে পাঠকদের উদ্দেশ্য আমার একটা পরামর্শ থাকবে। এই প্রবন্ধটি পড়ার পূর্বে অবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, যামিনী রায়, জয়নুল আবেদীন এবং এস এম সুলতানের আঁকা কিছু ছবি ইন্টারনেটে দেখে নেবার।
- দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক প্রবন্ধে লেখক বলেছেন, সমগ্র ভারতের সমগ্র জাতিগুলোর মাঝে বাঙালি সবথেকে বেশি প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক। শুনে তাচ্ছিল্য করার কোনো কারণ নেই। এর পিছনে লেখক খুব ভাল একটি যুক্তি দিয়েছেন। একমাত্র বাংলা বাদে হিন্দু মুসলমানের অনেকটা সময় ধরে পাশাপাশি অবস্থানের গৌরব আর কোনো জাতির মাঝে ততটা দেখা যায় না।
উদাহরণ স্বরূপ আমরা আজ পাকিস্তানের পাঞ্জাবিদের কথা বলতে পারি যেখানে হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় শুন্যের কোঠায় আর গুজরাটের কথা বলতে পারি যেখানে ২০০২ সালে মুসলিমের সংখ্যা ৩% এ নেমে এসেছিল। ১৯৪৬ সালের মত দাঙ্গার হবার পরেও এই বাংলার হিন্দু মুসলিম আবার একে অপরের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক নিয়ে বাস করতে পেরেছিল সেটা সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে যেকোনো জাতিদের কাছে দৃষ্টান্ত।
তবে এই প্রবন্ধ লেখক বাংলাদেশিদের পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের অন্ধ অনুসরণ আর অনুকরণে ব্যাপারে সর্তক করে দিয়ছেন। তিনি খুব স্পষ্ট করে বলেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের নিজস্ব সাহিত্যধারাকে উত্থানপর্বে পৌঁছে দিতে যে সাহায্যের প্রয়োজন, সেই সাহায্য দেবার ক্ষমতা অন্তত সেই সময় পশ্চিমবাংলার ছিল না।
পরিশেষে আমি বলব, গল্প উপন্যাস আমাদের তৃপ্ত করে, আমাদের অনুভূতিকে সতেজ এবং তীক্ষ্ম করে তুলতে পারে কিন্তু প্রবন্ধ আমাদের যোগায় চিন্তার রসদ। যা আমাকে জ্ঞানকে বিকাশের পথে নিয়ে যায়। প্রগতিশীল চিন্তা অনুশীলনের প্রধান উপাদান হলো প্রবন্ধ এবং আহমদ ছফার প্রবন্ধগুলি চিন্তার অঞ্চলগুলো আলোড়িত করতে, চঞ্চল করে তুলতে প্রচণ্ডভাবে সক্ষম।
মিঠুন সরকার, ঢাকা, বাংলাদেশ।