বাংলাদেশের আধুনিক ছাপচিত্রের জনক শিল্পগুরু সফিউদ্দীনের ৯৯তম জন্মদিন আজ

শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশের চিত্রকলা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ এবং বাংলাদেশের আধুনিক ছাপচিত্রের জনক। তাঁর জীবন ও কর্মের ওপর গবেষণামূলক বই ‘সফিউদ্দীন আহমেদ’। এই গবেষণাধর্মী বইটির লেখক সৈয়দ আজিজুল হক। সফিউদ্দীন আহমেদের একটি ছাপচিত্র অবলম্বনে প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। বইটি প্রকাশ করে বেঙ্গল পাবলিকেশন্স।
বইটিতে মূলত শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের জীবন ও কর্ম নিয়ে ব্যাপক পরিসরে আলোচনা করা হয়েছে। শিল্পীগুরু সম্পর্ক বিশদভাবে জানার সুযোগ সৃষ্টি হবে। জীবনীগ্রন্থ হিসেবে লেখক শিল্পীর জীবন ও কর্মের একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি আঁকার চেষ্টা করেছেন। শিল্পী–সাহিত্যের, চারুকলার শিক্ষার্থীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বই।
বইটি লেখক তুলে ধরেছেন শিল্পীর জন্ম, পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা, শিক্ষকতা জীবন। শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে করেছেন ড্রইং আর অয়েল পেইন্টিং। ছাত্রজীবনের পর তিনি আর জলরঙে ছবি আঁকেননি। ছাত্রজীবনেই শুরু করেছিলেন উড এনগ্রেভিং মাধ্যমের চর্চা, সেটি লন্ডন যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কলকাতায় শিক্ষকতা কোর্সে অধ্যয়নকালে ড্রাই পয়েন্ট করেছিলেন, তারপর আর করেননি। ওই সময়েই কোর্সের প্রয়োজনে লিথোগ্রাফ ও ম্যুরাল করেছিলেন, কিন্তু পরে আর এ-বিষয়ে আগ্রহ দেখাননি।বইটিতে তাঁর বিভিন্ন পর্বের কাজ সম্পর্কে জানা যায়। তাঁর জলরঙে আঁকা ছবি, ড্রইং, তেলরং, ম্যুরাল, ছাপচিত্রসহ (এচিং, একুয়াটিন্ট, এনগ্রেভিং, ড্রাই পয়েন্ট, উডকাট, লিনোকাট ইত্যাদি) নানা মাধ্যমে আঁকা ছবি তথা শিল্পকর্ম সম্পর্কে জানা যায়। পাশাপাশি জানা যায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর আঁকাআঁকির পট পরিবর্তন, তাঁর শিল্প ভাবনা, জীবনবোধসহ আরও নানামাত্রিক বিষয়।
শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদ ১৯২২ সালে ২৩ জুন ভারতের কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪২ সালে কলকাতা সরকারি আর্ট স্কুল থেকে চারুকলায় স্নাতক এবং ১৯৫৮ সালে যুক্তরাজ্যের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটস থেকে এচিং ও এনগ্রেভিংয়ে সম্মানের সঙ্গে ডিপ্লোমা লাভ করেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে চারুকলা অনুষদ) ছাপচিত্র বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

তিনি দেশে-বিদেশে বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। ২০০৮ সালে ৮৬তম জন্মবার্ষিকীতে বেঙ্গল গ্যালারি অব ফাইন আর্টসের উদ্যোগে বাংলাদেশে তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী হয়। পরে ২০১০ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর সৃষ্টিসমগ্র নিয়ে ‘শিল্পের অশেষ আলো’ শিরোনামে দুই পর্বে দুটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
‘আধুনিক শিল্পকলার চর্চায় বিশেষত ছাপচিত্রের আধুনিকায়নে সফিউদ্দীন আহমেদ পথিকৃতের ভূমিকা রেখেছেন। নিজের কাজের ক্ষেত্রে তিনি সব সময়ই পরিবর্তন ছিলেন। গত শতকের চল্লিশের দশকে তিনি পশ্চিমবঙ্গে সাঁওতালদের জীবন ও প্রকৃতি নিয়ে যে আঙ্গিকের কাজ করেছেন, পরে পঞ্চাশের দশকে সেই আঙ্গিকের পরিবর্তন করেছেন। মাছ ও জেলেদের নিয়ে কাজের মধ্য দিয়ে এক নতুন চিত্রভাষা তিনি উপহার দিয়েছেন। আর পরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এবং বানভাসি মানুষের কাজের ক্ষেত্রে তিনি চোখ ও নৌকার গলুইতে যে আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন, সেখানেও একটি পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট। এমনকি জীবনের শেষ পর্যায়ের কাজগুলোতেও তিনি বাঁক বদল করেছিলেন।’
আমরা তাঁর শিল্পকর্মে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব চিত্র দেখতে পাই। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি শিল্পকর্ম: সাঁওতাল রমণী ( সাঁওতাল গার্লস), ১৯৪৬; মেলার পথে (অন ওয়ে টু ফেয়ার), ১৯৪৭; বন্যার কবলে (ইন দি গ্রিপ অফ ফ্লাড),১৯৫৯, মাছ ধরার সময় (ফিশিং টাইম),১৯৬২; ক্রুদ্ধ মৎস্য (অ্যাংরি ফিশ),১৯৬৪; নীল জাল (দি ব্লু নেট),১৯৭৬; মাছ ধরার জাল (ফিশিং নেট),১৯৭৮; ক্রন্দন (দি ক্রাইং),১৯৮০; জলের নিনাদ (সাউন্ড অফ দি ওয়াটার),১৯৮৫; একাত্তরের স্মৃতি (ইন মেমোরি অফ ৭১)১৯৮৮।
এই কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা ।তিনি ১৯৪৫ সালে কলকাতা একাডেমি অব ফাইন আর্ট প্রদত্ত একাডেমি প্রেসিডেন্ট পদক, ১৯৪৭ সালে ভারতের পাটনার শিল্পকলা পরিষদ প্রদত্ত ‘দ্বারভাঙ্গা মহারাজার স্বর্ণপদক’, ১৯৬৩ সালে চারুকলায় অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত ‘প্রেসিডেন্ট পদক’, ১৯৭৮ সালে চারুকলায় অবদানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত ‘একুশে পদক’ এবং ১৯৯৬ সালে ‘স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার’ লাভ করেন।
শিল্পগুরু সফিউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশের চারুশিল্পের ভূবনে এক মহিরুহ। তিনি আজীবন ছায়া দিয়ে গেছেন। আধুনিক শিল্প-আন্দোলনের অন্যতম এই পথিকৃৎ ২০১২ সালের ২০ মে চিরবিদায় নেন। আজ মহিরুহ, ছাপচিত্রের জনক সফিউদ্দীন আহমেদ ৯৯তম জন্মবার্ষিকী। শিল্পীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
বইয়ের নাম : সফিউদ্দীন আহমেদ
লেখক: সৈয়দ আজিজুল হক
প্রচ্ছদ : শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী
প্রকাশনী : বেঙ্গল পাবলিকেশন্স ।
মূল্য : ৩৭৫ টাকা
প্রথম প্রকাশ : আগস্ট, ২০১৩