সুজন সুপান্থ’র ‘মেঘের ভেতর মীন’: অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকা আশ্চর্য রেলগাড়ি

এ এক সন্তর্পণ রেলগাড়ি, ছোটে না, গড়িয়ে গড়িয়ে যায়, যেতেই থাকে। সমস্ত সন্ধ্যাকে বুকে পুষে আরও ঘোরতর কোনো সন্ধ্যার দিকে, অলিগলি ধরে যেতে থাকে। যেন এক সরীসৃপ, দীর্ঘশ্বাসের মতো গহনবাড়ির গল্প শোনাতে এসে পথ ভুল করে ঢুকে পড়েছে যে সরষে খেতে। এখন শুধুই ঘুরপাক, শুধুই খুঁড়ে আনা তাল-তাল যন্ত্রণার কাদামাটি। এ এক যতন ও যাতনার রেলগাড়ি, যা সওয়ার হতে বলে। বলে, ‘এসো চোখে মাখ আশ্চর্য তেলের ফোঁটা।’ এ হচ্ছে সেই ডুবসাঁতার, যা দিয়ে মীনেরা পাড়ি দেয় মেঘের সায়র। মেঘেরও সায়র থাকে, যেমন থাকে ছায়া। ছায়াবাজ মেঘেরা নেমে আসে পথে, ‘নাচনির বিলে’। সেই বিলে সাঁতরে বেড়ায় ‘মন-মাছের’ দল। তার আঁশটে পিঠে হাত বোলান উবু হয়ে বসে থাকা সুজন সুপান্থ।
সুজন সুপান্থ এক দারুণ সাম্পানের হদিস নিয়ে হাজির হয়ে ‘মেঘের ভেতর মীনে’র সহযাত্রী হওয়ার আহ্বান জানান। সাড়া দিলেই বোঝা যায়, এ শুধু আহ্বান নয়; পরোয়ানাও। সুজন সুপান্থ এই পরোয়ানার কথা শুরুতে বলেন না; বোঝাও যায় না। ‘যাতনার শহরে’র এ বাসিন্দা একটু একটু করে এর অক্ষরগুলোকে মেলে ধরেন। হোলির দিনের আলাপে সন্তর্পণে ঢুকে পড়া, বসত গড়া বিরহলিপির সূত্র ধরে যে জালের বিস্তার, তা মা ‘শায়রা বানু’র আশ্চর্য দাওয়াইয়েও সারে না। হাসিমুখ ধরে রেখে আর ‘সুখী সুখী ঘ্রাণ’ পাওয়া হয়ে ওঠে না। মনে হয়, সে ঘ্রাণ সুদূর। এই হাসিমুখ ও তার আলাপ ও পুনঃআলাপই তার হন্তারক। এই দাওয়াই বরং সেই বকুলের কাছে নিয়ে যায়, যে কিনা ‘অসুখলতার ফুল’; কিংবা নিয়ে যায় সেই ‘বিণুদি’র কাছে, যার নামের পাশে থাকা যোগ চিহ্নের ওপারে নিজের নামটি লিখেও আর বিয়োগ ঠেকানো যায় না।
সুজন সুপান্থ এক অনিঃশেষ ভাসানে ভাসিয়ে দেন লোহার বাসরে থেকেও অনিরাপদ সব লখিন্দরকে। ঘাটে ঘাটে তার বিগত জাদুকরের দল। কোনো ঘাটে ‘মৃত্যুর ভান করে শুয়ে থাকে’ পাখিদের গান শেখানো নয়নতারা, কোনো ঘাটে আবার তুনাই, যে জানে পাখিদের সব গান, গান নয়। এমন অজস্র চরিত্রের সঙ্গে, ঘটনার সঙ্গে পরিচয় ঘটে, ঘটতেই থাকে, আর মোহাচ্ছন্ন এক অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে আশ্চর্য রেলগাড়িটি। সব যে একই সুর মেনে চলে, তা নয়। তবে ফেলে আসা সময়কে, নিজেকে লেখার যে পথ, তা আর একার থাকেনি; স্বজন চেয়েছেন সুজন।
‘মেঘের ভেতরে মীন’ বইটির নামই এই জাদুর দালানের ইঙ্গিত দিয়ে রাখে শুরুতে। পাঠককে বলে ‘প্রস্তুত হও।’ কিন্তু পাঠক একটু অপ্রস্তুতও হয়ে যায় মনে হয়, যখন এ যাত্রায় সঙ্গী হয়ে ঢুকে পড়তে চায়, বিশ্বজিৎ। সেই প্রকাশ্য রাস্তায় মরে যাওয়া বিশ্বজিৎ। ‘মানুষ’ ধারণার পরাজয়ের নিশান তুলে ধরা বিশ্বজিৎ যখন ঢুকে পড়ে রেলগাড়িটির কামরায়, তখন তুনাই, বিণুদি, শায়রা বানুরা একটু জড়সড় হয়ে যায়, যেতে হয়; সঙ্গে পাঠকদেরও। এই অস্বস্তির অনুপ্রবেশ অনাকাঙ্ক্ষিত ঠেকেছে একেবারে। অন্তত ‘বিশ্বজিতের রক্তের রং লাল’ শিরোনামের লেখাটি বইটির মূল সুরের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারতেন লেখক। এর বাইরে দু-একটি অসম্পূর্ণ বাক্য ও বানান বিভ্রাটও অস্বস্তি দেবে। তবে ‘যাতনার শহরে’ তো আর নিখাদ হওয়া সম্ভব নয়।
কাব্যের রসে সিক্ত লেখাগুলোকে ‘কী নামে ডাকা হবে’ প্রশ্ন নিয়ে সংশয়ী সুজন সুপান্থ যতই অস্বস্ত থাকুন না কেন, পাঠককে আহ্বান জানানোর ছলে প্রচ্ছন্ন পরোয়ানায় ঠিকই গ্রেপ্তার করে ফেলেন। আর এই শক্তিটি তিনি পান কবিতার কাছ থেকে, ভাষাভঙ্গির কাছ থেকে।
মেঘের ভেতর মীন
সুজন সুপান্থ
প্রকাশ করেছে: স্বপ্ন ‘৭১ ।
প্রচ্ছদ: মাহফুজ রহমান
প্রাপ্তি : রকমারি ও প্রথমা ডটকম