‘বৃহন্নলা’- একটি খুনের বৃত্তান্ত

‘বৃহন্নলা’ মিসির আলি সিরিজের ছিপছিপে বই। তবে এর বিষয়বস্তু অপরিণত মনের জন্য ছিপছিপে কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসাটা ঝুঁকিপূর্ণ আমার জন্য।
ঘটনা হচ্ছে বহুদিন আগে যখন ‘বৃহন্নলা’ পড়ি তারও বহু আগে বিকৃত রুচির যৌন মনোবৃত্তি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিমিনোলজি কোর্সে কিছুটা পড়েছিলাম। মনিন্দর সিং পান্ধের এবং সুরিন্দর কোলির কেসের কথা বলতে পারি। ‘বৃহন্নলা’র সাথে অবশ্য সুরিন্দর কোলির নরখাদকসত্তার চাইতে মনিন্দর সিংয়ের বিকৃত যৌনতার বেশি সংযোগ। মোজাফ্ফর হোসেনের ‘মিসিং পিৎজা বয়’ গল্পটির মিল পাই সুরিন্দর কোলি নামের লোকটার সাথে।
সে যাক। হোয়াইট কলার ক্রাইম সম্পর্কে এসব কেস পড়তে গিয়েই জানা এবং হঠাৎ আচম্বিতে বাস্তব ঘটনার আলোকে অভিজ্ঞতা অর্জন। সেসবের ট্রায়ালেরও ঘ্রাণ অল্পস্বল্প নাকে এসেছিল তখন। দু’চোখ দেখেছিল ভিক্টিম ব্লেইমারদের অস্তিত্ব আর তাদেরই সদম্ভ আস্ফালন শুনেছিল দু’কান।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এসব ঘটনা হরহামেশাই ঘটে। ‘জানোয়ার’ সিনেমার অনুল্লেখিত ট্যাগলাইন ‘দুর্বল হৃৎপিণ্ডের দর্শকদের জন্য নয়’ আমার জন্য প্রযোজ্য নয়।
বীভৎস রস তাই তুলনামূলক সহজেই গ্রহণ করি বহুদিন হয়।
সুধাকান্ত ভৌমিক বিকৃত রুচির কিনা, তা সরাসরি বলেননি গল্পকার। ভিখু বিকৃত রুচির কিনা, তা-ও আমরা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে পাই না সরাসরি। আমাদের শিক্ষাকে আমরা কীভাবে কতটুকু কোথায় কাজে লাগাতে পারব সেটা আমাদের নিজের হাতেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে পিয়ন-আর্দালি, বাজারের মুটে থেকে ভিক্ষুক, লঞ্চের সারেং থেকে ভিআইপি কেবিনের যাত্রী – সকলেই লিবিডোর চক্রে নিয়ন্ত্রিত।
নিজের সামাজিক অবস্থানের সুযোগ নিয়ে যারা অপরাধ করে, তারা অপরাধবিজ্ঞানের বিবেচনায় হোয়াইট কলার ক্রিমিনাল। এক্ষেত্রে সুধাকান্ত বাবুর এমন সুযোগ ছিল, যার ব্যবহার তিনি করতে চেয়েছেন। মিসির আলির অনুসন্ধান শেষে তিনি নিজেও বুঝে ফেলেছিলেন, মিথ্যে বুঝিয়ে মানুষকে তিনি ভুলিয়ে রাখলেও যুক্তির জালে ফেঁসে গেছেন তিনি। বোধকরি সে কারণেই ধরাও দিয়েছেন নিজকৃত অপরাধ স্বীকার করে। তার পরিণতি হয় থানা হাজতে মৃত্যু।
হরিশংকর জলদাসের ‘রঙ্গশালা’ উপন্যাসে দেখা যায় স্ত্রী-কন্যার আত্মহত্যার জন্য দায়ীর ওপর প্রতিবাদী প্রতিশোধ নিতে গিয়ে চল্লিশ বছর আগে একটা খুন করে ঢাকায় এসে ভিখারিবেশে পার্কে বসে থাকছে এক শিক্ষিত চাকরিজীবী। সে শেষমেশ পুলিশের কাছে ধরা দেবার জন্য প্রস্তুত। তার খুনটি অবশ্যই প্রক্রিয়াগতভাবে সুধাকান্তবাবুর খুনের সাথে তুল্য নয়।
অর্জুন-উর্বশীর পৌরাণিক কাহিনিতে দেখা যাচ্ছে ঘটনাক্রমে উর্বশীর অভিশাপে ক্লীবদশাপ্রাপ্ত হন অর্জুন। এহেন ক্লীবত্বের কারণে অর্জুন বৃহন্নলা নাম গ্রহণ করেছিলেন। সুধাকান্তবাবুর চিরকৌমার্যের যে গল্পটির যেখানে ফাঁকি, সেখানে কথিত বৃহন্নলা যৌনচেতনার ঊর্ধ্বে নন।
মেয়েটার মধ্যে আত্মরক্ষার চেতনা দেখা যায়। সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছে। শেষরক্ষা যদিও হয়নি। মারা যায় সে।
নারীর আত্মরক্ষার বোধের ব্যবহার এসেছে আবু ইসহাকের লেখায়। ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’ উপন্যাসে জয়গুন জোবেদ আলী ফকিরের অন্যায় লালসার হাত থেকে আত্মরক্ষা করতে চুন ব্যবহার করেছিল। গ্রামীণ আবহের বাঙলা চলচ্চিত্রে নারীদের রাতে আত্মরক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র দেখানো হয় দা-বটির মতো ধারালো অস্ত্র, ক্ষেত্রবিশেষে লাঠি।
সুধাকান্তের লালসার শিকার মেয়েটির কাছে এ ধরণের কোনো অস্ত্র ছিল না। তাই শেষ পর্যন্ত কামড়ে আত্মরক্ষা করতে চেষ্টা করেছে সে। সেই কামড়ের জোর এতটাই ছিল যে তা লোকটার পায়ের টিবিও-ফিবুলার মতো শক্ত হাড়ের ওপরও বসে গেছে।
সাধারণভাবে মানুষের কামড়ের দাগ শরীরে অল্প সময় থাকে। এরপর ধীরে ধীরে সে দাগ অন্তর্হিত হয়ে যায়। কেবল নরখাদক সত্তার কামড়েই স্থায়ী দাগ থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। নিজের পায়ের সামনের দিকটায় অমন দাগ প্রতিদিন দেখতে দেখতে মনে মনে সেই মেয়েটার অবয়বের তাড়া খেয়ে ফেরেন রোজ সুধাকান্তবাবু। এই অংশে মোজাফ্ফর হোসেনের ‘মিসিং পিৎজা বয়’ গল্পটি প্রতিতুলনায় আনা যেতেও পারে। সে কারণে সুরিন্দর কোলি প্রসঙ্গ অল্প করে হলেও ‘বৃহন্নলা’র আলোচনায় আসতে পারে।
বিষয়টা এখানে লেখার প্রয়োজন মনে করছি। মনিন্দর সিং পান্ধেরের জন্য সুরিন্দর কোলি আশপাশ থেকে ভুলিয়েভালিয়ে বাচ্চাদের ধরে আনত। তারপর মনিন্দর সিং তাদের সাথে বিকৃত যৌনাচার করতো। এক পর্যায়ে মেরে ফেলে সেই মৃতদেহের সাথে সঙ্গম করতো। কাজ শেষে সুরিন্দর কোলির হাতে পড়তো মৃতদেহগুলো। সে সেগুলো খেয়ে নিত। সুরিন্দর কোলির মধ্যে নরমাংস ভক্ষণের প্রবণতা ছিল।
‘বৃহন্নলা’র সুধাকান্তবাবুর মধ্যে বিকৃত যৌনাচার আর মৃত মেয়েটির মধ্যে নরখাদক বৈশিষ্ট্য দেখানোর প্রয়াস স্পষ্ট ছিল। তাই দুর্বল হৃৎপিণ্ডের ভালো পাঠকের ক্ষেত্রেও কখনো কখনো এ বইটি পাঠের অযোগ্য বলা যেতে পারে।
? রেজওয়ান আহমেদ : শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য (৬ষ্ঠ আবর্তন), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।