তাত্ত্বিক-চিন্তার জগত : সাহিত্যচিন্তা ও বিকল্পভাবনা

বঙ্গ রাখাল Avatar

তখন সময়টা ২০১০। আমি ঝিনাইদহে থাকি। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় পার করছি। কিছু বন্ধু বা বড় ভাইদের সাথে আমরা প্রতিনিয়ত সাহিত্যের নানা বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করি। একদিন জুয়েল ভাই আড্ডা দিতে দিতে বলছিল এবার মেলা থেকে মজিদ মাহমুদ নামে একজন লেখকের একটি বই কিনেছি—কিনে আমার মনে হল আসলেই এই লেখক অন্যদের থেকে আলাদা চিন্তার মানুষ যাকে আমার তাত্ত্বিক বলে মনে হয়েছে। জুয়েল ভাইয়ের সাথে আমার অনেক আড্ডা হয়েছে—চড়িয়ার বিল বাজারের পাশে মৃত ক্যানেলের উপরে ইপিলিকি গাছের নীরব ছায়ায় সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি। কত গল্প, কত কাহিনি- জুয়েল ভাইয়ের সাথে মূলত রাজনৈতিক আলোচনায় বেশি হত। কারণ তিনি ছাত্রফন্ট করতেন—খালেকুজ্জামানের পার্টি। তার সাথে অনেক আন্দোলন সংগ্রামেও গিয়েছি-কুষ্টিয়া বা ঝিনাইদহে। পরবর্তীতে তার সূত্র ধরেই আমার জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রফন্টের ধীমানদা ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আয়াতুল্লাহ ভাইদের সাথেও ভাল সম্পর্ক গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক আলোচনা অনেক হলেও আমি সাহিত্য নিয়ে কথাবার্তাতেই বেশি মজগুল থাকতাম বা থাকতে চাইতাম। সেদিন আড্ডার শেষে জুয়েল ভাইয়ের সাথে তাদের বাসায় গেলাম এবং তার বইমেলা থেকে কিনে আনা বইগুলো মধ্য থেকে মজিদ মাহমুদ-এর ‘সাহিত্য চিন্তা ও বিকল্পভাবনা- বইটা হাতে নিতেই চোখ আটকে গেল বইয়ের প্রবন্ধগুলোর নাম দেখে। বইটি পেপার ব্যাক, প্রকাশ করেছে ওসাকা, মূল্য: ১০০ টাকা। প্রচ্ছদ করা হয়েছে পৃথিবীর প্রথম লাইব্রেরি আর্শাবানিপালে রক্ষিত স্ক্রৌল পাণ্ডুলিপির নমুনা চিত্র অনুসারে।

বইটি নিয়ে বাড়িতে এসেই পড়তে বসলাম। যত ভিতরে যাই যেন মধু। প্রবন্ধগুলোর মধ্যে একধরনের মোহময়তা আছে এবং ইনফর্মেশন তবুও কোন লেখাকে আমার কাছে কঠিন মনে হয়নি। এই বই পড়তে গিয়েই বুঝতে পেরেছি যে মানুষ এমনভাবে বহুমাত্রিকচিন্তা করতে পারে? সে যেমন তেমন মানুষ নয়-নিশ্চিত কোন তাত্ত্বিক বা দার্শনিক হয়ে থাকবেন। যারা বহুমাত্রিক চিন্তা করতে চাই তারা মজিদ মাহমুদের প্রবন্ধ না পড়লে বুঝতে পারবে না। যেমন তিনি এই গ্রন্থের ভূমিকাতে বলেছেন-আমরা যাকে বিকল্প বলি-তার আসলে আলাদা অর্থ হয় না। সাহিত্য চিন্তার ক্ষেত্রে বিকল্পের সুযোগ কম। চিন্তা সবসময় বিকল্প। যে চিন্তা চালু আছে তাকে এগিয়ে নেয়া যেমন জরুরি তেমনি তাকে চ্যালেঞ্জ করা কম জরুরি নয়। চিন্তা সবার মধ্যে একই মাত্রায় ধরা না দিলেও কোথায় যেন নতুন চিন্তার দরকার হয়ে পড়ে- কালের প্রয়োজনে যন্ত্রের বিবর্তনে। তবে সকল কিছুর উপর রয়েছে মানব শরীরের শ্রম ও বাণিজ্যিক দিক- যাকে নিরাপদ ও দখল করার লড়াই সমকালে। আসলে সমকালেই যেন সব কিছু সৃজন বা বিনাশ করে থাকে। সমকালকে আশ্রয় করতে বা সময়কে নিজের করতলে না আনতে পারলে প্রকৃত লেখক হয়ে ওঠা সম্ভব না। আর সেই সমকালীন নানা বিষয়কেই প্রাবন্ধিক আমাদের সম্মুখে হাজির করার চেষ্টা করেছেন। তিনি নতুন নতুন চিন্তার মাধ্যমে সমাজকে নতুনভাবে দেখার প্রত্যয়ে অনেক প্রশ্নকে উষ্মেকে দিয়েছেন আমাদের সম্মুখে। আমরা সব সময়ই বহুলপঠিত বইপত্র নিয়ে আলাপ আলোচনা করে থাকি কিংবা অন্যদের বলে থাকি অমক বইটা পড়তে পার বইটা অনেক ভাল। কিন্তু এই মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া বই ছাড়া আমরা হয়তো বা একজন লেখকের অন্য বইগুলো নিয়ে জানতেও চাই না। তেমনই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহুলপঠিত ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ বা ‘পুতুল নাচের ইতিকথা ‘র কথা সবাই জানলেও তাঁর ‘সহরবাসের ইতিকথা’ বা ‘ইতিকথার পরের কথা’র কথা কয় জনই বা মুখে উচ্চারণ করে থাকি। কিন্তু মজিদ মাহমুদ এই বইয়েরও যে মানিকের অন্য গ্রন্থের চেয়ে গুরুত্ব কম নয় সেটা নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। মানিক ছিলেন রাজনৈতিক সচেতন একজন লেখক। তিনি তাঁর লেখনিতে রাজনীতি বা মানবপ্রবৃত্তিকে আশ্রয় করেই তার উপন্যাস বা গল্পের চরিত্রগুলো নির্মাণ করেন। মজিদ মাহমুদ নিজেই এই প্রবন্ধটির শেষাংশে বলছেন- আমরা শুরু থেকেই মানিক বন্দোপাধ্যায়ের মধ্যে ইতিকথাধর্মী রচনার প্রবণতা লক্ষ্য করি। এর অর্থ কি মানিক কল্পনা নির্ভর রুপকথার গল্প রচনার চেয়ে সমকালীন সমাজের ইতিহাস রচনা করতে চেয়েছিলেন। যার মধ্যে শোনা যাবে মানুষের হাহাকার—বিশেষ করে নিম্নবর্গের মানুষের হৃদস্পন্দন-যাদের ইতিহাস মূলত ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় না। হ্যাঁ মানিক সেই সব কথাই বলতে চান। যা কেউ কখনো বলতে চাই না বা বলেন না। সমাজের গভীর থেকে সেই সত্যকে মানিক তার সাহিত্যকর্মে তুলে আনার প্রয়াস পান।

অন্য একটি প্রবন্ধ বিনয় মজুমদার: নিয়মে অনিয়মে। সেখানে প্রাবন্ধিক বলেছেন- এখানে একটি বির্তক থেকেই যায়, বিনয় শিল্প ও যৌনতার যে সূ² সুতার উপর হাঁটতে চেষ্টা করেছেন—তা কি পুরোপুরী পেরেছেন? জীবনানন্দের পরে যে কবির টিকে থাকা নিয়ে কবিদের মধ্যে বিবাদ মীমাংসিত হয়েছে—নিঃসন্দেহে তাঁর নাম বিনয় মজুমদার। অন্য কবিদের মত বিনয় মজুমদারের কবিতাকে আমরা শুধুমাত্র কবিতার বিচারে বিচার করতে পারি না। কেননা তিনি সৃষ্টি করেছেন- আদি দার্শনিকতার জগত। যেখানে তিনি মিথ্যাকে আশ্রয় করে এই জগত গড়ে তোলেননি। তিনি সত্যের উপর দাঁড়িয়ে নির্মাণ করেছেন ধ্রুবসত্য কবিতা। এখানে সত্যের মিনার তৈরি করাই যেন বিনয় মজুমদারের কবিতা। দার্শনিক গুরু আফলাতুন বা প্লেটো জানতেন কবিরা কখনো সত্য কথা বলেন না- তারা ভুরি ভুরি মিথ্যার কথামালা নির্মাণ করেন। যে কারণে একাডেমিতে কবিদের প্রবেশ নিষেধ। কিন্তু বিনয় নিয়ে বলতে গিয়ে কবি মজিদ মাহমুদ বলছেন- বিনয় মজুমদার আশ্চর্যভাবে বস্তুবাদিতার জগতে চরম বিষ্ময়। এভাবেই নানা প্রসঙ্গকে উপস্থাপন করেছেন এবং তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রবন্ধকে সারল্যভাষায় আমাদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন।

এসব প্রবন্ধ ছাড়াও এখানে রয়েছে—কবিতার দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে, ভাষার আধিপত্য, ভাষা ও সমাজ, বাংলা ভাষা কি বদলে যাচ্ছে, এইমে সিজায়ের: ঔপনিবেশিত চিন্তার ধরন, ঢাকায় উত্তর- উপনিবেশ সাহিত্যচিন্তা, আবু সয়ীদ আইয়ুবের চিন্তাজগৎ, ঢাকাকেন্দ্রিক নাগরিক সমাজ, বিকল্পভাবনা: মানব জাতির টিকে থাকার লড়াই, বুদ্ধিজীবী হত্যার স্বরুপ, গ্রন্থাগার ও সাংবাদিকতা ছাড়াও রয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ। যা প্রাবন্ধিকের একে বারেই নতুন চিন্তা-চেতনার ফসল। এই গ্রন্থে মোট একুশটি প্রবন্ধ রয়েছে। তবে ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে কথা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘সাহিত্যচিন্তা ও বিকল্পভাবনা’ গ্রন্থের ৩য় সংস্করণ। এখানে সংযুক্ত হয়েছে আরো চারটি প্রবন্ধ। অর্থ্যাৎ এবার প্রবন্ধের সংখ্যা পঁচিশ।

যে সব বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবনা আসেনি মজিদ মাহমুদ তা নিয়ে ভেবেছেন এবং আমাদের সাথে এইসব লেখার মাধ্যমে তিনি তাঁর ভাবনাকে শেয়ার করেছেন। তিনি বলতে চাচ্ছেন কবিতার দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে-তবু কবিতা এখনো জয়ী। মানুষের সমাজ যে এখনো রোবটরা দখল করে নেইনি তা জানতে হলে দেখতে হবে- এখনো কেউ কেউ কবিতা লিখছে কিনা। অবশ্য সেই কবিতার ছন্দ, শব্দ ও বাক্যের বিন্যাস কম্পিউটারের গনন যন্ত্র দিয়ে মাপা নয়। সেই কবিতা সুযোগ পেলেই এলোমেলো করে দেবে নিশ্চিত সব ভালো থাকা। সেই কবিতা হবে- নিজের বিরুদ্ধে নিজের লড়াই। প্রথাগত ছন্দ ও অলঙ্কার; গদ্য ও মিশ্র- কবিতার বাইরের লোকজনের কবিতা নিয়ে কথা বলার দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। এখন কবিতা মানে চিন্তা; চিন্তা মানে উপলব্ধি- আর সে উপলব্ধি যে ভাবেই প্রকাশ করা হোক না কেন- কবিতা ছাড়া যার অন্য কোনো নাম নেই। আবার আমরা যদি শহীদুল জহিরের নিয়ে লেখার দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে প্রথমেই দেখতে পাই যে- তিনি শিরোনামে বলছেন শহীদুল জহির ভূতের গলির নিমার্তা। আমরা যারা মজিদ মাহমুদের লেখা পড়েছি তারা নিশ্চয় লক্ষ্য করে থাকব যে তিনি অন্য লেখদের মত অল্প জানা বা শোনা বা হলেই হলো এমন কোন কিছু লেখেন না? তিনি তথ্য-উপাত্ত্য সংগ্রহ করেই লেখতে বসেন। যে খানে সবাই শহীদুল জহিরকে নিয়ে এক ধরনের মাতম করছেন সেখানে মজিদ মাহমুদ বলছেন-বেঁচে থাকতে জহির তেমন পরিচিত ছিল না। তাঁর সহকর্মীরাও অনেকে জানতেন না। বাংলায় যারা গল্প উপন্যাস পড়েন তারাও না। বলা হয়ে থাকে শহীদুল জহির লোকালয়ে থাকতে ভালবাসতেন। লেখকের ধ্যানভঙ্গ করে বাইরে আসা পছন্দ করতেন না। এসব কথা সত্য না। তিনি একটা ক্ষমতাশালী বলয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। থাক সেসব কথা। শহীদুল জহির যে ছোটগল্পে এক ধরনের পরিবর্তন এনেছেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। ভূতের গলি ভাষার একটা সমুদ্র। ভূতের গলির ভাষাকে তিনি অসম্ভব দক্ষতার সাথে সাহিত্যে ব্যবহার করেছেন এবং এই গলির আলাদা জীবন দানে জীবন্ত করে তুলেছেন। শহীদুল জহির মূলত ভাষা লিখেছেন কিন্তু এই ভাষার মধ্যে ধরা পড়েছে ভূতের গলির ইতিহাস।

মজিদ মাহমুদের লেখা মানেই এক ধরনের তাত্ত্বিকধর্মী বিশ্লেষণী হয়ে থাকে। যা সারল্যভাষার মাধ্যমে পাঠককে সহজেই তার লেখার প্রতি আকৃষ্ট করতে পারেন। প্রবন্ধে প্রচুর তথ্য থাকবে তবু তার লেখা পড়তে গিয়ে চোখে ক্লান্তি আসে না বা মনে বিরক্তি ধরে না। আমি যে দিন এই বইটি জুয়েল ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে পড়েছিলাম- সেদিন আমার কোন ক্লান্তি আসেনি বরং দীর্ঘ সময় নিয়ে বইটি একটানা পড়ে শেষ করেছিলাম। সেসময় আমি সত্যিই অবাক হয়েছিলাম তাঁর জানার পরিধি দেখে এবং ভেবে ছিলাম তিনি অনায়াসে একটা জটিল বিষয়কে এত সহজেই ব্যাখ্যা দিতে পারেন। এটাই বুঝি মজিদ মাহমুদের পাঠককে মুগ্ধ করা বা ধরে রাখার মাহাত্ম। যে কারণে দিনকে দিন মজিদ মাহমুদের পাঠক বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তার পাঠক মাত্রেই একটু জানা বোঝা মানুষ হয়ে থাকেন নতুবা তার লেখার সারবস্তু আবিষ্কার করাটা কঠিনই বটে।

বঙ্গ রাখাল : কবি ও লেখক

মতামত