যতটা নির্মোহভাবে ‘দারবিশ ও দখল’ পড়েছি অতটা নির্মোহভাবে ‘আসমান ও রাখাল’ পড়তে পারি নি। এই না পড়তে পারার জন্য সত্যিকার অর্থেই লজ্জিত, সেই সঙ্গে নিজের উপর কিছুটা বিরক্তও বটে। একটি লেখা পুরোপুরি নিরপেক্ষভাবে পড়তে না পারলে তা যেমন সম্পূর্ণ উপলব্ধি করা যায় না, তেমনি আলোচনাও করা যায় না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সেই সময়’ পড়েছি ২০০৯ সালে, ক্লাস সেভেনে পড়ার সময়ে। এমন প্রেক্ষাপটের বই অবচেতনে খুঁজে চলেছি এতদিন। এপার বাংলায় এই প্রেক্ষাপটের বই খুব প্রয়োজন ছিল। ‘সেই সময়’ পড়ে যেমন বিমোহিত ও ব্যথিত হয়েছি, প্রায় এক যুগ পরে সেই একই অনুভূতিদের খুঁজে পেয়েছি লেখক লতিফুল ইসলাম শিবলীর ‘রাখাল’ পড়ে।
‘সেই সময়’ এর চিত্রিত প্রেক্ষাপট ঠিক ‘রাখাল’ এর পরবর্তী অভিযান। ইংলিশ লিটারেচারে অধ্যয়নের সুবাদে মধ্যযুগীয় (১৫-১৬ শতক) ইউরোপিয়ান রেনেসাঁর সঙ্গে বহুল পরিচিত। কিন্তু নিজেদের ভূ-ভাগের পুনর্জাগরণ নিয়ে আমরা অতটা সচেতন নয়, এমনকিও জানিও না অনেককিছু যতটা জানা ও অনুশীলন আবশ্যক।
বাংলার এই নব জাগরণ রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭৫-১৮৩৩) সময়কালে শুরু হয়ে রবীন্দ্রনাথসহ আরও বিভিন্ন গুণীজন এর ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন। ‘রাখাল’ এর কাহিনীকল্প মতে, পূর্বার যেনো এক পুনর্জন্মলাভ। আর তা লেখকের লেখনীতে ও ত্রাণকর্তারূপে আবির্ভূত রামমোহন রায়ের নিরলস কার্যের ফলাফল। ঠিক সেই সময়ে ব্রাক্ষধর্ম বা নব হিন্দুত্ববাদের সূচনা যেনো সতীদাহপ্রথা রোধকল্পেরই এক নিশানা।
ব্রাক্ষসমাজ একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। এদের নেতা বেদান্ত-উপনিষদ থেকে প্রমাণ করেছেন সতীদাহ অশাস্ত্রীয় ও নীতিগর্হিত কাজ। এ বিষয়ে তিনি ‘প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ’ নামক পুস্তিকা বের করলে গোঁড়া হিন্দুরা ‘বিধায়ক নিষেধকের সম্বাদ’ নামক প্রতিবাদ পুস্তিকা বের করে। হিন্দু কলেজের মুক্ত চিন্তার বুদ্ধিদীপ্ত বিদ্রোহী ছাত্রদেরকে সে সময়ে ‘ইয়ং বেঙ্গল’ বলা হত। মুক্তবুদ্ধি চর্চার ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসের অধ্যাপক হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। অন্যদিকে গোঁড়া হিন্দুদের নেতা সংস্কৃত ভাষার অভিধান ‘শব্দকল্পদ্রুম’ এর রচয়িতা রাধাকান্ত দেব প্রতিষ্ঠা করেন ‘ধর্মসভা’।
প্রিয় পাঠক, ঘটনা প্রবাহ এরই মধ্য দিয়ে আবর্তিত হয়ে বাঙালীদের নব জাগরণের প্রতিষ্ঠা করেছে। লেখক সার্থকভাবে চিত্রিত করেছেন নারীদের পতিপত্তি, অধিকার ও শাস্ত্রসংগত সম্মান। সতীদাহ বা সহমরণ বা অনুমরণের মত বিষয়ে কীভাবে বাঙালি সমাজকে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছিল, দেশাচারের নামে হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের শ্লোক পরিবর্তিতরূপ নিয়ে চালিয়ে যাচ্ছিল নারী হত্যাযজ্ঞ। এসব ঘটনা প্রবাহে গল্পের অন্যতম চরিত্র পূর্বা দেবীর ঘটে যাওয়া কাহিনী প্রণালীর উপযুক্ত বর্ণনা, কলাকৌশল, শব্দের প্রয়োগে মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। বইটির বুনন, শব্দের নান্দিক ব্যবহার, সঠিক তথ্যাবলী, আকাঙ্ক্ষা, আসত্তি ও কাহিনীচিত্রের বৈচিত্র্যতা গল্পের প্রথম সার্থকতা।
বই: রাখাল
লেখক: লতিফুর রহমান শিবলী
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা
প্রকাশনী: নালন্দা
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০২০।
মতামত