আওয়াজ

১.
বিকেলের আকাশ বড্ড রহস্যময়৷ সে জলদ অথচ গম্ভীর৷ আবার গম্ভীর অথচ শত্রুভাবাপন্ন নয়৷ জনকসুলভ সুউচ্চ হয়েও সে অবনত মস্তকে তোমার দিকে হাত বাড়াবে অতুল বন্ধুতার৷ জীবনের খেরোখাতা নির্ভয়ে মেলে ধরো তার চোখে চোখ রেখে৷ সে তোমাকে অভয় দেবে৷ দেবে সুচিন্তিত সমাধান ৷
কিন্তু আমাদের গল্পের আকাশ এখন ব্যস্ত৷ তার শিডিউল এখন পুরোটাই সুজলার জন্য৷ অভয়ে আশ্রয় পেয়ে আমাদের সুজলা স্থির করে ফেলেছেন ৷ তিনি আজকের পর আর এই আকাশমুখো ছাদে এভাবে দাঁড়াবেন না৷ এই বদলে যাওয়া ইটপাথরের কাঠখোট্টামি আর ভালো লাগে না তাঁর৷ নিজেও বুঝতে পারছেন, যা করছেন গত কিছুদিন ধরে, তা তাঁর বিবেচনায় বেঠিক কিছু না হলেও চারপাশ তাঁর ওপর বিরক্ত৷ অবশ্য চারপাশ না ঠিক, তিনপাশ৷ শাশুড়ি আর দুই ননদ৷ আরেকজন তো বেশ কবছর হয় ছবি হয়ে ঝুলছেন৷ ছবিটা নিয়ে যেতে হবে৷
মাঝারি সাইজের একটা হ্যান্ডব্যাগে গোটা চারপাঁচ কাপড়ের একপাশে একজোড়া স্যান্ডেল, অন্যপাশে স্বামীর ছবিটা রেখে ব্যাগের চেইন আটকান আর চিলেকোঠার পাশের খোলা ছাদের পূবপশ্চিমজোড়া গুনাটাকে অভিশাপ দেন মনে মনে৷ গফুর মিয়ার টুপিটা বিকেলে ওটাতে লেগেই মাথা থেকে কাঁধে পড়ে৷ অমনি গফুর মিয়া এদিক-ওদিক খুঁজতে থাকে টুপিটা৷ নাহয় সুজলা গিয়ে ওটা উনার মাথায় পরিয়ে দিয়েছেন৷ তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হলো যে এভাবে চিৎকার করে চিলেকোঠা মাথায় তুলতে হবে? সুজলা সব সইতে পারেন, অপবাদ ছাড়া৷ দেশের জন্মলগ্নেই যে অপবাদ আর দশটা মেয়ের মতো তাকে পেতে হয়নি, আজ উনপঞ্চাশ বছর পরে এসে সদ্য ষাটোর্ধ্ব হয়ে পেতে হলো৷ তাও বাড়ির বিশ্বস্ত দারোয়ানকে একটু সাহায্য করার মতো সামান্য ব্যাপারে! এরা এমন কেন? প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজতে খুঁজতে রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েন সুজলা৷ সকালে উঠে চলে যাবেন৷ দুচোখ যেদিকে যায়৷
২.
ডিসেম্বর মাসের বেহায়া শীত । প্রাণপণে শুইয়ে রাখতে চায় মানুষকে । সুজলার পণ অবশ্য ভাঙেনি তাতে । তিনি নাগরিক কোলাহলে মিশে গেছেন ।
দরজাটা আধখোলা রেখে গেছেন সুজলা । ঘরের সবুজাভ দেয়ালের ওপর লালচে আবছাবাতিটা নিভিয়ে যেতে ভুলে গেছেন । অথবা ইচ্ছে করেই জ্বালিয়ে রেখে গেছেন ।
সারা ঘর তন্নতন্ন করে খুঁজে না পেয়ে ভাঙা গলায় চিৎকার করতে করতে চিলেকোঠা ছেড়ে বাইরে এলেন মানসূরা খাতুন, শতবর্ষী বদমেজাজি বৃদ্ধা । সাততলার ছাদ থেকে পাখির চোখে সুজলাকে খুঁজতে খুঁজতে একফোঁটা অশ্রু চশমার মোটা ঘোলা কাচে পড়ে আরো ঘোলা করে দেয় । সে অশ্রুতে ক্রোধ, বেদনা, ক্লান্তি— মিলেমিশে একাকার ।
৩.
তিন ঘণ্টা হয়ে গেছে, বাস একচুল নড়ে না ।
উড়ালসড়কের কাজ চলছে বহুদিন, তাতে খামারবাড়ির পাশের রাস্তাটা সরতে সরতে ইদানীং সংকুচিত হতে শুরু করেছে । আর তাতে প্রাইভেট-পাবলিক সব ধরণের গাড়ির জটলা আরো বেশি কোলাহলের জন্ম দিচ্ছে এদিকটায় । শীতকালেও ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ঠ সকলে। এই শহরে ছারপোকা ছাড়া আর এক ধরণের পোকা আছে, হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডায়ও অস্বস্তিকর গরম বোধ করায় । সুজলার ইচ্ছে হয় সোয়েটারটা খুলে ফেলতে । কিন্তু পাবলিক বাসে সে পরিবেশ নেই । চারপাশে জোড়ায় জোড়ায় নষ্ট চোখ মুচকি হাসছে । সে হাসি উপেক্ষা করে সোয়েটার খুলে আরাম করবার মতো বিলাসিতা দেখাতে সাহস করেন না সুজলা । ওসব চোখে একষট্টি যা, ষোলোও তা-ই । সুজলা সেকথা জানেন । জেনে এসেছেন সেই এগারো বছর বয়স থেকে ।
ঠান্ডা-গরমের যুগপৎ প্রভাবে মাইগ্রেনের ব্যথাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে । সামনের সিটের সাথে মাথা ঠেকাতেই রাজ্যের ঘুম নেমে আসে পোড়া চোখে ।
৪.
কুয়াশা কেটে গেছে । কেটে গেছে সুজলার ঘুমও । শীতকালের সূর্যের সুনাম মানুষ এমনি এমনি করে না । বাসের জানালার বাইরে ঢাউস সাইজের একটা প্রজাপতি জানান দিচ্ছে জায়গাটা কারওয়ানবাজার ।
একটা দশাসই চড়ের শব্দে সম্বিত ফেরে সুজলার । ভাড়া নিয়ে বচসায় এরকম চড়চাপড় দুয়েকটা কন্ডাক্টর খায়, জানতেন সুজলা। কিন্তু আজ কোনো বচসা নয় – ডাইরেক্ট অ্যাকশন ! মুখও ছুটছে মেয়েটার !
“জানোয়ার কোথাকার ! তোর মা তোকে জন্ম দেওয়ার পর লবণ খাইয়ে মারেনি কেন ?! জানত না তোর চোখ খারাপ ?! এক্ষণ নামবি বাস থেকে, না হলে হাত ভেঙে দেব !”
হাত ভাঙার কথা শুনে ছেলেটা মাথা নিচু করে বাস থেকে নেমে যায় । হয়ত আরেকটা বাসে আরেকটা মেয়ের শরীর ছোঁবার লোভে । তারপর আরেকটা । তারপর আরেকটা ।
৫.
বাংলামোটরের ফুটওভারব্রিজের ওঠানামার সিঁড়ি পিচ্ছিল । বছরবিশেক আগে একটা পত্রিকায় চিঠি দিয়েছিলেন সুজলা । চিঠিগুলো কবুল হলেও দাবিদাওয়া কবুল হতে চায় না সহজে । না হলে মাত্র তিনধাপ বাকি থাকতে পিছলে পড়বেন সুজলা ? বিশ্বাস হতে চায় না ব্যাপারটা । তবু আমরা বিশ্বাস করি । বাসে যা দেখে এসেছেন, তা তাঁকে তাঁর শাশুড়ির অগ্নিমূর্তি মনে করিয়ে দেয় । চিলেকোঠার সংসারটার কপালে ঝাঁটা মেরে চলে এলেও খারাপ লাগে তাঁর ।
লোকজনে ধরাধরি করে সুজলাকে তুলে ওঠায় ব্রিজের গোড়া থেকে । ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ৩৬৩ নম্বর মামণি ভিলার চারতলায় পৌঁছে দেয় দুজন । এটা ফাইজাদের বাসা । মেয়েটা বেশ বড়ো হয়ে গেছে । ওর বিয়ের কথা চলছে ।
ব্যাপারটা পছন্দ হয় না সুজলার । আঠারো হলেই মেয়েকে তাড়ানোর জন্য এত তাড়া দেয় কেন সমাজ ? এখন কি আর আগের যুগ আছে ? কিন্তু সুজলা অসহায় । চোখ-হাত-পায়ে আর কতখানি বোঝানো সম্ভব ?
৬.
বছর ঘুরে গেছে । ফাইজার বিয়েটা হয়নি সেবার । এবারও তাড়া নেই মেয়ে পাত্রস্থ করার ।
সুজলার হাবেভাবে বিরক্তি । কেউ বলে বয়সের দোষ, কেউ বলে হাওয়াবদল চাই । ডাক্তার দেখালে বোঝা গেল আলঝেইমারের প্রাথমিক পর্যায় চলছে ।
কেউ বুঝে উঠতে পারার আগেই সুজলা নিজের পথ নিজে খুঁজে নেন । তিনি ভাইয়ের বাসা ছেড়ে পাড়ি জমান অজানায় ।
হেঁটেই নিউমার্কেট পর্যন্ত চলে যান । বলাকা সিনেমা হলের লাগোয়া ওভারব্রিজে উঠে দাঁড়ান । নিজের অজান্তেই চোখ চলে যায় সিনেমা হলের বিলবোর্ডে । গেরিলা চলছিল বলাকায় । বিলবোর্ডে নিজের ছবি দেখে পাগলের মতো ছুটে যান ।
৭.
১২ ডিসেম্বর ২০২১ । স্ক্রিনটেস্টে পাস করেছেন সুজলা সিদ্দিকা । ‘বৃত্ত’ সিনেমায় জয়া আহসানের আপন বড়ো বোনের চরিত্র করবেন তিনি । ১৯ ডিসেম্বর থেকে শুটিং শুরু । এই সপ্তাহ স্পিচ থেরাপি নেবেন । যদি কথা না বলতে পারেন শুটিংয়ে, ডাবিং করবেন অন্য কেউ ।
১৬ ডিসেম্বর ২০২১ । প্রডিউসার সুজলার সাক্ষাৎপ্রার্থী । তাঁর সল্টলেক সিটির বাড়িতে নিজে এসেছে । সাইনিং মানি সুজলা আগেই নিয়েছেন । তবু অতিরিক্ত ৫০০০০ রুপি সাধে এ অর্বাচীন । অ্যাসিস্ট্যান্ট সুজলার পক্ষে অস্বীকৃতি জানালে তাকে চোখের গরমে ভেতরে পাঠিয়ে দেয় প্রডিউসার ।
অ্যাসিস্ট্যান্টের ভাবনায় আসেনি শ্রীযুক্ত রমণীমোহন ঘোর সুজলার দিকে লোভের হাত বাড়াবেন ।
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হাতে সুজলাকে ক্ষুদেবার্তা পাঠায় সুবিমল মুখোপাধ্যায় – Maam, Pls Handle the situation yourself. And forgive me for any inconvenience.
সুজলা ভাবে, গত বছর কেউ ছিল না পাশে । আজও নেই । যা আছে তা নিয়েই বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে ।
৮.
‘বৃত্ত’ ছবিতে সুজলা সিদ্দিকা অভিনয় করেছিলেন, আলাদা কোনো প্রকার ডাবিং আর্টিস্ট নিতে হয়নি । নতুন প্রোডাকশন হাউজে, নতুন স্ক্রিপ্টে ।
এ স্ক্রিপ্টে সুজলার নিজের জীবন থেকে নেয়া একটা সংলাপ ছিল –
“জানোয়ার কোথাকার ! তোর মা তোকে জন্ম দেওয়ার পর লবণ খাইয়ে মারেনি কেন ?! জানত না তোর চোখ খারাপ ?! এক্ষণ চলে যাবি বাসা থেকে, না হলে হাত-পা ভেঙে রেখে দেব !”
(ঘটনা ও চরিত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক)
রেজওয়ান আহমেদ : শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য (৬ষ্ঠ আবর্তন), বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।