হাসান হামিদের তিনটি অনুগল্প- গল্পত্রয়ী

ইনবক্স
রাত আড়াইটা নাগাদ মোবাইলের স্ক্রিন জ্বলে উঠলো।
পাশ ফিরে হাতে নেয়ার চেষ্টা করলাম। অচেনা নম্বর থেকে ম্যাসেজ, এতো রাতে। পড়ার জন্য বারান্দায় চলে যাওয়া দরকার। পাশেই মুন্নী ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। এয়ারকন্ডিশন চলছে ঘরটায়। তবু ঘেমে নেয়ে আছে মুন্নী। ও ভীষণ ক্লান্ত। মুন্নী আমার স্ত্রী। আমাদের বিবাহিত জীবনের প্রায় ছ’বছর আমরা পার করে ফেলেছি। ওর সাথে আমার সম্পর্ক এখনকার অন্য দশটা দম্পতির তুলনায় ভালো। আমাদের কোনো সন্তান নেই। এই একটি বিষয় ছাড়া মুন্নীর কোন অতৃপ্তি বোধ হয় নেই এই সংসারে।
আমরা এখন যে বাসাটায় আছি, বেশ পুরোনো ধাচের। এসেছি আজ এগারো দিন। এর আগের বাসাটায় বিয়ের পর থেকে প্রায় অর্ধ যুগ কাটিয়েছি। স্বাভাবিক ভাবেই বাসাটা ছাড়তে মন চায়নি। কিন্তু বাসাটা নতুন করে ডেভেলপার কোম্পানিকে দিয়ে দিয়েছেন মালিক। অগত্যা আমাদের নতুন বাসা খুঁজতে হলো। বেশি বেগ অবশ্য পেতে হয়নি। তুলনামূলক সহজেই এই বাসাটা পেয়ে গেছি। এ বাসায় যেদিন আসি সেদিনের ঘটনাটা আগে বলি।
বাসা বদলের ঝক্কি ঢাকা শহরে কতটা তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ কল্পনা করতে পারবে না। অফিস থেকে দুদিনের ছুটি নিয়েছি। এই আগেই বাক্স পেটরা সব গুছিয়ে রেখেছি। নির্ধারিত দিন সকাল সকাল চলেও এসেছি। সব গুছিয়ে খুব ক্লান্ত হয়ে দুজন চা বানিয়ে খেয়েছি। মুন্নী বলছিলো, পেঁয়াজ নেই।
আমি পেঁয়াজ কিনতে নিচে নামলাম। আচ্ছা, এই ফাঁকে বাসার একটু বিবরণ দিয়ে নিই। বাসাটা বেশ পুরানো। আর এমন বলেই আমার বেশি পছন্দ হয়েছে। দু তলা বাড়ি। আমরা ভাড়া নিয়েছি দুতলার তিনটা ঘর। নিচ তলা খালিই পড়ে আছে। মালিক বললেন, পছন্দমতো মানুষ না পেলে ভাড়া না দেয়াই ভালো। তাই কয়েক মাস খালিই পড়ে আছে। আমাদের বেশি পছন্দ হবার আরেকটি কারণ এ বাড়ির প্রশস্ত ছাদ। বারান্দাগুলো বেশ বড়। স্নান ঘর বিশাল আকারের। এক কথায় এক দেখাতেই আমাদের পছন্দ হয়ে যায়। তাছাড়া ভাড়াও তুলনামূলক কম।
পেঁয়াজ কিনতে নিচে নেমে দেখি, কয়েক গজ দূরেই একটা দোকান। আমি গিয়ে দোকানির কাছে পেঁয়াজ চাইলাম। দোকানি মনে হয় বেশ পুরানো। এ এলাকায় অনেক দিন আছেন। দোকানের অবস্থান ও আসবাব দেখে বোঝা যায়, এর বয়স চল্লিশের কম নয়। দোকানি এ এলাকায় আমাকে এর আগে দেখেননি। পেঁয়াজের ব্যাগ আমার হাতে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি এখানে নতুন? কিছু মনে করবেন না। এখানে যারা থাকেন, আশেপাশের সবাই আমার চেনা। আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না তাই।
আমি হেসে বলি, জি, আমি এ এলাকায় নতুন। ওই বাড়ির দু তলায় ভাড়া নিয়েছি। হাত তুলে বাড়িটা দেখাই আমি।
দোকানি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললেন, কোন বাড়িটায়?
আমি বাড়ির দিকে আঙুল তুলে দেখাই।
দোকানি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি জানেন এ বাড়ির- বলেই থেম গেলেন। আমি বললাম, থামলেন কেন? কোন সমস্যা?
উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন, না না, ঠিক আছে।
আমি দাম মিটিয়ে চলে আসি। আসতে আস্তে ভাবি, কী বলতে চাইলো দোকানি। এ বাড়ির কথা শুনেই বা এমন বিস্মিত হবার কী আছে? তাছাড়া আমি অলৌকিক কিছুই বিশ্বাস করি না। পরদিন অফিসে গিয়ে কাজের চাপে দোকানির এসব কথা বেমালুম ভুলে যাই।
নতুন সংসার না হলেও বাসা গুছানোর আরও অনেক বাকি। মুন্নীকে সব বুঝিয়ে আমি অফিসে যাবার জন্য বের হয়ে যাই। অফিসে দু দিন পর আসায় অনেক কাজও জমে ছিল। কাজ করতে করতে কখন সময় যাচ্ছিল টের পাইনি। দুপুর নাগাদ মুন্নী ফোন করে। কাঁদতে কাঁদতে বলে, তাড়াতাড়ি বাসায় এসো। আমার ভয় করছে। কে যেন বাথরুমে বসে আছে।
আমি হেসে দিই। বুঝতে পারি, মুন্নী ফান করছে। কিন্তু মুন্নীর কান্না শুনে তখনই বাসার দিকে রওয়ানা হই।
বাসায় গিয়ে দেখি মুন্নী বসার ঘরে শুয়ে আছে।
সে একেবারে স্বাভাবিক, কিছু হয়েছে বলে মনে হয় না আমার। মুন্নীকে জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে বলো তো?
মুন্নী হাসতে থাকে। এই হাসির দুটো অর্থ আছে। এক, সে ব্যাপারটা হালকা করার চেষ্টা করছে; দুই, এ নিয়ে আর কিছু বলতে চাচ্ছে না। কিন্তু দুটো অর্থই বিপজ্জনক। আমি তাই ওর হাত ধরে বললাম, তুমি কান্না করছিলে কিছুক্ষণ আগে, কোনো সমস্যা?
ও উত্তর না দিয়ে উল্টো আমায় জিজ্ঞেস করে, চা খাবে?
আমি এবার বুঝতে পারি, যাই ঘটুক ও ব্যাপারটা আড়াল করতে চাইছে। তাই আর এ নিয়ে কিছু বলি না। চা দিতে বলে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই। এরপর প্রতিদিনের মতো রাতের হাবার খেয়ে শুয়ে পড়ি আমি। মুন্নী কী একটা মুভি দেখছিলো। এরপর আর কিছু মনে নেই। আমি কিছুক্ষণের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই। গত কয়েকদিন ধরে বেশ খাটা খাটনি গেছে। খুব ক্লান্ত হয়ে ছিলাম আগে থেকেই।
রাত কয়টা বাজে ঠিক খেয়াল নেই, তবে বেশ রাত; সম্ভবত তিনটার দিকে একটা গোঙানির মতো আওয়াজে ঘুম ভাঙে আমার। আমি শোবার ঘরে লাইট না জ্বালিয়েই বারান্দায় যাই। ফিনফিনে অন্ধকার। ঝাপসা একটা গুমোট আলো আসছে পাশের ল্যামপোস্ট থেকে। সিগারেট ধরাই একটা। কয়েক টান দিতেই আবার শব্দটা কানে আসে। আর বিস্ময়ের সবচেয়ে বড় কারণ হলো শব্দটি আসছে আমাদের ফ্ল্যাটের কোনো একটা রুম থেকে।
আমি প্রায় দৌড়ে ভেতরে প্রবেশ করি। না, শব্দটা নেই। কিছু কি শুনেছি? হয়তো! বাথরুমের দরজার দিকে এগিয়ে যাই। খোলা দরজা। ভেতরে ঢুকে আমি চিৎকার করে ওঠি। একটা লোক কোমডে বসে আছে। আমাকে দেখে অপ্রস্তুত ভাবে হাসছে।
লোকটির বয়স চল্লিশের কম নয়। মুখে দাড়ি, যার কয়েকটি আবার সাদা হয়ে গেছে। নোংরা জামা কাপড় পড়া। চোখ লাল হয়ে ফুলে আছে। আর তার গা থেকে আসছে পচা একটা গন্ধ।
আমি দৌড় দিয়ে বেড রুমে যাই। দেখি মুন্নী নেই। খাটে শুয়ে আছে সেই লোকটা। এবার আমি মূর্ছা যাই। মেঝেতে পড়ে যাই। আর কিছু মনে নেই।
আমার যখন জ্ঞান আসে, অথবা ঘুম ভাঙে তখন সকাল আটটা। চৈত্র মাস। কড়া রোদ ঘরের ভেতরে উঁকি দিচ্ছে। ব্যাপসা গরম। আমি খাটে শুয়ে আছি। তবে মুন্নী পাশে নেই।
কিন্তু কয়েক মিনিটের মাথায় মুন্নী ঘরে ঢুকে। ওর হাতে চায়ের কাপ। আমার দিকে এগিয়ে দেয়। আমি পাশে রাখতে বলি। আমি বুঝতে পারছি না, রাতে আসলে কী হয়েছিলো। মনে করার চেষ্টা করলাম। রাতে আসলে কিছু ঘটেছিল কিনা সেটাই বুঝতে পারছি না। মুন্নীকে কি বলা যায়? ও কি হাসবে?
চায়ে চুমুক দিতে দিতে মোবাইলটা হাতে নিই। হুম, ম্যাসেজটা এখনো আনরিড।
২.
প্রাপ্তবয়স্ক ভূত
দুপুর নাগাদ সবাই জেনে যায় একটি বস্তাবন্দি পচা লাশ পাওয়া গেছে, দোকানদার রমিজ মিয়াকে খবর দেয়া হয়।
রমিজ মিয়ার চায়ের দোকান আমাদের বাড়ি থেকে কাছেই। আমাদের গ্রামটি পুরোপুরি গ্রাম নয়; আধা শহর- আধা গ্রাম। গ্রামের উত্তরমাথায় আমাদের বাড়ি। আর বাড়ির পাশে ছোট কালভার্টের একদিকে রমিজ মিয়ার দোকান। এই ব্যবসার বয়স ষাটের কাছাকাছি। সেই শুরুর দিন থেকে আজও এখানে বসে চা খেতে খেতে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ জমায় ছেলে-বুড়োরা। প্রতিদিন অন্য সব যাপন করা না গেলেও এই আড্ডার কোনো হেরফের হয় না।
প্রায় পাঁচ যুগ ধরে এখানে জমে থাকে দিন, জমা থাকে জীবন। আর এ দোকান নিয়ে রমিজ মিয়ার গর্বও আছে। এখানে দেশের অনেক নেতা, যারা দেশ গড়েছেন, ভেঙেছেন; তারা অনেকেই চা খেয়েছেন। নিজের হাতের দিকে চেয়ে প্রায়ই রমিজ মিয়া আমাদের বলেন, ‘‘বুঝলা বাবা, এই হাত দিয়া কত জনরে চা বানাইয়া খাওয়াইলাম; এই ধরো শেখসাব, ভাসানীসাব কারে না খাওয়াইছি!’’
কথা কিন্তু সত্য আছে। ষাট বছর কম কথা না। রমিজ মিয়ার বাপে দিছিলো এ দোকান। বাপ বুড়ো ছিল তার, আটবছর যখন বয়স; তখন থেকেই বাপের সাথে দোকানে বসতো সে। সময়ে সাধারণকেও অসাধারণ করে। সকাল থেকে রাত অবধি রমিজ মিয়া মানুষটা আসলে আপাদমস্তক এ দোকানটিই। আরও একজন অবশ্যি আছে তার; মা-মরা মেয়ে কুসুম। বয়স এগারো। পাশের স্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে।
কুসুম যখন অন্য অকাজে ব্যস্ত না থাকে; অথবা ছেঁড়াকাঁথায় পা ডুবিয়ে পড়তে আর ইচ্ছে করে না ঘরের একমাত্র কক্ষটিতে; তখন বাবার সাথে ইতিহাস নিয়ে গল্প জমায়। বাবা ভূতের গল্প শোনাতে চায়, কুসুম ওসবে বিশ্বাস করে না; স্কুলের স্যার তাকে বলেছে, ভূত বলে কিছু আদতে নাই। বাবাকে পড়ার ফাঁকে কাজেও সাহায্য করে । সেবার রমিজ মিয়া জ্বরে পড়েছিল, এক-দুই দিন নয়; পনেরো দিন। সেকি জ্বর! যেমন তেমন নয়। উঠে দাড়ানোই দায়, দোকানে যাবে কীভাবে। দোকান বন্ধ করার উপক্রম হলো। কুসুম বললো, বাবা, আমি বসবো দোকানে। টানা দুই সপ্তাহ বিজ্ঞ দোকানি হয়ে সব করলো সে। এমনভাবে সামলেছে, মনে হয়েছে এ ব্যবসা কতোদিন ধরে সে-ই চালায়।
সকাল বেলাটা ভারী ভালো লাগে কুসুমের। এই সময়টাতে পাশের মসজিদে কুরআন পড়তে শেখে টানা দুই ঘন্টা। ইমাম হুজুর লোকটা ভালো। রমিজ মিয়ার সাথে সম্পর্কও দারুণ। কথায় কথায় কুসুমের প্রশংসাও করেন হুজুর। সকালের প্রথম চা-টা রমিজ মিয়া তাই হুজুরকে দিতে ভুলে না।
একদিন সকাল থেকেই বৃষ্টি। কুসুম পড়তে যায়। গিয়ে দেখে ইমাম হুজুর মসজিদের বারান্দায় শুয়ে আছেন। বৃষ্টি আরও বেড়ে যায়। আর কেউ আজ পড়তে আসবে বলে মনে হচ্ছে না। কুসুম হুজুরকে বলে বাড়ি চলে যাবে কিনা। হুজুর তাকে পড়তে বলে। কুসুম জোরে জোরে পড়তে থাকে।
হুজুর কুসুমকে বলেন, বুঝলা কুসুম, রাত বিরাতে বের হয়ো না। এমুন ঝড় বৃষ্টির সময়ে জিন-পরিদের আনাগোনা বেড়ে যায়। তাছাড়া তুমি তো ঘরে একা।
কুসুম বলে, না হুজুর, বাবা আমার লগেই থাহে।
হুজুর বলেন, আরে সেইটা না। মাইয়া মানুষ তো তুমি একা। ভূতে যদি আইসা ধরে, উপায় আছে?
কুসুম বাধা দিয়ে বলে, কিন্তু বিজ্ঞান স্যার তো কয় ভূত বলে কিছু নাই।
‘ওয়াস্তাগফিরুল্লাহ’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন হুজুর। একটু পরে বাতাসের বেগ আরও বাড়ে। কুসুম এবার বাড়ি যেতে চাইলে হুজুর বৃষ্টি দেখিয়ে বললেন, বান কমুক, তারপর যাবা। কুসুম জোরে জোরে পড়তে থাকে। হুজুর তার পাশে আধশোয়া। অদূরে আচমকা বাজ পড়ে কোথাও।
এদিন আর কুসুম বাড়ী যায়নি। পরদিন কুসুমের লাশটি পাওয়া যায় পাড়ার পাশের ডোবায়।
৩.
আড়াল
আমি মারা গেছি আজ ভোর রাতে।
এর কিছুক্ষণ পর থেকেই আমার লাশটা মেঝেতে পড়ে আছে। জিভের অনেকটা কাত হয়ে ঝুলছে। বাকিটা শুকিয়ে সাদা হয়ে গেছে বকের পালকের মতো। দাঁত বসে গেছে তাতে, রক্তাভ লালা চুইয়ে পড়েছিল খানিক আগেই, এমন আন্দাজ সহজেই করা যায়। আমার বাম হাতের শক্ত মুঠো খামছে ধরে আছে পাজামার ফিতে। ডান হাত নিস্তর হয়েও মাঝে মাঝে দোলে ওঠছে পেন্ডুলামের মতো।
সকাল সাতটা নাগাদ পুরো গ্রাম জুড়ে রাষ্ট্র হয়ে গেল সব। সবাই জেনে গেলো যে, আলিমুদ্দিনের ক্লাস নাইনে পড়া মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। পুরো এলাকায় ছি ছি পড়ে গেলো। আমি তখনও মেঝেতেই। নাহ, ফ্যান থেকে ওড়নাটা খোলার পর কেউ আমার গায়ের তিলটা পর্যন্ত স্পর্শ করেনি। আর করবেই কেনো; আমি তো আপাদমস্তক অপয়া। আমাকে ছোঁয়া সমাজ-স্বীকৃত কর্ম নয়। আমাকে ছোঁয়ার সাহস করে ওঠা লোক এখন আর জন্মায়? ইতিহাসের সেইসব মানুষেরা মরে অনেকের বাঁচার রাস্তা সহজ করেছে। আর এদের নিরেট নিঃশ্বাসে ভারী হয় আজকের সভ্যতার সমস্ত বাতাস।
আমি গত রাতে বাড়ি ফিরেছিলাম। নিরুদ্দেশ হবার দুই মাস পর। কাল যখন ফিরেছি, পুরো গ্রামসুদ্ধ লোক জড়ো হয়েছিল আমাদের উঠোনে। আমি যখন হেঁটে আসছিলাম, চেনা পথ-ঘাট, আমাদের বাড়ির সামনের পুকুর, নীলুফা আপাদের দেউড়ি সব কেমন অচেনা মনে হচ্ছিল। আর কতজনে কত কী যে বলছিল। আমার মায়ের বসে যাওয়া ডিবির গর্তের মাঝে ফোলা ফোলা চোখ, সংসারের কালিঝুলি মাখা হাত আর ডান হাতের কাটা আঙুলের মরা দাগ দেখেই বুঝেছি, গত দুই মাস মায়ের ওপর দিয়ে কী যে গেছে।
আর বাবা? কম বয়েসী মুসলমান মেয়ে অন্য ধর্মের বখাটে ছেলের সাথে পালালে যেমন হবার কথা, তেমনই। কেউ কেউ বললো, ছি ছি! এই মেয়ে না ফেরাই তো ভালো ছিল। অথচ আমি জানি, ঠিক এরাই না ফেরার সময়; আমি যখন নিখোঁজ হয়ে ছিলাম, তখন বলেছে, যেমনই হোক; মেয়েটা যদি ফিরে আসতো, আহা, বাদবাকি দিন মা বাবার সামনে অন্তত থাকতো। চুন থেকে পান খসিয়ে কেউ আবার বললো, এবেলা নিশ্চয়ই পেটে বাচ্চা নিয়ে এসেছে। দেখলে না, কীরম ফ্যাকাশে হয়ে আছে গতর।
আমার বুঝতে বাকি ছিল না, মায়ের যত্ন-আত্তিতে গড়া বাবার মূর্তিটি হারিয়ে গেছে আমার অপমানে তৈরি আজকের সামাজিক আবহের কাছে। আমার আসলে আর কিছুই করার নেই। আমি নিজের ভেতর শুধু নিজের জন্য কবর খুঁড়ে চলেছি তখন। আমি শামুকের মতো নিজের সবকিছু নিজের ভেতরে নিয়ে নিচ্ছিলাম তাড়াতাড়ি। কেনো আমি দীমানের সাথে পালিয়ে গিয়েছিলাম, সেই গল্পটি বরং বলা যাক।
দীমান আমাদের পাশের পাড়ার ছেলে। বখাটে ছেলেরা যেমন কদর পায় অকদর্যদের কাছে, দীমান তারচেয়ে আরেকটু উপরের স্তরের একজন। বলার মতো তেমন কিছুই সে করে না। কাজ তার নেই, তবে অকাজের তালিকাটা বেশ বড়। সে এসব অকাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত সব সময়। ওর স্বভাব ভালো-মন্দ মিলিয়ে হলেও, মন্দের দিকটা বেশি হওয়াতে তার মূল্যায়ণ সেরকমই সে সাধারণের কাছে পায়। আর বড়বাজারে ওদের একটা ছোটখাট মিষ্টান্ন ভাণ্ডার আছে। তিন পুরুষ ধরে এই ব্যবসায় খারাপ চলছে বলা যাবে না। তবে আমাদের পরিবারের অবস্থানের তুলনায় দীমানদের অবস্থা অনেক খানি খাটো।
দীমান বছর দেড়েকের বেশি সময় ধরে আমার স্কুলে যাবার পথে বসে থাকতো। তবে আমরা জানতাম, আমরা মানে আমি আর আমার সমবয়েসী বন্ধুরা; দীমান অনেক মেয়েকেই বিরক্ত করে। কিন্তু সে এটা বোঝাতো আমায় যে, সে আমার জন্য আসলে বসে থাকে পথে, অপেক্ষা করে। প্রথম প্রথম দৃষ্টি অতোটা না পড়লেও তার ক্রমাগত চেষ্টায় তার দিকে নজর একটু পড়তো, সেটা সুনজর অবশ্যই নয়। তবে আমার কাছের বন্ধুদের কাছে নিত্য খোঁজ-খবর করতে করতে সে একসময় মনে নেয়ার মতো সামান্য জায়গা নিয়ে নেয়। দীমান সম্পর্কে আমার ধারণা যেমনই হোক, একজন কেউ আমার জন্য এমন করছে ভাবলে একটা অচেনা অনুভূতি মনের মধ্যে জেগে ওঠতো তখন।
ঐ সময়ে আমার একবার জ্বর হল। সেই খবর গেল দীমানের কাছে। বাড়িতে দুপুর বেলাটা আমি একাই থাকি। এই সুযোগটাই নিল সে। সপ্তাহ খানেক প্রায় রোজ আমাদের বাড়িতে এল। আর বিভিন্নভাবে আমাকে এটা বোঝাতে সক্ষম হল যে, সে আমাকে ভালোবাসে। কত আর বয়স আমার তখন। তাছাড়া ভুল করার সেই বয়সে কেবল কেউ বুঝে কাছে টানলেই তার কাছে মানসিক সমর্পনের ইচ্ছে জাগে মেয়েদের। মা-বাবা যখন সব জেনে ভয়ানক ভাবে মানা করে দিল এই ব্যাপারে, আমার মন তখন মনে মনে আরও ক্ষেপে গেল। একপর্যায়ে আমার মধ্যে মোটামোটি একটা জিদ চেপে বসলো যে, দীমানের সাথেই আমি থাকবো। এভাবে একদিন কীসব ভেবে, অনেকখানি না বুঝে, মনের পুরোটা সায় না নিয়েও দীমানের সাথে পালিয়ে যাই আমি।
দীমান অপেক্ষা করছিল আমাদের বাড়ির কাছের এক রেলস্টেশনে। আগের রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি তৈরি হতে থাকি। স্কুল ব্যাগে কয়েকটা কাপড়, মায়ের দুটো একটি গয়না আর নগদ কুড়ি হাজার টাকা নিয়ে ভোরে ঘর থেকে বের হয়ে যাই আমি। বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার সময় আমি ভুলে যাই পেছনের সব মমতার গেরস্থালি, মা-বাবার আগলে রাখা শরীর অজানা সমুদ্রে সাঁতার দেবার জন্য প্রস্তুত হয়।
আমার ছোট মন, কম বয়েসী শরীর দুটোই খারাপ হতে লাগলো দু দিন বাদেই। দুই রাত একটা নোংরা আর সস্তা হোটেলে কাটাই আমরা। তারপর দীমান আমাকে বস্তি মতোন একটা জায়গায় নিয়ে যায়। আমার কাছে থাকা গহনা ও টাকা সে নিয়ে নেয়। সে আমায় নিয়ে যেখানে যায়, ছোট হলেও আমি বুঝি, জায়গাটা ভদ্রলোকের বাস করার নয়। অবশ্য দীমান সে ভদ্র কেউ নয়, তা আমি ভালোই জানি। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য টানে আমি সব মেনে নিই।
একটা ঘর, যেখানে কেউ নেই, দেখিয়ে আমায় বলে, এই ঘরেই থাকতে হবে আমাদের। আমি খুব খুশি হয়ে যাই। আমি এটা ভাবি যে, হয়তো কম পয়সায় এই শহরে এর চেয়ে ভালো ঘর পায়নি সে। আমি আমাদের পরবর্তী সময়, আমোদে উপভোগ ও স্বপ্নের বাস্তবায়নের কথা চিন্তা করে সুখী বোধ করতে থাকি। হয়তো দীমান কাল থেকে কিছু একটা করবে। ওর রোজগার সামান্য হলেও আমাদের তারপর ভালোই চলবে কোনোমতে। দুটো মাত্র প্রাণি, এমন কী আর খরচপাতি। কিন্তু মা-বাবা আর সবার কথা মনে করে আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো তখন। এভাবে কতক্ষণ ভেবেছি খেয়াল ছিল না। তারপর একসময়, এই আসছি বলে দীমান বাইরে বেরিয়ে যায়। আমি খুব ক্ষুধার্ত ছিলাম। পথের দীর্ঘ যাত্রার রেশ তখনো কাটিয়ে উঠিনি। ক্লান্ত ও অনেকটা অসুস্থ আমি নেতিয়ে পড়ি সেই নোংরা ঘরে পাতানো একটা ছাটাইয়ের ওপর। আধোঘুমে আমি দেখি ঘরটিতে একটা আধ ছেঁড়া ছাটাই, দুটো ময়লা বালিশ, ভাঙ্গা একটা চেয়ার আর শক্ত কাঠের একটা মুগুর ছাড়া কিছু নেই।
আমার শরীরে কারো স্পর্শ পেয়ে চকিত হই আমি। নাহ, এ দীমান নয়। কে ইনি? ঠিক দীমানের বয়সী ছেলেটি হাসতে হাসতে বলে যে, ওর নাম কিরণ। হ্যাঁ, এবার চিনতে পারি আমি। দীমান ওর কথা বলেছে আমায়। ওর খুব কাছের বন্ধু। কিন্তু সে আমায় একটা হাতে এভাবে জড়িয়ে আছে কেনো বুঝতে পারি না। হ্যাচকা টানে তাকে সরিয়ে উঠে দাঁড়াই আমি। কিরণ আমার দুরবস্থা দেখে হেসে লুঠোপুটি খায়। আমি গলা বুজে আসা কণ্ঠে দীমানের কথা জিজ্ঞেস করি। জানতে পারি, সে বাড়ি চলে গেছে। একটা সিগারেট টানতে টানতে কিরণ চোখ মুখ লাল করে যা বলে তার অর্থ হলো, ওর সাথে আপাতত কিছুদিন থাকতে হবে আমাকে। আমি এবার আরও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। আমার বর্তমান ও সামনের কুৎসিত দিন-রাত্রির কথা ভেবে বারবার শিউরে ওঠি। আমি বুঝতে পারি মা-বাবার কথা না মেনে কী সর্বনাশ করেছি সময়ের, কতোটা অপচয় করে ফেলেছি জীবনের। যা ঘটছে তা মেনে নিতে পারিনা। চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে চাই কয়েকবার। কিরণ রেগে যায় আমার ওপর। আমাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় মেঝেতে। এরপর আরও দুজন ঘরটিতে ঢুকে। মদের গন্ধ আমি চিনি না। তবে একটা ভোদকা আঁশটে গন্ধ আমার উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়, কেমন একটা আবহে মাথা গুলিয়ে যেতে থাকে। ওরা জোর করে আমাকে কিছু একটা খাওয়ায়। তারপর সম্ভবত আমি মূর্ছা যাই।
আমি যখন চোখ মেলেছি তখন মধ্যরাত। না, আমার পাশে কেউ নেই। আমি এই ঘরে একা। উঠতে চেষ্টা করি। পারি না। সীমাহীন নরক যন্ত্রণার মাঝেও অপেক্ষা করতে থাকি দীমানের। পরদিন দুপুরে দীমান আসে। তাকে কিছুই বলি না আমি। কিছুই হয়নি এমন ভাবে কথা বলার চেষ্টা করি। ও হাসতে হাসতে আমার পাশে বসে। আমি বাইরে বের হতে চাইলে দীমান আমাকে বাধা দেয়। এরপর ধস্তাধস্তি শুরু হয়। একপর্যায়ে আমি পাশে রাখা মুগুর দিয়ে সজোরে আঘাত করি ওর মাথায়। দীমান লুটিয়ে পড়ে। ওর রক্তে আধ ভেজা আমি দ্রুত কাপড় চেঞ্জ করি, তারপর বের হয়ে যাই ঘর থেকে।
বাড়ি পৌঁছতে সেদিন সন্ধ্যা রাত হয় আমার। আমাদের উঠোনজুড়ে গ্রামের সমস্ত মানুষ। এতোগুলো সামাজিক মানুষের মাঝে নিজেকে দাঁড় করাতে পারছিলাম না কিছুতেই।
হাসান হামিদ : কবি ও লেখক, বাংলাদেশ
তিনটি গল্পই ভালো লেগেছে। টানটান কাহিনিবিস্তার। গল্পকারকে অভিনন্দন!