দ্য ব্রিজ অন রিভার কাওয়াই

ফরাসি কথাসাহিত্যিক পিয়েরে বুলের দ্য ব্রিজ অন দ্য রিভার কাওয়াই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে ডেভিড লিন নির্মাণ করেন একটি ব্রিটিশ মার্কিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চলচ্চিত্র ( ১৯৫৭)। আমরা অনেকেই পিয়েরে বুলের রচিত মুল উপন্যাসের (রচনা ১৯৫২) অনুবাদ পড়েছি। কেউ খোদ ইংরেজি উপন্যাসটাই পড়েছেন। আমি নিজে পড়েছি, প্রথমে যদ্দুর মনে পড়ে সেবা প্রকাশনীর অনুবাদে।
একটি রেলসেতুকে ঘিরে অনেক ইতিহাস। কত দেশের, কত মানুষের রক্ত, অশ্রু, মৃত্যু’র ইতিহাস এই সেতুর সঙ্গে জড়িত। কোয়াই নদীর ওপরে নির্মিত কাওয়াই ব্রীজ বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক ঐতিহাসিক বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পট।
থাইল্যান্ডের টুরিজম সেক্টর অত্যন্ত উন্নত,খ্যতি বিশ্বজোড়া। তা বড় ধনি রাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে দেবার ক্ষমতা রাখে থাইল্যান্ডের টুরিজম। যদ্দুর মনে পড়ে ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩ র মধ্যে সাপ্তাহিক চিত্রবাংলাতে (পত্রিকাটি এখন আছে কিনা আমার জানা নেই) থাইল্যান্ড টুরিজমের ওপর একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল “কামার্ত ব্যাংকক” শিরোনামে। বিনোদনের স্থুলরুচির দিকটাকেই অনেক বেশি হাইলাইট করা হয়েছিল।সেটা যে অমুলক ,তাও নয়। কিন্তু পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসা সেবায় ব্যামেরুনগ্রাড হাসপাতালের মত প্রতিষ্ঠান গড়ে, উন্নত চিকিৎসা সেবা দিয়েও উন্নত বিশ্বকে বিশেষত পাশ্চাত্যের দেশগুলোকেও টেক্কা দিয়েছ থাইল্যান্ড। বলা যায় পরিপূর্ণ বিনোদন- দেহ ও মনের দুটোই নিরাময় এবং আনন্দ বিধানের কাজটি সুচারু সুদক্ষ ভাবে সুসম্পন্ন করে চলেছে থাইল্যান্ড। পৃথিবীর প্রথম সারির পর্যটনবান্ধব একটি দেশ হিসাবে নিজেদের স্থায়ী স্থান তৈরি করে আর্থিকভাবেও সমৃদ্ধ হয়েছে।

আগে যে কথাটা উল্লেখ করেছি (চিত্রবাংলা’ র প্রতিবেদন শিরোনাম) সেই পরিচয় তো রইলই,সেটা ছাড়িয়ে পর্যটন খাতে নতুন নতুন ইতিহাস ঐতিহ্যের স্থান বিষয়গুলোকেও টুরিজমের আওতাভুক্ত করে নিজেদের পর্যটন বান্ধবতার ধ্রুপদী পরযায়ে ও উন্নীত করেছে দেশটি। সেরকমই একটি ট্যুরিষ্ট স্পট থাই বারমা রেলওয়ে র পর্যটন প্রকল্প railway of death। যেটার মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে the bridge on the river kwai।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন মূল প্রেক্ষাপটে চলে যাই। জাপানী ইম্পেরিয়াল আর্মি ব্রিটিশ, অষ্ট্রেলিয়ান,আমেরিকান, কিউই, ড্যানিশ,যুদ্ধবন্দী ও প্রায় দুলক্ষ ভারতীয় ,চীনা, সিঙ্গাপুরী, ও বার্মিজ যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে ৮৫০ কিলোমিটার রেলপথ তৈরি করায়। ব্যাংকক থেকে জাপানি মিলিটারি , অস্ত্রও রসদ নিয়ে রেঙ্গুন হয়ে উত্তর পূর্ব ভারতের ব্রিটিশ – আমেরিকান সৈন্য শিবিরে এবং বিমান ঘাঁটিতে পৌঁছে দিত। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় কাঞ্চনাবুড়ির কাছে খরস্রোতা পাহাড়ি নদী কোয়াই। গভীর জঙ্গল পাহাড় ঢাকা কাওয়াই নদীর ওপর ব্রিজ তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়ে। কাজটি অত্যন্ত কঠিন। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমেরিকান যুদ্ধবিমানবাহী নৌবহরের কাছে জাপানী নৌবাহিনীর সরাসরি পরাজয়ে যুদ্ধের রণাঞ্চল বদলে পরিবর্তে থাইল্যান্ড, বারমা (বর্তমানে মায়ানমার) এবং ভারতের উত্তর পূর্ব অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়। পেনাং বিমানবন্দর থেকে জাপানী যুদ্ধবিমান সুদূর কলকাতা ও আশেপাশের বন্দর এলাকায় ব্যপক বোমাবর্ষণ শুরু করে। উদ্দেশ্য আমেরিকান,ব্রিটিশ, অষ্ট্রেলিয়ান মিত্রশক্তির সরবরাহ কার্যক্রম বিচ্ছিন্ন করা, উত্তরপূর্ব ভারতে সরাসরি মায়ানমার থেকে রেল যোগাযোগের সুবিধা নিয়ে বড় বড় সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে উত্তরপূর্ব ভারত আক্রমণ করা। সেই লক্ষে বাইশ হাজার যুদ্ধবন্দী সৈনিক ও মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারকে মায়ানমারের থানবাইজাত ও কাঞ্চনাবুড়িসেনা শিবির থেকে তুলে এনে রেললাইন তৈরির কাজে লাগানো হয়। দৈনিক ১৪ ঘন্টা খাটিয়ে জোর করে অনাহারে, অসুখে, অপুষ্টি ও সাপের কামড়ে অধিকাংশ যুদ্ধবন্দী মৃত্যুবরণ করে। তারপরেও ১৯৪৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১৬ মাসে তৈরি হয়ে যায় দুটি কাঠের ও একটি স্টীলের তৈরি মিটার গেজ ব্রিজ ও দুইশো মেইল রেলপথ। প্রায় তেতাল্লিশ হাজার যুদ্ধবন্দী আর দুই লক্ষ শ্রমিকের তৈরি এই ব্রিজ সংযুক্তিকরণ হয়। পরিসংখ্যানে দেখা গেল,মিত্রশক্তির প্রায় ১৬ হাজার যুদ্ধবন্দী এবং এক লক্ষ শ্রমিক এই নিরমাণকাজ সম্পন্ন করতে গিয়ে মারা যান। সেজন্যেই এই রেলপথের নাম হয় railway of death । এত গেল the bridge on the river kwai এর প্রস্তুতির পেছনের ইতিহাস।

আসা যাক বর্তমান টুরিস্ট স্পট হিসাবে এর সুলুক সন্ধান ,হাল হকিকত। ব্যাংককের কোনো একটি হোটেল এ আপনি উঠলেন। সেখান থেকে আপনার যাত্রা শুরুটা এ রকম হলো- রাতেই ঘড়িতে alarm দিয়ে রাখলেন সকাল সাড়ে পাঁচটার। ব্যাংককে সারা পৃথিবী থেকে ভ্রমণকারী আসে। সারারাত থাকে রিসেপশন কাউন্টার বার খোলা । মধ্যরাত পর্যন্ত চলে গান বাজনা। রাত -দিন, সকাল -দুপুর বলে কিছু নেই। অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙল। তড়িঘড়ি ফিটফাট হতে হতেই ঠিক সকাল ৬টা ৩৫ এ আপনার নাম ঘোষণা করা হলো লাউডস্পীকারে। ধরুন, সহযাত্রী আরও কয়েকজনের।এক ভদ্রলোক এসে আপনাদের ব্যাচ লাগিয়ে দিলেন,‘ way to bridge on the river kwai- thai- barma death railway.’ ঘড়ির কাঁটা ধরে ঠিক ৬টা ৪০ এ ইসুজু ‘র একটা আঠারো সিটারের মিনিবাস হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল। স্কাই ব্লু শার্ট আর নেভি ব্লু স্কারট পরা থাই তরুণী গাড়ি থেকে নেমে হাত জোড় করে অভিবাদন জানালেন। “গুড মর্নিং, দিস ইজ সুনকি- গাইড অফ ইওর মেমোরেব্লে জার্নি।’’ নামটি সুনকি না হয়ে অন্য নাম হতে পারে।সক্কাল সক্কাল এমন সুন্দর মুখের সুন্দর অভিবাদন ভীষন ভালো লাগে। সুন্দরী ললনা আর ও বললেন- প্লিজ বি সিটেড। গাড়ির মধ্যে আরও অনেক বিদেশি ট্যুরিস্ট রয়েছে। স্বদেশী কাউকেই দেখলেন না। কিচ্ছু অসুবিধে হবেনা। সহাস্য থাই তরুণীর কাছে জানবেন আপনার আজকের ভ্রমণ তালিকা,নাইট স্টে, আগামীকালের চেক আউট টাইম এবং রিটার্ন যাত্রার বিবরণী। যেটা লেখা ও পাবেন ইংলিশ ,থাই ,ও চিনা ভাষায়। হাতে পেলেন পানির বোতল। প্রথম যাওয়া হবে কাঞ্চনাবুড়ি ক্রিমাটোরিয়ামে। ঘোষিকা থাই তরুণী মাইক্রোফোনে দিতে থাকে ধারাবিবরণী। বলা শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মর্মান্তিক প্রেক্ষাপট। যেটা আমি আগেই বলে নিয়েছি। শুনতে শুনতে ভারাক্রান্ত হবে প্রাণমন।এরমধ্যেই ব্যাংকক ছাড়িয়ে চলে এলেন অনেকদূর। গাড়ি চলছে থাইল্যান্ডের উত্তরপূর্ব দিক বরাবর। রাস্তার দুপাশে সবুজ ধানখেত, বৃক্ষরাজি, ছোট ছোট গ্রাম, দূরে নীল পাহাড়ের হাতছানি। পাকাপোক্ত রাস্তাঘাট নির্মাণ কল্পে থাই সরকারের সযত্ন,সুপরিকল্পিত কার্যক্রম থাইল্যান্ডের সর্বত্র বিরাজিত যোগাযোগ ব্যবস্থার মতোই এপথেও একই রকম। কোনো না কোনো ভাবে মনের মধ্যে স্বদেশের সঙ্গে তুলনাটা এসেই যায় এবং অবধারিত ভাবে বিষণণতায় ভরে যায় মন। এর মধ্যেই চমৎকৃত ও হবেন- আপনার সামনের সিটে দেখলেন প্রউড় একজোড়া আমেরিকান দম্পতি তো পাশের সিটে ডানদিকে দেখছেন ইতালিয় একজন যুবক, পেশায় কনষ্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়র,বামদিকে দেখছেন পোলিশ তরুণী,যিনি হয়তো ওয়ারশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসের অধ্যাপক। একেবারে পুরো দুনিয়া আপনার আশেপাশে। কিছুদূর যাওয়ার পর হাইওয়ের লেন চেঞ্জ করে বাঁ দিকে দাঁড়ালো আপনাদের ট্যুরিষ্ট ভ্যান। গাইডের নির্দেশে নেমে দেখলেন বাঁদিকে সিমেট্রি। খুব সুন্দর করে লেখা- 1939-1945 the soldiers died serving their country and the cause of freedom and line lie buried elsewhere in Thailand ..’royal Indian Engineers,madras sappers and Miners.13th frontier force riffles,14th panjab rejiment,Indian army medical corps, non –combatant , Indian army vetarnary gorps , Indian army ordindaruy corps non combatant,Indian pioneer corps এর বিভিন্ন র্যাঙ্কের সৈনিকদের মৃতদেহ শায়িত আছে এখানে। বাইরে সিমেন্টের ফলকে লেখা, ‘ kanchanbari war cemetery 1939-1945’. ১২৩৯জনের শবদেহ শায়িত আছে এখানে। প্রতিটি কবরের ওপর পাথরের ফলকে মৃত ব্যক্তির নাম, বয়স, কবে মারা গিয়েছেন,দেয়া রয়েছে। সবুজ ঘাস সুন্দর করে কাটা। মালি পাইপের সাহায্যে পানি দিচ্ছেন, ঘাস কাটছেন। সমাধিক্ষেত্রের ওপর দিয়ে বয়ে যায় অঘ্রাণের শীতল বাতাস।

ফুলে ভরা বকুল, চাঁপা ঢেলে দিচ্ছে ফুলের অঞ্জলি। পুষ্পাঞ্জলির ভেতর যারা শুয়ে আছেন, তাঁদের শরীরে কৈশোর, যৌবনের ঘ্রাণ ছিল, বুক ভরা স্বপ্ন ছিল, বাঁচার স্বপ্ন! থাইল্যান্ডের মানুষ ইতিহাসকে ভুলে যায়নি,শ্রদ্ধা জানিয়েছে বীর যোদ্ধদের।
আবার যাত্রা শুরু। মিনিট পাঁচেকের গাড়ি পৌঁছায় the jeath war museum-এ। ধার দিয়ে বয়ে গিয়েছে mae klong নদী ।
কোয়াই নামে পরিচিত হয় ১৯৬০সালে। একটা ভিন্ন স্বাদের মিউজিয়াম।চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায়না।মিউজিয়াম দর্শন করার আগে নিয়ে যাওয়া হয় সবাইকে একটা ছোট কক্ষে। ছোট অডিটোরিয়াম আসলে সেটা। অন্ধকার ঘর। এল এস ডি প্রেজেন্টেশনে কিছুটা মুভি, কিছুটা স্টিল ফটোগ্রাফি, কিভাবে ব্রিজ ও রেলওয়ের পরিকল্পনা করে ইম্পিরিয়াম জাপানি আর্মি। কীভাবে ক্যাম্প স্থাপন করা হয় কেমনভাবে রাখা হয়। কেমনভাবে রাখা হয় শ্রমিক ও যুদ্ধবন্দীদের। কীভাবে ব্রিজ তৈরির কাজ শুরু হয়। বাইশ হাজার যুদ্ধবন্দীদের নির্বিচারে নির্যাতনে প্রায় অনাহারে চৌদ্দ ঘণ্টা একটানা পশুর মতো খাটানোর মর্ম স্পর্শী দৃশ্যরাজি । হাড় জিরজিরে দিনের পর দিন স্নান পরিচ্ছন্নতা বিহীন মানুষগুলোর কোনো রকম র্যাংকিং এর বালাই নেই! সবাই এক নামেই পরিচিত যুদ্ধবন্দী ক্রীতদাস। ক্ষুধায়,সাপের কামড়ে, জঙ্গল বিষাক্ত পোকামাকড়ের কামড়ে মারা যাচ্ছে। রীতিমত রোমহর্ষক প্রামাণ্য চিত্র। কঙ্কলসার জীর্ণ চেহারার মানুষেরা শাবল গাঁইতি কোদাল নিয়ে কাজ করছে। মৃত্যু শয্যায় মানুষ চিঠি লিখছে প্রিয়জনকে। নথিবদ্ধ করছে বন্দীজীবনের দৈনন্দিন ঘটনা।
মিউজিয়ামে যুদ্ধকালীন সময়ে জাপানি সৈনিকদের ব্যবহার করা মেশিনগান, রাইফেল গ্রেনেড, কামানের গোলা ও অপারেশন থিয়েটারের কাঁচি, ছুরি, চিমটে সবই রাখা আছে। বেশকিছু পেন্সিল স্কেচ আছে, যাতে তুলে ধরা হয়েছে যুদ্ধবন্দীদের জীবনের আলেখ্য। এক জায়গায় ছবিতে দেখা গেল ক্ষতযুক্ত পা এনাস্থেশিয়া ছাড়াই অপারেশন থিয়েটারে এমপুট করার কাজ চলছে। ছবিগুলো দেখে মনে হয়, মৃত্যুর মিছিলে নির্বাক একটা বেদনাক্লিষ্ট ছবি দেখছি।

মিউজিয়ামের খানিকটা কংক্রীটের, খানিকটা হোগলার চাল। সেখান থেকে বের হয়েই দেখা যায়, কোয়াই নদীর তীর। ওপারে বেশ কিছু রিসোর্ট আছে, হোম স্টে। নদীরধারে কিছু ঝকঝকে নতুন স্পীডবোট অপক্ষমান। একটাতে আমাদের ওঠানো হল। হেমন্তের ঝকঝকে নীল আকাশ, হালকা শীতের আমেজ। তিরতির করে বয়ে চলেছে কোয়াই। থাইল্যান্ডের এই অঞ্চলের প্রকৃতি ছবির মতো সুন্দর। তীব্র গতিতে ঢেউ তুলে ছুটে চলা ষ্পীডবোটের গতির সাথে সাথে ছুটে চলে দুপারের নিসর্গ ও। পল্লী জীবনের সহজ শ্যামল ছবি স্মরণ করায় নিজের মাতৃভূমির পল্লী জীবন। দূরে দেখা যায় কোয়াই নদীর ব্রীজ। সুনকি নামের যুদ্ধবন্দীদের দিয়ে নির্মিত ব্রিজ অন দি রিভার কাওয়াই এর প্রস্তুতির কারণ, তৈরি ‘র সময়ের অমানবিক কাহিনী তো প্রারম্ভেই বলেছি। স্পীডবোট থামে জেটিতে। আমাদেরি মতো অনেক বিদেশি ট্যুরিস্ট পূর্ণ স্পীডবোট এসে এসে থামছে, জেটিতে নামছে নানান বয়সের ,ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে আগত পর্যটকের দল। এখান থেকে ট্রেনে যাবার ব্যবস্থা রয়েছে। ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে এগারোটা। এগারোটা পঞ্চাশে আসবে ট্রেন। ট্রেনটি আর ও ৬১ কিলোমিটার দূরে নামটক পর্যন্ত যাবে। ট্রেনের ভাড়া তিনশো বাথ। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় সাড়ে সাতশ রুপি। গাইডকে টাকা দিয়ে দেই ।এত বেশি পযটকের ভিড়, যে ভয় হলো হারিয়েই যাই নাকি!। ট্রেন এল। গাইড আমাদের যার যার টিকেট হাতে দিয়ে গেছে। ট্রেনে উঠলাম। ইউরোপ আমেরিকায় অষ্ট্রেলিয়ায় যেমন দেখা যায়, সেরকমই রঙচঙ্গা কামরাগুলি, কোচগুলি। এই ট্রেনে বিদেশি পর্যটকের আধিক্য বেশি বলেই হয়ত থাই সরকার এই ট্রেনটি চালানোর ব্যাপারে বিশেষ যত্নবান। একটু ধীরে চলছে ট্রেন। ব্রিজে উঠে গেল ষ্টেশন ছাড়িয়ে। ব্রিজটি পুরনো বলেই ব্রিজ রেল কর্তৃপক্ষ সাবধানে আস্তে ট্রেন চালায়। ব্রিজ পার হয়ে গতি নেয় ট্রেন ।দেড় ঘণ্টায় যাবে ৬১ কিলোমিটার। জানালা দিয়ে বাইরের অপূর্ব নিসর্গ দেখতে দেখতে প্রাণ মন হারিয়ে যায় তার মোহিনী মায়ায়। এই ফাঁকে বলে রাখি থাই কর্তৃপক্ষ এই রেলওয়ে শতকরা আশি ভাগ লোকসানেই চালায়। ভর্তুকি দিয়ে চালানোর কারণ হয়তো পর্যটক সংখ্যা বৃদ্ধি, এবং একসময় সেটার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে এই লোকসানটা কর্তৃপক্ষ কাটিয়ে ওঠবে, থাইল্যান্ডের পর্যটন বিভাগের দুনিয়াজোড়া সুনাম ও আরও সমৃদ্ধ হবে। ট্রেনের সামন্তরালে চলেছে একটি রাস্তা। রাস্তা ছাড়িয়ে দূরে সবুজ অরণ্য। তার ওপরে দৃশ্যমান নীল পাহাড়ের সারি। ঘনায়মান সন্ধ্যার আলোছায়া তাকে করে তুলেছে রহস্যময়। ছোট দুটি স্টেশন পরে এক জায়গায় (স্টেশনে) আদিবাসীরা ওঠে ভীড় করে পেছনের কামরায়।
যাত্রা শেষে নদীর পাড়ে কটেজে রাতের থাকার আয়োজন। ধীরে চলে যায় সন্ধ্যা। কৃষ্ণপক্ষের এক ফালি চাঁদ ধারণ করে রাত্রি। চিকেন মোমো আর পানীয়ের গ্লাসে আরও মোহময়ী হয় রাত্রি। এমন সুন্দর পরিবেশ, ইতিহাসের জীবন্ত পটভূমিতে ঘুম যায় দূরে। রাত পোহালেই ফিরে যেতে হবে। মনে হয়- ডেভিড লিন যদি ১৯৫৭ সালে তাঁর সাড়া জাগানো ছবি ‘দ্য ব্রিজ অন দা রিভার কাওয়াই’ নির্মাণ না করতেন, তবে কী এই ব্রিজ এত বিখ্যাত হতে পারত? ছবিটির শ্যুটিং হয়েছিল শ্রীলংকায়।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব ঘটনাই কী এমন বিখ্যাত দ্রষ্টব্য হয়ে ঊঠতে পেরেছে? এই ছবিই তো থাই সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেছে এমন বিখ্যাত পরিচিত পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করতে কাওয়াই নদীর ব্রীজকে।
আখতার জাহান শেলী , কিসমত করিমপুর,চৌমুহনী, নোয়াখালী।