বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ভাবনা

বেসরকারি কলেজ বা হাইস্কুলে ম্যানেজিং কমিটির লোকেরা ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে অযোগ্য ও দুর্বল মেধার লোকদের নিয়োগ দিয়ে দেশের শিক্ষাকে যাচ্ছেতাই করে ফেলেছেন এবং এমন অভিযোগের ভিত্তিতে সরকার যোগ্য আর মেধাবীদের নিয়োগ নিমিত্তে সরকারি ব্যবস্থাপনায় জাতীয় নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্নের নানাবিধ কার্যক্রম চালু করেছেন৷ বলাইবাহুল্য, এটি সরকারের একটি ইতিবাচক সাফল্য৷ নিবন্ধিত হওয়ার পরেও মেধাক্রম অনুসারে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে যদিও নিয়োগ সংক্রান্ত বহু জটিলতায় জাতীয় নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে নাজুক অবস্থায় রয়েছে৷ এরপরেও নিয়োগ প্রক্রিয়া অব্যহত আছে এবং এটি অবশ্যই আশাব্যঞ্জক প্রক্রিয়া৷
নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় নিয়োগপ্রাপ্তরা নিঃসন্দেহে মেধাবী এবং সেবিষয়ে কারও সন্দেহের অবকাশও নেই। তবে অনিবন্ধিত এবং ম্যানেজিং বা গভর্নিং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ইতোমধ্যে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠান থেকে বাদ দেয়া হলো না এবং সেজন্যই লেজেগোবরে অবস্থা নিয়ে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা৷ একটি প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসা অন্তরে জাগে যা বলার সাহস পাই না ; সেটি হলো এই যে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর সম্পূর্ণ কার্যক্রমটি যেনারা তদারকি করছেন তেনারাও সম্ভবতঃ ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের শিক্ষার্থী৷ সত্যিই লজ্জায় লাল হয়ে যায় ভেতর-বাহির সবকিছু৷ আবার নিবন্ধিত মেধাবীরা কোনো না কোনভাবে ঐসব অমেধাবী শিক্ষকদেরই ছাত্র বা ছাত্রী- ৷ আমরা মূলতঃ কোন মেধাবীদের নিয়োগ দিচ্ছি -! বলতেই হয় ” বলিহারি ৷ “
বস্তুতঃ বেসরকারি শিক্ষা সম্পর্কিত সরকারি প্রজ্ঞাপন বা নীতিমালা একটি অস্থায়ী প্রক্রিয়া; প্রজ্ঞাপনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন বা পরিবর্ধন অথবা বাতিল হতে পারে উর্দ্ধতনের কলমের একটি খোঁচায় এবং এসব সিদ্ধান্ত অনেকক্ষেত্রে বিতর্কের জন্ম দেয় -৷ ফলে আইনি লড়াই শুরু হয় এবং যথারীতি একটা জটের সৃষ্টি হয়৷ নিম্নস্তরের এসব শিক্ষকেরা সরকারি বেতন-ভাতাদি পেয়ে থাকেন কিন্তু সামাজিকভাবে শিক্ষকেরা কখনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি ৷ বড় বড় নেতাদের বড় বড় কথার সাথে তৃণমূলের কার্যকলাপের কোনপ্রকার মিল নেই – ৷ অনিয়ম যখন নিয়মে পরিণত হয় তখন সেখানে ‘মেধা ‘ শব্দটি শুধুই শব্দ ছাড়া আর কিছুই নয় – ৷ আমরা একদিকে মেধাবী শিক্ষকদের সন্ধান করছি আর অপরদিকে সেসব শিক্ষকের ওপরেই নানাভাবে স্টিম রোলার চাপিয়ে দিচ্ছি ৷ একজন শিক্ষকের মর্যাদা কী তা আজ শিক্ষকেরা ভুলতে বসেছেন ৷ বিভিন্নভাবে সরকারের আদেশ-নির্দেশ তো পালন করতেই হয় এবং তা পালনে শিক্ষকেরা বরাবরই সচেষ্ট থাকেন কিন্তু বহুমুখী মতপার্থক্যের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে নিতে হয় – ৷ এতসবের পরেও যখন নিজেকে অযোগ্য মনে হয় তখন দিনশেষে নির্জনে কয়েকফোঁটা অশ্রুবিসর্জন করা ছাড়া শিক্ষকদের আর করার কিছুই থাকে না ৷
মেরুদণ্ডহীন শিক্ষকদের নিয়ে কিভাবে প্রত্যাশা করা যায় যে “শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড -!” আসলে আমরা সবাই মেরুদণ্ডহীন কিন্তু সুকৌশলে দায়টা চাপানো হয়েছে কেবল শিক্ষার ওপর – ৷ দেশীয় সংস্কৃতি সহ দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানা , বিজ্ঞানচর্চায় সময়োপযোগী পাঠক্রম প্রণয়ন , মানসিক ও শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রে সামাজিক ভূমিকা , রাজনৈতিক ভারসাম্যতা ইত্যাদি শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহায়ক হতে পারে ৷ শিক্ষক-কর্মচারি নিয়োগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন নীতিমালার প্রণয়ন জরুরী ৷ জগাখিচুড়ি সার্কুলার প্রদান বা অদক্ষ আমলাতন্ত্রের প্রয়োগ বন্ধ করাও দরকার ৷ শিক্ষকেরাই ডাক্তার , ইঞ্জিনিয়ার , প্রশাসনিক কর্মকর্তা বানিয়েছেন বা বানাচ্ছেন এটা স্বীকার করবার মতো উদারতা থাকা প্রয়োজন ৷
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠাকালীন স্থানীয় বিদ্যোৎসাহী মানুষদের ভূমিকাকে মূল্যায়ন বা সম্মান করাটাও একটি ইতিবাচক দায়ীত্ব ৷ আমরা দ্রুততম সময়ে অকৃতজ্ঞ বা কখনও কৃতঘ্ন হয়ে পড়ি ৷ স্থানীয় এসব মানুষের অক্লান্ত শ্রম এবং ব্যয় সহ মেধার প্রয়োগেই এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে ৷ এসব শিক্ষানুরাগী মানুষদের মূল্যায়ন না হলে প্রকৃত শিক্ষার পটভূমিতে কিছুটা অসমাপ্তি থেকেই যায় ৷ প্রতিষ্ঠান তৈরি করা এসব মানুষের বেশিরভাগই অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত ; কিন্তু তাঁদেরই কল্যাণে আজ এতবেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর এতো মানুষ জীবিকার সন্ধান পেয়েছেন – ৷
মুক্ত আলোচনা হোক , যেখানে গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিতে সমালোচিত হতে হবে না ৷ বেতনকাঠামো থেকে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো সহ প্রভৃতি বিষয়ের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হওয়া দরকার ৷ উন্মুক্ত চেতনার আলোকে শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক উৎকর্ষতার দিকে বিশেষ নজর আরোপ করা খুবই প্রয়োজন ৷ সর্বোপরি , শিক্ষার মানবৃদ্ধি করতে গিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে জড়িত আর কারো মান যেনো নিম্নগামী না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখা জরুরী – ৷
লেখকের নিজস্ব মতামত