ডং ডং- তৃতীয়পর্ব

ফেসবুকে চিঠি চালা চালি করে অনেক আলাপচারিতাই হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত একটি নিখুঁত সিদ্ধান্ত তৈরি হয়ে গেল। তর্করত্নের প্রস্তাবে টাকার বস্তাওয়ালা বন্ধুরা (টাবলা) রাজী হয়ে গেল কিন্তু সঙ্গে একটি শর্ত জুড়ে দিলেন। তর্করত্ন এলাকার আবর্জনা পরিস্কারের কাজে হাত দিবেন এবং এই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা শুরু হবে ‘ডং ডং’ চিপসের খালি খোলস সংগ্রহ করে পুড়ে ফেলার মধ্য দিয়ে। এই কাজটি করতে পারলে একসঙ্গে দুটো কাজ হয়ে যাবে।
১. পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা জেগে উঠবে।
২. ‘ডোং ডোং ১’ প্রকাশের প্রতিবাদ স্বরূপ ‘ডং ডং’ চিপসের খোলস পোড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নিঃশেষ হয়ে যাবে অনেকের বুকের ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ।
টাবলারা টাকার হিসাবের ব্যাপারে অনেক কঠোর এবং তারা প্রতিটি পয়সা খরচের খতিয়ান রাখেন। যেহেতু তর্করত্নের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে সকলের রয়েছে এক সীমাহীন সন্দেহ, তাই তর্ককে বলে দেয়া হলো যে, সে পুরো টাকা পাবে সম্পূর্ণ প্রোজেক্ট সফলভাবে শেষ করার পর। আপাতত সব খরচ তর্ককেই বহনের ব্যবস্থা করতে হবে। উনারা আরও বলে দিলেন, ‘অন্তত বিশ হাজার ‘ডং ডং’ চিপসের খালি খোলস একসঙ্গে পোড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং সময় তিন মাস’।
এইসব শর্ত শুনে তর্কের মন আজ বেজায়রকমের খারাপ। উনি ভাবছেন, এতো শর্ত মেনে কি কাজ করা সম্ভব? আমার টাকা নেই, তাই এসব টাবলাদের কথা শুনতে হয়। কাজ শুরু করার জন্য ৳ ২০,০০০ টাকাই বা আমি কোথায় পাব? আমার কাছে তো এতো টাকা নেই। এখন তাহলে উপায়? পরক্ষণেই তর্কের মনে হলো, ‘হাকাউয়ের সঙ্গে একটু শলাপরামর্শ করা যেতে পারে এবং সাথে হয়ে যেতে পারে আরও একবার পাঁঠার দুধের চা’ [ফার্মিয়ন ১.৩]।
হাকাউ এবং তর্করত্ন দুজনেই দিনক্ষণ ঠিক করে, দেখা করে ফেললেন ‘কাশুয়া’ বাজারে। তর্ক পুরো বিষয়টি বর্ণনা করলেন হাকাউকে। নানান ধরণের কথা বার্তা হচ্ছে দুজনের মধ্যে এবং কিছু অংশ নিম্নরুপ:
হাকাউ: তোকে আগে মাথায় রাখতে হবে ‘টাকা’। এখানে এক লক্ষ টাকার ব্যাপার।
তর্ক: ধেৎ, তুই আছিস টাকা নিয়ে। আমি ভাবছি, কিভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান সফলভাবে শেষ করা যায়, সেটা নিয়ে।
হাকাউ: সমাজের জন্য স্বেচ্ছাসেবক টাইপের কাজ করে আমার কি লাভ? তোদের পেছনে থেকে, গত এক মাস যাবৎ আমার ভ্যান অবস্থান নিয়েছে ফকদমপুর চৌরাস্তার এক বৈদ্যুতিক খাম্বার সঙ্গে। এখন সেই ভ্যান কিভাবে আবার চালানোর মতো অবস্থায় নিয়ে আসা যায়, আমি সেটা নিয়েই চিন্তিত। মাঝে যেই বৃষ্টি হলো, বিয়ারিং-টিয়ারিং সব পরিবর্তন করতে হবে। হয়ত কয়েক হাজার টাকা লাগবে। আমি কি যে করি?
তর্ক: এত দুশ্চিন্তা করিস না। তুই চাইলে এই আবর্জনা পরিস্কারের বাজেট থেকে কিছু টাকা কামাতে পারবি। কিন্তু তোকে হতে হবে চরম রকমের চালাক এবং পরিকল্পক।
হাকাউ: আমাকে ব্যাপারটা একটু খুলে বলবি?
তর্ক: ওদের মূল জিদ হলো ‘ডোং ডোং ১’। ওদেরকে কোনো মতে ২০,০০০ ‘ডং ডং’ চিপসের খালি খোলসের স্তূপ দেখাতে পারলেই হবে। টাকা এক লক্ষ। এখন তুই এই কাজটা কম টাকায় করে দিতে পারলে, বাকি টাকা তোর।
হাকাউ: তোর মাথায় তো অনেক বুদ্ধি রে। আমি ২০,০০০ চিপসের খোলস মাত্র ২০ হাজার টাকায় ম্যানেজ দিতে পারবো। বাকী ৳ ৮০,০০০, আমার পকেটে ভরতে পারব।
তর্ক: টাকার প্রতি তোর লোভ আসলেই একটু বেশি। আরে ওরা যে বলল, কাজ শেষে পুরো টাকা দিবে। এখন তাহলে এই ৳ ২০,০০০ কোথায় পাবি? তোর কাছে কি কিছু আছে নাকি?
হাকাউ: আরে তুই যদি ওদেরকে একটু বুঝিয়ে বলিস, তাহলেই ওরা অগ্রিম ৳ ২০,০০০ দিবে। আমি টাকা কোথায় পাবো? গত এক মাস যাবত ভ্যান পড়ে আছে, এক টাকাও রুটি রোজগার নেই।
তর্ক: টাকা ছাড়া তুই কিভাবে টাকা কামানোর পরিকল্পনা করিস?
হাকাউ: এই জন্যই তো আমি তোর সাথে আছি। তুই যেভাবে বলবি, সবকিছু সেভাবেই হবে। তোর পরিকল্পনা শিরোধার্য।
আলোচনা শেষে দুজনেই চলে গেলেন যার যার ডেরায় এবং এইবারের কর্মপদ্ধতি অনেক বেশি তীক্ষ্ণ, ফসকে যাবার সুযোগ নেই। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানের নাম হতে পারে হাকাউ ও তর্কের সম্মিলিত নামে এবং সেটা হয়ে গেলো‘তর্ক + হাকাউ = তকাউ’। দুজনেই অনেক কষ্টে ৳ ১০,০০০ করে ব্যবস্থা করলেন এবং তাদের সম্মিলিত ফান্ডিং হয়ে গেলো ৳ ২০,০০০। আর কিসের অপেক্ষা? শুরু হয়ে গেল অপারেশন ‘তকাউ’।
এলাকায় একটি নিম্নোক্ত ঘোষণা দেওয়া হলো:
সন্মানিত সুধী,
এত দ্বারা সকলের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে, আগামী এক মাস যাবৎ ফকদমপুরে চলবে পরিষ্কার পরিচ্ছনতা অভিযান‘তকাউ’। প্রাথমিকভাবে, শুধুমাত্র চিপসের খালি খোলস সংগ্রহ করে জ্বালিয়ে দেয়া হবে। ডোনারদের পরামর্শ অনুযায়ী শুরুতেই ২০ হাজার ‘ডং ডং’ চিপসের খালি খোলস সংগ্রহ করা হবে। সবার সুবিধার কথা বিবেচনা করে প্রতিটি খালি ‘ডং ডং’ চিপসের খোলসের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে এক টাকা। কারও কাছে এই চিপসের খালি খোলস থাকলে, চৌরাস্তায় অবস্থিত বৈদ্যুতিক খাম্বার গোঁড়ায় বেঁধে রাখা ভ্যানে বসে থাকা হাকাউের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ‘ধব ধবে, তক তকে, ফকদমপুর’।
অনুরোধক্রমে
চক্করের পক্ষে‘টেরটেড়িয়া ক্রুশি’।
পরদিন সকাল দশ টার মধ্যেই প্রায় ১০০টি খালি ‘ডং ডং’ চিপসের খোলস জমা পড়ে গেলো হাকাউের দরবারে। হাকাউ মহাখুশি এবং তর্করত্ন তার ‘কল দিস’ পলিসি ব্যাবহার করে পুরো ঘটনাপ্রবাহের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান ‘তকাউ’ এগিয়ে চলল সুপারসনিক বিমানের গতিতে। দশ দিনের মাথায় প্রায় ১০,০০০ চিপসের খালি খোলস জোগাড় হয়ে গেলো। কিন্তু এর পরের দশ দিনে একখানা চিপসের খোলসও জমা পড়লো না। দুজনেরই মাথায় হাত, এখন উপায়? তারা বুঝতে পারলেন, এলাকায় আর নতুন করে খালি চিপসের খোলস পাওয়া যাবে না। অনেকেই আসছে ‘রিং’ চিপসের খালি খোলস নিয়ে, কিন্তু ‘তকাউ’ অভিযানে আপাতত ‘ডং ডং’ চিপস এলাউড, অন্য কোম্পানির চিপস নয়।
তর্করত্নের পরামর্শে, হাকাউ প্রায় দুই হাজার টাকা খরচ করে মেরামত করে ফেললেন তার মরিচা ধরা ভ্যান এবং বেড়িয়ে পড়লেন গ্রাম থেকে গ্রামান্তর, উদ্দেশ্য? ‘ডং ডং’ চিপসের খালি খোলস সংগ্রহ! এই পুরো প্রোজেক্টের খবরাখবর ছড়িয়ে পড়ল সুদূর গাজীপুরের টঙ্গিতে অবস্থিত ‘আজম ফুড প্রডাক্টসে’। পুরো ব্যাপারে তারা বেশ বড় রকমের শিহরণ অনুভব করলেন। কোম্পানির বোর্ড মিটিং এ ‘তকাউ’ এর কার্যক্রম সম্বন্ধে আলোচনা হলো এবং কোম্পানির জেনারেল ম্যানাজার মনে করলেন, এই সুযোগে ‘ডং ডং’ চিপসের একটি বড় রকমের পাবলিসিটি করা যেতে পারে। কোম্পানির পক্ষ হতে নিম্নোক্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলো স্থানীয় একটি পত্রিকায়। বিজ্ঞপ্তিটি নিম্নরুপঃ
আগামী ০১/০১/২০২০ তারিখ হতে ১০/০১/২০২০ তারিখ পর্যন্ত দুটো খালি ‘ডং ডং’ চিপসের খোলস জমা দিলেই পাওয়া যাবে একটি নতুন ‘ডং ডং’ চিপস। ‘আজম ফুড প্রডাক্টস’ এভাবেই এই জেলায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানে অংশ নিতে চায়। আপনাদের সকলের আন্তরিকতায় আমরা গড়ে তুলতে পারি একটি সুন্দর পরিষ্কার জেলা।
আজম ফুড প্রোডাক্টস, টঙ্গি, গাজীপুর।
অনেকদিন কথা নেই ক্রুশির সঙ্গে হাকাউের। ইদানিং মোবাইলে কথা বলার সময় হয় না, সারাদিন ভ্যান চালিয়ে চালিয়ে সময় চলে যায়। ক্রুশির ফোনকলে হাকাউ পুলকিত বোধ করছেন এবং তাদের কথোপকথন নিম্নরুপ:ক্রুশি: কেরং আছি রে, হাকাউ?
হাকাউ: আছু মোটামুটি ভালোয়। তোর তো কুনহ খবরে নাই, এত্তি কতো কি হয় গেইল।
ক্রুশি: মুই খুবে ব্যস্ত রে, সময় পাউ না। তোক মুই ফোন দিনু একটা বিশেষ কারণে।
হাকাউ: আগুত তেহিলে কামের কাথাডায় কহ। পরেশ্যালা অইন্য আলাপ কঢ়া যাবে।
ক্রুশি: তি কি দেখিচি, ‘ডং ডং’ চিপসের দুইডা খালি প্যাকেট জমা দিলে একখান নতুন প্যাকেট দেছে উমহ্রা। জানিস নাকি কিছু?
হাকাউ: তি কি কহচি রে? মোরঠে প্রায় ১০,৫০০ খালি চিপসের প্যাকেট আছে। ব্যাপারটা কি ঠিকে নাকি?
ক্রুশি: মোক পেলুদা কহিল এই অফারের ব্যাপারে। তি এলা কি কঢ়িবা চাহাচি?
হাকাউ: এক প্যাকেট ‘ডং ডং’ চিপসের খুচরা বাঁজার মূল্য ৳ ১০। মুই যদি ১১,০০০ খালি প্যাকেট উমহাক দিবা পারু, তেহিলে মুই পাম ৫,৫০০ নতুন প্যাকেট। ৫,৫০০ প্যাকেট দোকানত বিক্রি করে দিলে, কম করে হইলেও (৳ ৭ প্রতি প্যাকেট) ৩৮,৫০০ টাকা হবে। মুই তো এলাও লাভতে আছু রে।
ক্রুশি: দেখেক, তি যেইডা ভালো মনে কঢ়িস। মোর কহা দরকার ছিল, মুই কহে দিনু। ভালো রহিস।
হাকাউ: ঠিক আছে। তহ ভালো রহিস।
হাকাউ অনেক আনন্দ অনুভব করছেন এবং ভাবছেন, এই খবরটা তর্ককে এখনই জানাতে হবে। হয়ত তর্কের মাথায় আরো কোনো ভালো আইডিয়া আছে। তর্কের সঙ্গে আলোচনাপর্ব শেষে, হাকাউ একটা জটিল রকমের সিদ্ধান্ত নিলেন। আপাতত তার কাছে থাকা ১০,৫০০ খোলসের সঙ্গে আরও এক হাজার পাঁচশ (১,৫০০) খোলস সংগ্রহ করে একবারে ১২,০০০ খোলস কোম্পানিকে দিয়ে ৬,০০০ নতুন ‘ডং ডং’ চিপস নেবেন এবং পরবর্তীতে দোকানে দোকানে গিয়ে বিক্রি করবেন সেই চিপস। কোম্পানির এই অফার চালাকালীন সময়ে ‘ডং ডং’ চিপসের খালি প্যাকেট খুঁজে পাওয়া হয়ে পড়ল দুষ্কর। সবাই দোকান থেকে দুটো করে চিপস একসঙ্গে কিনে, খালি প্যাকেট জমা দিয়ে নতুন একটি চিপস নিয়ে নেয়। তাই আর আগের মতো খালি চিপসের প্যাকেট যেখানে সেখানে ফেলে দেয়ার প্রয়োজন পড়ছে না এবং হাকাউ তার পরিকল্পনায় থাকা ১২,০০০ চিপসের খালি প্যাকেট জমাতে পারছেন না। খালি প্যাকেটের সর্বশেষ সংখ্যা এসে দাঁড়াল ১০,৬০০, মাত্র ১০০ টি প্যাকেট সংগ্রহ করতে পারলেন গত ১৫ দিনে।
হুট করে পেলুদার সঙ্গে হাকাউের দেখা হয়ে গেলো হাজী মার্কেটে। পেলুদা পুরো ঘটনা শুনে হাকাউকে পরামর্শ দিলেন, এখনই সব খালি প্যাকেট দিয়ে নতুন চিপসের প্যাকেট নিয়ে নেয়ার জন্য। উনি হাকাউকে আম-ছালা দুটোই একসঙ্গে চলে যাওয়ার সম্ভাবনার কথাও স্মরণ করে দিলেন। হাকাউ বুঝতে পারলেন, উনি একটু রিস্কি অবস্থায় দাড়িয়ে আছেন। পেলুদার বাস্তবতা সম্পর্কিত জ্ঞান অনেক তীক্ষ্ণ, তার পরামর্শ তর্করত্নের মতোই ভারি।
১৫/০১/২০২০ তারিখ সকাল ৬ টায় হাকাউ তার ভ্যানে ১০,৬০০ টি খালি ‘ডং ডং’ চিপসের প্যাকেট নিয়ে হাজির ‘আজম ফুড প্রোডাক্টসের’ লোকাল ডিপো তে। ডিপোতে ঢুকতেই চোখে পড়ল এক বড় ঘোষণা।
একটি ঘোষণা
‘টু অফ ওয়ান’ অর্থাৎ দুটি খালি প্যাকেটে একটি নতুন চিপসের প্যাকেটের অফার সমাপ্ত হয়েছে গত ১০/০১/২০২০ তারিখ রাত্র ১১:৫৯ মিনিটে। বর্তমানে এই ধরণের কোনো অফার নেই।
ধন্যবাদ।
পড়ুন : প্রথম পর্ব
ডং ডং – দ্বিতীয় পর্ব
বি.দ্র ডং ডং প্রকাশিত হবে প্রত্যেক শুক্রবার। চোখ রাখুন boicharita.com এ।