বাঁশের কুড়ল

প্রথমবারের মতো বান্দরবান যাওয়া। উদ্দেশ্য বেড়ানো। সঙ্গে স্ত্রী ও শ্যালক। যে হোটেলে থাকার জন্য উঠেছি, তার ঠিক সামনেই মিস্কি ব্রিজ-লাগোয়া ‘কলাপাতা রেস্টুরেন্ট’। সাইনবোর্ডে বড়ো করে লেখা রয়েছে-‘চাইনিজ, ইন্ডিয়ান ও বাংলা খাবার পাওয়া যায়’। ততক্ষণে ক্ষুধায় পেট চোঁ-চোঁ করছিল! নির্ধারিত রুমে ব্যাগ-লাগেজ রেখে কোনওরকমে গোসল সেরে হোটেলের রিসিপশনে এলাম। এখানে কোথায় ভালো খাবার পাওয়া যায়-এমন প্রশ্নের জবাবে হোটেলের ম্যানেজার কলাপাতা রেস্টুরেন্টের হদিশ দিলেন।
পরে, এই রেস্টুরেন্টে ঢুকে খাবারের মেন্যু চাইতে গিয়েই চোখে পড়ল টেবিলে পেতে রাখা কাঁচের নিচে থাকা খাবার-তালিকার নাম। সেখানেই লেখা রয়েছে-‘বাঁশের কুড়ল, প্রতি প্লেট ১৫০ টাকা’। এমন একটি অত্যাধুনিক রেস্টুরেন্টে আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের সন্ধান পাব, সেটা কল্পনায়ও ছিল না। মুহূর্তেই জিহ্বা লোভাতুর হয়ে উঠল। শ্যালকের এ নিয়ে খুব একটা আগ্রহ না-থাকলেও স্ত্রী খানিকটা সায় দিলেন। অন্যান্য খাবারের সঙ্গে তাই এক প্লেট ‘বাঁশের কুড়ল’ও অর্ডার দিই।
পাতের পাশে মাছ-মোরগ থাকলেও আমার মূল আগ্রহ ‘বাঁশ-কুড়ল’ নিয়ে। তাই ভাপ-ওড়া গরম ভাতের সঙ্গে এ সবজিটিই মিশিয়ে খেতে শুরু করি। অসাধারণ টেস্ট। কখনও মনে হয় খাবারটি ময়দার তৈরি ‘সোয়াবিন গোটা’র মতো, আবার কখনও মনে হয় ফুলকপির মতো। পেঁয়াজ-সম্বাসে রান্নাকরা এ খাবারটি যেমন মুখরোচক, তেমনই স্বাস্থ্যসম্মত। হোটেল বয়কে ডাকলাম। বললাম, ‘বাঁশের কুড়ল’ কেমন বিক্রি হয়? তাঁর উত্তর ছিল, ‘তেমন না! পর্যটকরা কেউ কেউ খেতে চান। আবার বেশিরভাগই নাক সিট্কান!’ নাক কেন সিট্কান, সেটা বোধগম্য হলো না। এ খাবারের পাচক বাঙালি না আদিবাসী, জানতে চাইলে হোটেল বয় বললেন, ‘বাঙালি। তবে এ খাবার রান্না করাটা পাচক স্থানীয় আদিবাসীদের কাছ থেকে শিখেছেন। কারণ, বাঁশের কুড়ল এখানকার আদিবাসীদের প্রিয় খাবার।’
‘বাঁশের কুড়ল’ যে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা অর্থাৎ রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির আদিবাসীদের প্রিয় খাবার-সেটা নানা বইপুস্তক পড়ে এতদিনে জানা হয়ে গেছে।
‘বাঁশের কুড়ল’ যে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা অর্থাৎ রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির আদিবাসীদের প্রিয় খাবার-সেটা নানা বইপুস্তক পড়ে এতদিনে জানা হয়ে গেছে। আমার বন্ধু পল্লব হোম দাস, যিনি তখন রাঙামাটি জেলা প্রশাসনে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত, একদিন স্থানীয় খাবার প্রসঙ্গে আলাপ উঠলে তিনিও এই ‘বাঁশের কুড়ল’ সম্পর্কে আমাকে বলেছিলেন। এই বাঁশের কুড়ল দিয়ে যে নানা পদের খাদ্যসামগ্রী তৈরি করা হয়, সেটাও তার মাধ্যমেই জেনে নিই। পল্লব আমাকে জানান, রাঙামাটিতে থাকার সুবাদে তিনি বাঁশের কুড়ল দিয়ে রান্না করা অন্তত তিন ধরনের খাবার পরখ করেছেন। এর মধ্যে বাঁশ কুড়লের রোল, তেল ছাড়া ও তেলসহ বাঁশ কুড়লের তরকারি অনন্য উপাদেয়।
বাঁশ কুড়লের রোলের রেসিপি কেমন ধরনের-আমার এমন আগ্রহের উত্তরে পল্লব জানান, প্রথমে বাঁশ কুড়লের উপরের কচি অংশ (আগা) ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি ছিদ্র করে সিদ্ধ করে নিতে হবে। এরপর সিদ্ধ করা বাঁশ কুড়লের আগায় রান্না করা মাংসের কিমা অথবা মাছ ঢুকিয়ে ভাজি করে নিতে হয়। সেটাই পরে গরম গরম পরিবেশন করা হয়। খেতে নাকি এটা খুবই উপাদেয়। এ ছাড়া তেলবিহীন বাঁশ কুড়লের রেসিপি সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে পল্লব আরও জানান, বাঁশ কুড়লের কচি অংশ কেটে ধুয়ে কড়াইয়ে কুড়লের পানি শুকিয়ে নিতে হয়। এরপর পরিমাণমতো চিংড়ি শুঁটকি আর ২/৩টি কাঁচা মরিচ কেটে দিয়ে পরিমাণমতো পানি দিয়ে সিদ্ধ করতে হয়। একইভাবে তেলসহ বাঁশ কুড়ল রাঁধতে গিয়ে প্রথমে বাঁশ কুড়লের কচি অংশ কেটে সিদ্ধ করে পিষে নিতে হয়। পিষানো বাঁশ কুড়লে পরিমাণমতো লবন, চিংড়ি শুঁটকি/চিংড়ি মাছ দিয়ে ভাজি করে নিতে হয়। এরপর এমনতর বাঁশ কুড়লের উপকরণ দিয়ে বেসন ও ডিমের মিশ্রণে বড়া বানিয়ে খাওয়া যায়।
পল্লব আমাকে এ-ও জানিয়েছেন, রাঙামাটির আদিবাসীদের কাছে বাঁশ কুড়লের তৈরি এসব খাবার খুবই জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী। এ খাবার তাঁদের পাশাপাশি বাঙালিদের পরিচালিত রেস্তোরাঁতেও পাওয়া যায়।
পল্লব আমাকে এ-ও জানিয়েছেন, রাঙামাটির আদিবাসীদের কাছে বাঁশ কুড়লের তৈরি এসব খাবার খুবই জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী। এ খাবার তাঁদের পাশাপাশি বাঙালিদের পরিচালিত রেস্তোরাঁতেও পাওয়া যায়।
পল্লবের গল্প করা বাঁশ কুড়লের এমন তিন খাবারের কোনওটাই আমার পরখ করে দেখা হয়নি। আমি মূলত বাঁশ কুড়ল দিয়ে তৈরি করা অনেকটা নিরামিষের মতো ভাজি খেয়েছিলাম। খেয়ে তো দিব্যি ওই খাবারের ফ্যান হয়ে পড়ি! সে স্বাদ এখনও যেন জিভে লেগে আছে! তো, এই যে এতক্ষণ ধরে বাঁশ কুড়ল-বাঁশ কুড়ল জপছি, এটি কী এমন উপকরণ-এ প্রশ্ন তো অজানাদের কাছে উঠতেই পারে। আসলে বাঁশ কুড়ল হচ্ছে বাঁশের গোড়ার কচি নরম অংশ, যা কচি বাঁশের ডগা। কেউ কেউ এটাকে ‘বাঁশের কোরাল’ও বলে থাকে। বিশেষত বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই বংশবৃদ্ধিকালীন বাঁশের গোড়া থেকে গজিয়ে ওঠা এসব নরম অংশ সংগ্রহ করতে হয়। প্রজাতির ভিন্নতার কারণে বাঁশ কুড়লের স্বাদেও ভিন্নতা আসে। খাবারের উপযোগী বাঁশের মধ্যে মুলি বাঁশ, মিতিঙ্গ্যা বাঁশ, ডলু বাঁশ, কালিছুরি বাঁশ, বাজ্জে বাঁশ, ফারুয়া বাঁশ উল্লেখযোগ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িয়াদের কাছে বাঁশের কুড়ল মুখরোচক খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি সবজির মতো রান্না করে খাওয়া যায়। আবার ডালের সঙ্গে কচি বাঁশ কুড়ল মিশিছের রান্না করা যায়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়াও সিলেট অঞ্চলে বাঁশের কুড়লের খাবারের একটা রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। ‘হাঁস-বাঁশ’ নামের ওই খাবারের ঐতিহ্যও সিলেটিদের কাছে স্লাঘার মতো। এই ‘হাঁস-বাঁশ’ খাওয়ার অভিজ্ঞতাও অবশ্য আমার রয়েছে। এ রান্নার রেসিপিও আমার মোটামুটি জানা। এটি শুনিয়েছিলেন সিলেটের বিশিষ্ট রন্ধনশিল্পী কুমকুম হাজেরা মারুফা। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে রান্নাবিষয়ক অনুষ্ঠান করে তিনি এরই মধ্যে পরিচিত। তো, সম্পর্কে ভাবি মারুফা জানিয়েছিলেন, মাংস সচরাচর যেভাবে রান্না করা হয়, ঠিক সেভাবেই রান্না করতে হয় ‘হাঁস-বাঁশ’। কেবল এই মাংসের সঙ্গে বাঁশের কুড়লের কুচি মিশ্রণ করে নিতে হয়। এতে মাংস খুবই সুস্বাদু হয়।
মাংস সচরাচর যেভাবে রান্না করা হয়, ঠিক সেভাবেই রান্না করতে হয় ‘হাঁস-বাঁশ’। কেবল এই মাংসের সঙ্গে বাঁশের কুড়লের কুচি মিশ্রণ করে নিতে হয়। এতে মাংস খুবই সুস্বাদু হয়।
সিলেট ছাড়াও হাওরাঞ্চলে বাঁশের কচি অংশ দিয়ে সবজি রান্না করার বিষয়টি দেখা যায়। আদিবাসীরা যেটাকে ‘বাঁশের কুড়ইল’ বা ‘বাঁশের কোরাল’ বলে, সেটাই হাওরবাসীর কাছে ‘বাঁশের কড়–ইল’ হিসেবে পরিচিত। শুনেছি চাইনিজ এবং মোঙ্গলদের মধ্যেও নাকি কচি বাঁশ খাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। তবে বাংলা কিংবা আদিবাসী জনপদ থেকে নাকি ভিন্ন কোনও দেশের খাদ্যাভাস থেকে বাঁশ-খাওয়ার এই প্রবণতা আমাদের প্রথায় ঢুকেছে, সেটি অনেক খোঁজাখুঁজি করেও হদিশ পেলাম না। সে যাই হোক, আমাদের এখানে যে কথায় কথায় ‘বাঁশ খাওয়া’ নামের একটি নেতিবাচক শব্দবন্ধের ব্যবহার রয়েছে, প্রকৃতই যে এই বাঁশ খাওয়া যায়, সেটা বান্দরবানে গিয়ে ভালোভাবেই টের পেলাম। তবে শৈশবে বাড়িতে এমন কচি বাঁশের রান্না মায়ের হাতে এক-আধবার খেয়েছি বোধহয়, আবছা আবছা এখন তা-ও মনে পড়ে।
সুমনকুমার দাশ : কবি, লেখক, সাংবাদিক ও লোকগবেষক, সিলেট