৭৫তম স্বাধীনতা দিবসে আমাদের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

প্রতিবছর ১৫ আগস্ট সকালবেলায় তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা দিবস চিরাচরিতভাবে পালিত হয়ে থাকে। তদুপরি শহীদ বেদীতে মাল্যদান, স্বাধীনতা দিবস নিয়ে আলোচনা, বক্তব্য, আদর্শ, ইতিহাস, প্রেক্ষাপট, প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোকপাত। আমরা শুধুমাত্র স্বাধীনতার তত্ত্বকথাতেই নিজেদের মতামত জীবনচর্চাকে অবিরাম জুড়ে দিয়েছি। আমরা কখনো ভেবে দেখিনি স্বাধীনতা কি শুধুমাত্র তত্ত্বকথা, পাঠ্যপুস্তকের বিষয়ভিত্তিক আলোচনাতেয় সীমাবদ্ধ? আমরা কখনো নিজেদের মননে জিজ্ঞাসা করিনি কেন স্বাধীনতার সার্বিক প্রসারতা, ব্যাপকতা, অনুপুঙ্খ বাস্তবিক প্রয়োগ সমাজে প্রতিফলিত হলো না। সবক্ষেত্রেই অধিকার, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব, প্রভাব যেন একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। অর্থাৎ খোলসা করে বলতে গেলে স্বাধীনতা যেন এখনো তার পূর্ণবিকাশ, অভিব্যক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সম্পূর্ণ সফল হয়নি। স্বাধীনতা সেই বিমুর্ত চেতনা ধারণা, অভ্যাসে আটকে আছে। এখনো বৈষম্য, অসম্ভব, শ্রেণিবিভেদ, লিঙ্গ বিভাজন, শাসন, শোষণ, নিপীড়ন বঞ্চনা, দুর্নীতি, ধর্মীয় মতভেদ, সাম্প্রদায়িকতার বিভীষিকা প্রতিনিয়ত আধিপত্য বিস্তারে মশগুল। এ স্বাধীনতা আমরা কি চেয়েছি? আমরা চেয়েছিলাম মুক্ত মনের, মুক্তচিন্তার, উদার মনোভাবের, চির শান্তির, নিরাপত্তার, সুস্থভাবে জীবনযাপনের অধিকার সর্বোপরি সসম্মানে মানুষের মত মানুষ হয়ে একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার চিরন্তন অধিকার লাভের। স্বাধীনতা দিবস মানে নিজেকে আরও বেশি দায়িত্বশীল, সমাজ সচেতন, সাংবিধানিক অধিকার মেনে চলে গণতন্ত্রের আদর্শ নিজেকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পুরোদস্তুর গড়ে তোলা। দেখতে দেখতে ৭৪ বছর পার করে আজ আমরা মহান গৌরবের স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষ মূর্তি পালন করছি। তবুও প্রতিমুহূর্তে এই সমস্ত প্রশ্ন আমাদের বিবেকবোধকে জাগিয়ে তুলছে।
একটা সময় শুধুমাত্র ব্রিটিশের শাসন, শোষণ অত্যাচার নিপীড়ন, বঞ্চনা, থেকে মুক্তি পাওয়াই ছিল আপামর ভারতীয়দের প্রতিবাদ, আন্দোলন, বিপ্লব, বিক্ষোভ, মিছিল, অনশন সংগ্রামের আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। বর্তমান মুহূর্তে কিন্তু অন্য অনেক কিছু সমস্যাবলী, প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তি পাওয়ার প্রয়োজন চরমভাবে চলার পথে প্রাত্যহিক জীবনে অনুভূত হয়। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখেনা সমাজ জুড়ে অসহিষ্ণুতার কালো ছায়া, সাম্প্রদায়িকতা তান্ডব লীলা,চিরায়ত ধর্মের নামে হিংসাত্মক কার্যকলাপ, অসহায় ও নিরীহ নারীদের প্রতি অমানবিক অত্যাচার, লিঙ্গ বৈষম্য, নির্যাতন, ধর্ষণ— এই রকম একের পর এক নৃশংস, দগ্ধকর, সামাজিক বিষ আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে বিষময় অস্থির, অসহনীয় করে তুলছে। বিশেষত শতাব্দী প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণে মানুষ বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত শঙ্কিত দিশাহারা। রুটি রুজির কর্মসংস্থান হারিয়ে মানুষ ক্রমশ নিরাপত্তাহীনতায়, অনিশ্চিয়তায় আক্রান্ত। অতিমারিতে পাল্লা দিয়ে বেড়ে গিয়েছে আর্থসামাজিক বৈষম্য। গরিব, প্রান্তিক দিনমজুর, কেটে খাওয়া মানুষদের একেবারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে, অন্যদিকে ধনীরা সম্পদের শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে। চারদিকে শুধুই সামাজিক বৈষম্য, যন্ত্রণার উদ্ভাসিত প্রতিচ্ছবি। মনুষ্যত্ব, মানবতা আজ খাবি খাচ্ছে। বেঁচে থাকার অনাবিল আনন্দ, ছন্দ, সুস্থতা সব যেন একে একে আমাদের কাছ থেকে মলিন হয়ে যাচ্ছে। যে উদ্দেশ্য, ইচ্ছা, প্রতিজ্ঞাকে পূর্ণ করতে আমাদের অগণিত বিপ্লবী, স্বাধীনতা সংগ্রামী, বীর যোদ্ধা, দেশনায়ক জীবনকে বাজি রেখে ছিলেন ব্রিটিশ পরাধীনতার দাসত্ব শৃঙ্খল মোচনে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন। কত প্রাণ, কত তরতাজা যুবক সঁপে দিয়েছিল দেশমাতৃকার প্রতি। আর হিসেব আমরা কজনাই বা রেখেছি। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে ভারতীয়দের সতস্ফুর্ত সংগ্রামে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তারা অর্জন করেছিল ভারতের চির আকাঙ্খিত স্বাধীনতা। তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটি স্বপ্নের বীজ রোপিত হয়েছিল এক শোষণ মুক্ত, সাম্যের, সম্প্রীতির ভারত বর্ষের যেখানে সবাই মিলেমিশে একাকার, সুখে দুঃখে পাশে থাকার অঙ্গীকার, প্রতিমুহূর্তে বাড়িয়ে দেবে সহযোগিতার প্রত্যয়ী হাত, ভুলে যাবে জাতপাত, বেঁচে থাকবে শুধু একটি পরিচয়ে আমৃত্যু ভারতীয় হিসেবে। এটাই ছিল আমাদের স্বাধীনতা দিবসের মূলমন্ত্র।এককালের অপরাজেয় ব্রিটিশ রাজশক্তিকে পরাজিত করেছিল ভারতীয়রা। তার ফলশ্রুতিতে সে দিবসের স্মরণে প্রতি বছর ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস পালনের সুযোগ পাই আমরা। তবে সে পালন শুধু স্মৃতি-নির্ভর, শপথ-নির্ভর নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রকৃত সম্মান জানিয়ে প্রতি বছর ১৫ আগস্ট যদি আমরা শপথ নিতে পারি আজকের সামাজিক বিষগুলোর বিরুদ্ধে সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার, তা হলেই দিনটাকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়। আর সংগ্রামে জিততে পারলে আমাদের প্রত্যেকের স্বাধীনতার অগ্রগতি হয়। স্বাধীনতা দিবস এ বার পালিত হোক সেই সব সামাজিক বিষ থেকে মুক্তি পাওয়ার শপথে।
৭৫ তম স্বাধীনতা দিবসে আমরা সবাই মনেপ্রাণে স্বাধীনতার তাৎপর্য, প্রাসঙ্গিকতা, বাস্তববাদিতা অনুভব করে প্রকৃত ভারতীয় ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসি এই অতিমারিতে অসহায়,নিপীড়িত, কর্মসংস্থানহীন মানুষদের প্রতি খোঁজখবর রেখে বাড়িয়ে দিই সহযোগিতা। এই স্বাধীনতা দিবসে আমরা সবাই ভুলে যাই ভেদাভেদ, বৈষম্য, অশান্তি, অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িকতা। আমরা সবাই ভারতীয় হিসেবে, দেশাত্মবোধ জিগিয়ে তুলে, মনুষ্যত্বের সংবেদনশীলতায় হয়ে উঠি প্রকৃত ভারতীয়। শেষ শেষ পর্যন্ত আমাদের জন্য একটি পরিচয় আমি ভারতীয়। আমরা প্রত্যেকে ভারতের কল্যাণে, বিকাশে সামিল হয়, মতামত দিতে থাকি দেশ গঠনের আহবানে। সেদিনই আমাদের প্রকৃত স্বাধীনতা দিবসের পূর্ণতা।
পাভেল আমান, হরিহর পাড়া,মুর্শিদাবাদ,পশ্চিমবঙ্গ,ভারত