ছাত্রী মানসে কন্যাশ্রী দিবসের গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি : সংগৃহীত
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় ব্যক্ত করেছিলেন-‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।/ বিশ্বে যা কিছু এলো পাপ-তাপ বেদনা অশ্রুবারি/ অর্ধেক তার আনিয়াছে নর, অর্ধেক তার নারী।’অর্থাৎ সমাজ জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই নারী পুরুষ, ছেলে মেয়ে উভয়ের ভূমিকা সমান। তারা যদি একে অপরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, দলবেঁধে, সুখে-দুখে, একে অপরের সঙ্গে পাশে থেকে যে কোনো কাজে শামিল হতে পারে তাহলে নিশ্চিত ভাবে সেখানে সফলতা কাঙ্খিত। এভাবেই ঘুচে যাবে লিঙ্গ, শ্রম বৈষম্য, ভেদাভেদ। সর্বোপরি সৃষ্টি হবে সবার প্রতি সমমনস্কতা, দৃষ্টিভঙ্গি, উদারতা, ভালোবাসা, প্রীতিকর মানসিকতা। প্রকৃত শিক্ষায় সমাজ ও রাষ্ট্রকে কাঙ্খিত অভিমুখে চালু করে। সেখানে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের ভূমিকা অবদান। মেয়েরাও যদি পড়াশোনায় শিক্ষিত হয়ে সংসার সমাজ দেশ রাষ্ট্রে তাদের গ্রহণযোগ্যতা, কার্যকারিতা প্রমাণ করতে পারে তাহলে অবশ্যই তাদের আর্থসামাজিক বিকাশ ঘটবে।
সবক্ষেত্রেই জুড়ে গেছে শিক্ষার ব্যাপকতা, প্রাসঙ্গিকতা, প্রয়োজনীয়তা। আমরা সকলেই অবগত মেয়েদেরকে অর্থাৎ নারী সমাজকে পাদপ্রদীপের পিছনে রেখে সমাজ রাষ্ট্র দেশ প্রগতির পরাকাষ্ঠায় পৌছাতে পারেনা। বিশেষত সেখানে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মেয়েদের বুনিয়াদি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও ধারাবাহিকতা। এক্ষেত্রে আমাদের রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবেদিতপ্রাণ ভূমিকা, অপরিসীম ও প্রশংসনীয়। বিশেষত তাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, সুদুরপ্রসারি, কল্যাণকামী কন্যাশ্রী প্রকল্প বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মেয়েদের মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী নজির সৃষ্টি করে চলেছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না আজ স্কুল কলেজ প্রত্যেকটি ছাত্রীদের কাছেই তাদের জীবনের স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকার তথা উড়ান কন্যাশ্রী প্রকল্প। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারকে নগদ সহায়তার মাধ্যমে মেয়েদের জীবন ও অবস্থার উন্নয়নে পশ্চিমবঙ্গের সরকার কর্তৃক গৃহীত একটি উদ্যোগ, যাতে অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে কোন পরিবার আঠারো বছর আগে তাদের মেয়ে সন্তানের বিয়ে না দেয়। এই প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য, আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা গরিব ও দুস্থ মেয়েদের উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে তুলে আনা।
২০১৩ সালে এ প্রকল্পের সূচনা। এই প্রকল্প তার নক্সা ও সুশাসনের বৈশিষ্ট্যের জন্য একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ এই প্রকল্পটিকে United Nations Public Service Award First Prize সম্মানে ভূষিত করে।সমগ্র রাজ্য জুড়ে এই প্রকল্পটি উন্নীত করার জন্য ১৪ই আগস্ট কন্যাশ্রী দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকের সিলেবাসে পাঠ্য হিসেবে আগেই এসেছে কন্যাশ্রী প্রকল্প। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অন্যতম সফল প্রকল্পের নাম কন্যাশ্রী৷ পড়াশোনার ধারাবাহিকতার পাশাপাশি মেয়েদের স্বাবলম্বী করার উদ্দেশ্যেই সূচনাএই প্রকল্পের৷ টাকার অভাবে গরিব ঘরের মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার যে সমস্যা, তাতে লাগাম টানতে এই প্রকল্প৷ অগণিত ছাত্রীরা উপকৃত হয়েছে সরকারি এই প্রকল্পের ফলে৷ সরকারি অনুদানে মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে নিজেদের সাফল্যের পথে। এই প্রকল্পের সফল রুপায়ন ও বাস্তবায়নের ফলে মেয়েদের স্কুল-কলেজে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রচন্ড ভাবে সৃষ্টি হয়েছে। বাবা-মায়েরাও এখন পূর্বের থেকে মেয়েদের পড়াশোনার প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক ও নজরদারি চালাচ্ছে।
তাদের মধ্যে ছেলে-মেয়ের তফাৎ অনেকটাই দূর হয়েছে৷ সর্বোপরি কন্যাশ্রী প্রকল্পের ফলে আমাদের রাজ্যে পড়ুয়াদের মধ্যে স্কুলছুটের প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে৷ রাজ্যের গন্ডি পেরিয়ে দেশের মধ্যেও সাড়া ফেলেছে কন্যাশ্রী৷ যেমন জনপ্রিয়, তেমনই কার্যকরী এই প্রকল্প৷ মুখ্যমন্ত্রী স্বপ্নের আকাঙ্ক্ষিত, জনহিতকর, ছাত্রী বান্ধব কন্যাশ্রী প্রকল্প প্রকৃতপক্ষে মেয়েদের বিদ্যালয়ের পঠন পাঠন সমাপ্তির পর উচ্চতর পড়াশোনা কেউ কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য চালিত করছে। এই প্রকল্প আমাদের রাজ্যের ছাত্রীদের মধ্যে এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। প্রতিবছর ১৪ আগস্ট কন্যাশ্রী দিবস আমাদের রাজ্যে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উৎসাহ-উদ্দীপনায় পালিত হয়। এ দিবস মেয়েদের পড়াশোনা কে সঙ্গী করে শিক্ষিত,স্বনির্ভর হওয়ার পথে এগিয়ে চলার, প্রকৃত ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে সম্মুখে সাবলীলভাবে গুটিগুটি পদক্ষেপে উদ্বেলিত হয়ে জীবনকে বিকশিত করার স্বপ্নপূরণ।
পরিশেষে কন্যাশ্রী দিবস এ বছরও করোনাকালে আগের মত জাঁকজমকপূর্ণভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রশাসনিক জায়গাতে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখরিত কলতান, সতস্ফুর্ত অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে পালিত হবে না। সবক্ষেত্রেই সংক্রমণ প্রতিরোধে সুরক্ষা বিধির আবশ্যিকতা। তবুও এই দিবসে রাজ্যের আপামর ছাত্রীরা স্বপ্ন দেখে কোভিড বিধির নিয়মাবলী খুলে যাক পঠন-পাঠনের জন্য স্কুলের দরজা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কন্যাশ্রী যোদ্ধারা মিলিত হয়ে আবারও গড়ে তুলুক মেয়েদের শিক্ষার প্রসারতা, বাল্যবিবাহ রোধ, ড্রপ আউট এর সংখ্যা কমিয়ে আনা। প্রত্যেক ছাত্রীদের জীবনে নিয়ে আসুক কন্যাশ্রী দিবস সুস্থতার পরিবেশ, লড়াকু মানসিকতা, পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার মনোভাব সর্বোপরি প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজে সংসারে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা।
পাভেল আমান, হরিহরপাড়া, মুর্শিদাবাদ,পশ্চিমবঙ্গ, ভারত