আমি আমাকে চিনেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই!

চারপাশে এত মৃত্যুর সংবাদ। এমন একটি পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি নিয়ে লিখতে শুরু করেছি, জানি না কেমন লিখতে পারব। তবে ভাবে ঠিক করলাম, লিখব যখন লিখেই ফেলি। কী লিখব— চিন্তা করতে করতে যখন মনের টাইমমেশিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে স্মৃতিতে ফিরে গেলাম, তখন মনের অজান্তেই আমার মুখে হাসি, কখনো বা চোখের কোণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলরাশি খেলা করতে লাগে। মনে হচ্ছে, আমার দিকে— আমার এই বদ্ধ রুম, রুমের সব আসবাবপত্র রহস্যের জাল বিছিয়ে নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
যাই হোক, এখন বেশি বক বক না করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলে ভালো হয় তাই না!
সময়টা তখন ২০১৭ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির জন্য কোচিং করছিলাম ফার্মগেটে। যে সময় এখনকার মতো ছিল না করোনার ভয়াবহতা। মনে প্রাণে বিশ্বাসে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কাছে পাওয়ার আকুল আবেদন। আমার কলেজ ঢাকায় হওয়ায় কারণে ঠিক করে নিয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ব।
কোচিংয়র ভাইয়েরা যে কত ধরণের মোটিভেশন দিয়ে থাকে! তেমনি এক ভাইয়া বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে একটু ঘুরে আসতে। ক্যাম্পাসটা ঘুরে আসলে অনুপ্রেরণা আসবে।
ভাইয়ের কথা মতো অনুপ্রাণিত হয়ে কয়েকজন বান্ধবী মিলে ক্যাম্পাস ঘুরতে গেলাম। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বলতে মনে করতাম কলা ভবনকেই। নীলক্ষেতে এসে রিক্সাওয়ালা মামাকে বললাম, মামা কলা ভবন যাব । উনি রাজু ভাস্কর্যের সামনে নামিয়ে দিলেন। কিন্তু আমরা কলা ভবন খুঁজেই পাচ্ছিলাম না। ওখান থেকেই আরো একটা রিক্সা নিলাম কলা ভবন যাওয়ার জন্য। ওই মামা কার্জন হলের সামনে নামিয়ে দিয়ে বলেন, এটাই কলা ভবন। ভিতরে গিয়ে দেখলাম উপরে লেখা কার্জন হল। কিন্তু কলা ভবন আর খুঁজেই পাই নি। সে সময় অপরিচিত কারো কাছে জিজ্ঞেস করতে অনেক সংকোচ লাগত।
যাই হোক সংকোচ ঝেড়ে জিজ্ঞেস করি, কলা ভবনটা কোথায়? পরে শেষ পর্যন্ত যখন কলাভবনে আসলাম দেখি, এ তো একই জায়গা! এই ঘটনা মনে পড়লে এখনো অনেক হাসি পায়।
অবশেষে ভর্তি হলাম স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরু হলো আমার ক্যাম্পাস জীবন। প্রথম বর্ষে ভর্তির কয়েক মাস পর কুয়েত মৈত্রী হলের গণরুমে জায়গা হলো। গণরুমে টিকে থাকা অন্য ধরণের সংগ্রাম ।
নতুন ক্যাম্পাস, নতুন পরিবেশ,নতুন পরিচয়, কত শত নতুন মুখ, আড্ডা, দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো সব কিছু মিলিয়েই ভালোই উপভোগ করেছিলাম। এভাবে কেটে গেল প্রথম বর্ষের ক্যাম্পাস জীবন। টিএসসির ঘাস, চারুকলা, বিকেলের কার্জন, ডাকসুর সামনের সেই কসমেটিক্স মামার অল্প দামের সুন্দর কানের ঝুমকো সব কিছুই যেন আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যেতে লাগল।
নতুন ক্যাম্পাস, নতুন পরিবেশ,নতুন পরিচয়, কত শত নতুন মুখ, আড্ডা, দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো সব কিছু মিলিয়েই ভালোই উপভোগ করেছিলাম। এভাবে কেটে গেল প্রথম বর্ষের ক্যাম্পাস জীবন। টিএসসির ঘাস, চারুকলা, বিকেলের কার্জন, ডাকসুর সামনের সেই কসমেটিক্স মামার অল্প দামের সুন্দর কানের ঝুমকো সব কিছুই যেন আমার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যেতে লাগল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে বিসিএস ক্যাডার হব, এই গতানুগতিক চিন্তা ভাবনা নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। যদিও ভর্তির পর পরবর্তিতে আমার চিন্তাভাবনা বদলে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন কর্মশালা, বিভিন্ন মানুষের সান্নিধ্যে আমার চিন্তা ভাবনার জগতে ইতিবাচক পরিবর্তনের ছোঁয়া আসে।
এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে আমি কতটা মূর্খ, কত কম জানি। এরপর থেকে আমার মধ্যে সব সময় এই বিষয়টা কাজ করত যে, আমি আমি অনেক অনেক কম জানি। আমাকে প্রচুর প্রচুর পড়তে হবে, জানতে হবে, শিখতে হবে। আস্তে আস্তে আমি বুঝতে শিখেছি বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র ক্লাসে গেলাম ,পড়া মুখস্ত করলাম, ভালো সিজিপিএ নিয়ে বের হয়ে গেলাম— তা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে প্রকৃত মানবিক গুণাবলি অর্জনের জায়গা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৪ জেলার মানুষের মিলনমেলা। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা জগতের মানুষের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা—বলতে যতটা সহজ মনে হয় বাস্তবে কিন্তু অতটা সহজ নয়। ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন চিন্তাভাবনার মানুষের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত না হয়েও শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে খাপ খাইয়ে নেওয়ার যে শিক্ষা সেটি আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেই পেয়েছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৪ জেলার মানুষের মিলনমেলা। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা জগতের মানুষের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলা—বলতে যতটা সহজ মনে হয় বাস্তবে কিন্তু অতটা সহজ নয়। ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন চিন্তাভাবনার মানুষের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত না হয়েও শ্রদ্ধাবোধ বজায় রেখে খাপ খাইয়ে নেওয়ার যে শিক্ষা সেটি আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকেই পেয়েছি। আমি মনে করি, এই যে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিকে হোক, সেটা ধর্মীয় বা সামাজিক বা রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্মান দেখানোর শিক্ষা একজন মানুষের ব্যক্তিগত জীবন বলি সামাজিক বা কর্মজীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এই শিক্ষাটা খুবই জরুরি।
হলে যখন প্রথম উঠেছিলাম তখন হলের একজন বান্ধবী প্রথম প্রথম মিশত না। কিন্তু আমি খেয়াল করেছিলাম, সে আমাকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করত। পরে কয়েক মাস পর যখন মিশতে শুরু করলাম তখন বের হলো পর্যবেক্ষণের রহস্য। পরে সে একদিন বলল, ‘তুই তো দেখি আমাদের মতোই, তুই অনেক ভালো’ । পরে কারণ হিসেবে বলল, কলেজে থাকতে তার কোন একজন শিক্ষক নাকি বলেছিলেন,‘পাহাড়িরা অনেক হিংস্র হয়, কারণ ওরা জঙ্গলে থাকে’। এটা শোনার পর প্রথমে খুবই হাসি পেয়েছিল। পরে অবশ্য আমাদের সম্পর্কে এমন নেতিবাচক ধারণা শুনে অবাক হয়েছিলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় এরকম কয়েক জনের কাছ থেকেই এই রকম বলতে শুনেছি , আমরা একই দেশেই থাকি অথচ চাকমা, মারমা এবং এ রকম অন্যান্য যে জনগোষ্ঠি রয়েছে তোমাদের সম্পর্কে আমরা তো তেমন কিছুই জানি না। জানলেও খুবই সীমাবদ্ধ এবং বেশিরভাগ তথ্যই ভুল। আমার কাছে আমাদের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে চাইত। তারাও আমাদের সম্পর্কে জানতে পারত আমিও তাদের সম্পর্কে জানতে পারতাম। এভাবে একেক জেলার মানুষের সঙ্গে পরিচয় সেটি সম্ভব হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে আমার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস তৈরিতে সহায়তা করেছে। তা কীভাবে করেছে সেটি জানতে আমাদের আবার হলে ফিরে যেতে হবে। কুয়েত মৈত্রী হলে থাকার সময় একটি সাইকেল নিলাম। আমার প্রথম টার্গেট ছিল হল থেকে কলা ভবন পর্যন্ত। হয়ত কাছে মনে হলেও আমার জন্য অতটা সহজ ছিল না। আমি ভালো মতো সাইকেল চালাতেই পারতাম না। শহরের রাস্তায় তো ভাবতেই পারি না। হলের সামনের রাস্তাটায় কয়েকদিন অনুশীলন করেছিলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে আমার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস তৈরিতে সহায়তা করেছে। তা কীভাবে করেছে সেটি জানতে আমাদের আবার হলে ফিরে যেতে হবে। কুয়েত মৈত্রী হলে থাকার সময় একটি সাইকেল নিলাম। আমার প্রথম টার্গেট ছিল হল থেকে কলা ভবন পর্যন্ত। হয়ত কাছে মনে হলেও আমার জন্য অতটা সহজ ছিল না। আমি ভালো মতো সাইকেল চালাতেই পারতাম না। শহরের রাস্তায় তো ভাবতেই পারি না। হলের সামনের রাস্তাটায় কয়েকদিন অনুশীলন করেছিলাম।
নীলক্ষেতের মোড়টা আমার অনেক ভয় লাগত। তার চেয়ে বেশি ভয় লাগত রাস্তায় বের হলেই আশেপাশের লোকেদের নানা ধরনের কুমন্তব্য ,চাইনিজ চাইনিজ, চিং চাং চুং বলে নানা ধরনের টিটকারি, সাইড দিতে একটু দেরি হওয়ায় কেউ বা পাশ দিয়ে বলে যাচ্ছে, মামুনি রাস্তাটা তোমার সাইকেল সাইকেল খেলার জন্য না, খেলার মাঠে যাও এ ধরনের নানা রকমের আজে বাজে কথা। এই বিষয়গুলো মনে পড়লে খুব বিরক্ত লাগে।
আশেপাশের মানুষের কত উপহাস উপেক্ষা করে যখন নীলক্ষেত মোড় ক্রস করে কলাভবনে পৌছালাম সেদিন মনে হলো আমি পারি এবং ভবিষ্যতেও যেকোনো কাজ যতই অসাধ্য হোক পারব। আমার মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস কাজ করা শুরু হলো। বিষয়টি হয়ত আপেক্ষিকভাবে ক্ষুদ্র মনে হতে পারে কিন্তু আমার কাছে “পারব” মানসিকতাটা অনেক কিছু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম, লাইব্রেরি ছাড়াও ক্যম্পাসের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকেও শেখার আছে। সেদিন সকাল ৮টার ক্লাস ছিল। রোকেয়া হল (দ্বিতীয় বর্ষে কুয়েত মৈত্রী হল থেকে রোকেয়া হলে শিফট হয়েছিলাম) কলা ভবনের কাছে হওয়ায় মনে হত এখান থেকে এখানেই তো কয়েক মিনিট আগে ঘুম থেকে উঠলেই হলো। তাই সকালে ওঠেই কোনো রকমে ফ্রেস হয়ে দৌড় দিলাম। আসার সময় মনে হলো আমার খাতা শেষ হয়ে গেছে। ক্যাফেটেরিয়ার সামনে যে মামাটা বসেন ওনার কাছ থেকে খাতা কিনলাম। টাকা দিতে গেলে দেখলাম আমার কাছে ভাংতি নেই। পরে উনি আমার ক্লাসে দেরি হচ্ছে দেখে নির্দ্ধিয়ায় বলেন, মামা খাতাটা নিয়ে ক্লাসে যান, সমস্যা নেই। ক্লাস থেকে ফেরার সময় কোথাও ভাংতি করে দিয়ে যাবেন আর কি!
সেদিন আমার খুব লজ্জা লেগেছিল। আমি যেখানে পরিচিত বন্ধুদের বিশ্বাস করতেও হাজার বার ভাবি, সেখানে তিনি আমাকে চিনেনও না আমার উপর এতটা বিশ্বাস রাখলেন। সেদিন আমি বুঝেছি, মানুষ মানুষের মধ্যে বিশ্বাস থাকাটা জরুরি। মানুষকে বিশ্বাস করতে পারাটাও একটা গুণ।
প্রায় দেড় বছর ধরে পৃথিবী সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় আছি। অপেক্ষার অবসান হোক। একটি প্রবাদ আছে “বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে”।
এই লিখাটি লিখতে লিখতে ইচ্ছে করছে এখনি ক্যাম্পাসটা এক চক্কর দিয়ে আসি। যদিও করোনার মহামারির সময়ে এটি কেবল ইচ্ছার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। প্রায় দেড় বছর ধরে পৃথিবী সুস্থ হওয়ার অপেক্ষায় আছি। অপেক্ষার অবসান হোক। একটি প্রবাদ আছে “বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে”। ঠিক তেমনি আমাদের মতো তরুণচিত্তের মানুষকে চিরসবুজ ক্যাম্পাসেই মানায়, চার দেয়ালের বদ্ধ রুমে বড্ড বেমানান!
তবে যে কথাটি না বললেই নয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ১০০ বছরে পদার্পণ করলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই ঐতিহ্যবাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বিশ্বমানের গুণগত শিক্ষার আশা করাটা অপরাধ হবে না বলেই আশা করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সকল সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে বাংলাদেশকে নতুন দিগন্তের দিশা দেখাবে এটিই কাম্য। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে অনেক ব্যবধান তারপরেও আমার নিজেকে চিনার, জানার, শিখার এবং বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেই হয়।
রেশমী চাকমা: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়