ভালোবাসা ও মায়ার রোকেয়া হল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে অসংখ্য স্মৃতি থাকলেও সবচেয়ে সমুজ্জলবোধয় রোকেয়া হলের স্মৃতি। আমার কাছে এটা কেবল মাত্র আবাসিক হলই নয় বরং আমার দ্বিতীয় বাড়ি। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষে এসে এই হলকে নিয়ে লেখাটাই সবচেয়ে সমীচীন বলে ধারণা করি। ২০১৬ এর ১৫ জানুয়ারিতে ছিল আমার ভাইভা, সেদিনই জানতে পারলাম আমার জন্য বরাদ্দকৃত হল হচ্ছে রোকেয়া হল। বাংলাদেশ প্রথম মেয়েদের হল এটি, তাই ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের এক অনব্দ্য সংমিশ্রণ এই হলে আমি থাকতে পারবো ভেবে খুশিই হয়েছিলাম।
২০১৬ তে ভর্তির পর মোহম্মদপুরের হোস্টেল হলো আমার বাসস্থান, প্রতিদিন তরঙ্গ বাসে বা দুরঝোলা হয়ে যাতায়াত করি, এইভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন৷
এর মাঝে অবশ্য গেটের দাদুদের চোখ ফাকি দিয়ে বার কয়েক হলের ডাইনিং ক্যান্টিনে লাঞ্চও করে এসেছি। অবশেষে অক্টোবরে একদিন হল থেকে জানানো হলো হলের আবাসিক হলতে ইচ্ছুকদের মধ্যে থেকে আমিও মেনে নিত হয়েছি, বাবা আর মামাকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম গার্জিয়া নমিটিংএ। নানান ধাপ পেরিয়ে অবশেষে বরাদ্দ হলো N-34 রুমটি, দ্বিতীয় সেমিস্টার ফাইনালের পর একদিন নিজের বেডিং আর জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হলাম রুমে। যদিও আমার হলে ওঠার তেমন কোনো ইচ্ছা ছিলো না কারণ হোস্টেলে দিনগুলো ভালোই কাটছিল। আর সত্যি বলতে একটা ভয়ও কাজ করছিল নতুন পরিবেশ নিয়ে। হল সম্পর্কে নানা ভীতিকর কথাও শুনেছিলাম। কিন্তু বাবার এক কথা, হলে না থাকলে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন নাকি বৃথা। তাই অগত্যা হলে উঠতে হলো।
এ ব্যাপারে বলতে গেলে আমি সত্যিই ভাগ্যবান ছিলাম। প্রত্যেকে এত মিশুক আর অমায়িক ছিল তা ভাষায় প্রকাশ সত্যিই সম্ভবনা। আমি ছিলাম রুমে সবচেয়ে জুনিয়র তাই সব আপুদের যথেষ্ট ভালোবাসা পেয়েছি।
এ ব্যাপারে বলতে গেলে আমি সত্যিই ভাগ্যবান ছিলাম। প্রত্যেকে এত মিশুক আর অমায়িক ছিল তা ভাষায় প্রকাশ সত্যিই সম্ভবনা। আমি ছিলাম রুমে সবচেয়ে জুনিয়র তাই সব আপুদের যথেষ্ট ভালোবাসা পেয়েছি।
হলের যেভাবে দিন যেত
রোকেয়া হলের দিনগুলো আমার জন্য আক্ষরিক অর্থেই স্বর্ণালি সময়। পূর্বেই বলেছি রুমে সবচেয়ে জুনিয়র ছিলাম তাই আপুদের কারনে অকারণে জ্বালিয়েছি। সময়ে অসময়ে শাড়ি পরার আবদার ছিল সবচেয়ে বেশি। তারপর দল বেধে সন্ধ্যায় চা খেতে যাওয়া ডিএমসির গেটে, অথবা দোয়েল চত্ত্বর এ অকারণে ঘোরাঘুরি কিংবা সমাজবিজ্ঞান চত্ত্বরের ফুচকা পার্টি এসব ছিল নিত্যকার কাজকর্ম। বৃষ্টির দিনে আপুদের সঙ্গে ভিজতে যেতাম৷ আর মেঘ করলেই আমাদের খিচুড়িপার্টি ছিল বাধ্যতামূলক।
পহেলা বৈশাখের আগের দিন রাত্রে সাজুগুজু ট্রায়াল দেয়া, পরদিন ঘুরতে বের হওয়া আবার দুপুরে হল থেকে খাবার সংগ্রহ করে খাওয়া-দাওয়া করা সবাই মিলে এগুলো কখনো পুরানো হবে না।
রোকেয়া হলে থাকাকালীন সবচেয়ে বেশি যে স্মৃতিটা মনে পরে তা হচ্ছে প্রোভোস্ট বাংলোর বাতাবি গাছ থেকে বাতাবি চুরির ঘটনাটা। ঝুম বৃষ্টিতে রুমের সিনিয়রদের নেতৃত্বে গিয়েছিলাম বাতাবি পারতে। ফেরার পরহলের বন্ধ সবজি দোকান অনেক অনুনয়-বিনয় করে খুলিয়ে কাচামরিচ উদ্ধার করি আমরা। সেসব দিনগুলো সত্যিই অসাধারণ।
রোকেয়া হলে থাকাকালীন সবচেয়ে বেশি যে স্মৃতিটা মনে পরে তা হচ্ছে প্রোভোস্ট বাংলোর বাতাবি গাছ থেকে বাতাবি চুরির ঘটনাটা। ঝুম বৃষ্টিতে রুমের সিনিয়রদের নেতৃত্বে গিয়েছিলাম বাতাবি পারতে। ফেরার পরহলের বন্ধ সবজি দোকান অনেক অনুনয়-বিনয় করে খুলিয়ে কাচামরিচ উদ্ধার করি আমরা। সেসব দিনগুলো সত্যিই অসাধারণ।
হলের পূজার ডিজেমানেই অন্যরকম একটা আনন্দ ছিল আমাদের কাছে, আবার দলবেধে ক্রিকেট দেখাত হল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আমার দ্বিতীয় বাড়ি
হল আমার কাছে আমার বাড়ির চেয়ে কিছু কম ছিল না কখনোই । অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন ঢাকায় থাকলেও ঘুরেফিরে এখানেই শান্তি পেতাম। এমন কি অসংখ্যবার অসুস্থ হয়েছি৷ কখনো ভয়াবহ জ্বর আবার কখনো চিকেনপক্স। প্রতিবারই রুমমেটরা সবাই মিলে যত্ন করে খাইয়েছে ওষুধ, জল ঢেলেছে মাথায়। বন্ধুরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছে ক্লাস বাদ দিয়ে
আপুদের সাথে পলাশী আর নিউমার্কেট এ বাজার করতে শেখা আমার। আগে এসব কিছুই পারতাম না।
সময়ের পরিক্রমায় সিনিয়র হয়েছি, আমার জুনিয়র এসেছে। রুম বদলে ৭ মার্চ ভবনে গিয়েছি কিন্তু হলের যে আবহতা কখনোই ম্লান হয়নি। বরং নতুন নতুন পালক যুক্ত হয়েছে সেখানে । যখন কোন জুনিয়র বলে আপু আপনি অসাধারণ, ঠিক নিজের বোনের মতোন আপনি তখন মনে হয় আমার জীবন কিছুটা হলেও সার্থক হয়েছে।
সহযোগিতা, ধৈর্য্য, যে-কোন পরিবেশে মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা তা সব কিছুই এই হল থেকে পাওয়া। আমার মতো নছন্ন ছাড়া অগোছালো মানুষকে সংসার করতে শিখিয়েছে হল জীবন। এই সংসারটা কিন্তু কেবল মাত্র পরিবার কেন্দ্রিক না, জীবনে টিকে থাকার, আনন্দে থাকার শিক্ষা এটা। অসংখ্য স্মৃতির সাথে সাথে এখানে এসে আমি দারুণ কিছু মানুষের দেখা পেয়েছি।দারুণ কিছু সিনিয়র, অসম্ভব ভালো কিছু জুনিয়র।
আমার কাছে রোকেয়া হল হচ্ছে বাকি জীবন স্মৃতিরোমন্থন করার সবচেয়ে বড় উৎস। কিন্তু সেই স্মৃতির উৎসে হঠাৎই ছন্দ পতন। কখনো হলের মাঠে শুয়ে শুয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে তারা গোনা, কখনো জুনিয়রকে বিপদে শান্ত্বনা দেয়া, আবার কখনো অকারণেই শাড়ি পরে রাতে কোরিডোরে ঘোরাঘুরি করা কিংবা কোন অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সবাই মিলে সামিল হওয়া।
করোনা পরিস্থিতি সব কিছুর মত হঠাৎই হল জীবনেও এনেছে এক ছন্দ পতন। ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি ফেরার দিনও জানতাম সাতদিন পরই ফিরে আসব। কিন্তু এখনো জানি না আদৌও ফেরা হবে, কি হবে না। হয়তো ফিরব, হয়তো বা এখানেই সমাপ্তি ঘটবে একটা সুন্দর স্বর্নালী অধ্যায়ের। তবে আজীবন হলের স্মৃতি আমার সঙ্গে থাকবে। জীবনে আরেক বার যদি হলে জীবনে কাটানোর সুযোগ আসে, সেই অফার লুফেনিতে দ্বিতীয়বার ভাববো না কখনো। এই জায়গাটা যেন প্রতিটা মানুষকে এক অদৃশ্য মায়ায় বেধে রাখে। এভাবেই টিকে থাকুক ভালোবাসার আর মায়ার রোকেয়া হল।
প্রিয়ন্তী কর্মকার : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বইচারিতায় আরও পড়ুন :
ক্যামেরার কারণে আমার কাজের মান ভালো হয়ে গেল : গোলাম মুস্তফা, পর্ব-১
কোপা আমেরিকা স্বপ্নের ফাইনালে ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনা
সেই ছোট-খাটো মানুষটি
কম বয়সে উপন্যাস লিখে গিনেস বুকে নাম লিখালেন সৌদি বালিকা রিতাজ আলহাজমি
কারিনার নতুন বই ‘কারিনা কাপুর খান’স প্রেগন্যান্সি বাইবেল’
আর্জেন্টিনা, ভালোবাসার নীল সাদা নাম
ভালোবাসা ও মায়ার রোকেয়া হল
শুধু মেসির জন্য..
3 thoughts on “ভালোবাসা ও মায়ার রোকেয়া হল”