ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের অনুভূতিতে মিশে থাকা এক জীবন্ত নাম

সেই ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করে আজ ১০০ তে পূর্ণ হয়েছে। এই ১০০ বছরের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে অর্জনের পাল্লায় যেমন যোগ হয়েছে নানান পালক তেমনি প্রত্যাশা পূরণের প্রশ্নে বারবার হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ সহস্র শিক্ষার্থীদের প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়। তারপরও এই বিদ্যাপিঠ আমাদের প্রাণের স্পন্দন, আমাদের ভালোবাসার জায়গা, আমাদের অনুভূতিতে মিশে থাকা এক জীবন্ত নাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, একটি স্বপ্নের নাম, একটি সাধনার নাম। চোখে মুখে হাজারও স্বপ্ন নিয়ে ভর্তি যুদ্ধে অংশ নেওয়া। তারপর এই যুদ্ধে জয়ী হয়ে ভর্তি হওয়া। দেখতে শুরু হয় নানা স্বপ্ন আর প্রত্যাশা। স্বপ্ন ছোঁয়ায় হাত বাড়ায়। লাল নীল কত যে রঙিন স্বপ্ন হাতে স্পর্শ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে যে সব স্থানগুলো আমার সবচেয়ে বেশি ভালো বা আকর্ষণ লাগে। তা হলো কার্জন হল,শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়,বটতলা, আমতলা, টিএসসি, মধুর ক্যান্টিন, বকুলতলা,শহীদ মিনার,ভিসি চত্বর,মর্ল চত্বর, সবার প্রিয় ফুলার রোড আর জীবন বদলে দেওয়া গ্রন্থাগার।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রতিটি শিক্ষার্থীর এই স্থানগুলোর সঙ্গে পরিচয় থাকে এবং কিছু স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। এই ধরুন কার্জনের কথা মনে হবে সবুজ গালিচায় মোড়ানো একটি ছোট্ট শহর। বিষন্ন মনে যদি একা হেটে বেড়ান তখন আপনার মনে অনেক ভাবনার উদয় হবে। আপনি কবি না হলেও হয়তো কয়েকটি লাইন মুখ থেকে বেরিয়ে আসবে। হয়ত এমনও হতে পারে একটি পুরো কবিতাই বলে ফেলতে পারেন। খালি পায়ে হেঁটে বিকেলে নিজেকে সময় দেওয়ার জন্য একটি উত্তম জায়গা। কিন্তু আপনি যদি বিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষার্থী হয়ে থাকেন তাহলে আপনার কাছে ঠিক ততটা সৌন্দর্য ফুটে ওঠবে না। যেমনটা ধরা পড়ে অন্যান্য অনুষদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। আর আপনি যদি কখনো বন্ধুদের সঙ্গে সেখানে যান তাহলে আড্ডার জন্য একটি উপযুক্ত জায়গা। তবে কার্জন হল সবচেয়ে বেশি পরিচিত কাপলদের জন্য। এটা নাকি প্রেম করার আদর্শ জায়গা। আমি যদি কবি হতাম তাহলে একটা কবিতা লিখতাম ঠিক এইভাবে লিখতাম –
`এই সবুজ চাদরে মুড়িয়ে থাকা এক টুকরো পৃথিবী
প্রেয়সীর চোখে তাকিয়ে থাকা এক অনন্য দৃষ্টি
ললাটে একটি চুমু এঁকে দেওয়া এক পশলা বৃষ্টি
আর বন্ধুদের সাথে কাটানো কিছু, হয়তো হয়ে যেত কিছু অনাসৃষ্টি’
কার্জনে গিয়ে পুকুর পাড়ে বসবে না এমন মানুষ খুব কম পাওয়া যায়। এই ধরুন না আমার কত মন খারাপে একাকিত্বের সঙ্গী এই পুকুড় পাড়।

টিএসসি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রাণকেন্দ্র। টিএসসি নিয়ে যদি লিখতে যাই তবে কয়েক পৃষ্ঠা শেষ হয়ে যাবে। টিএসসি একটি জীবন্ত প্রতীক হয়ে থাকে প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী জীবনে। টিএসসির সবুজ ঘাসে বসে কাটানো প্রতিটা মূহুর্ত কিংবা সুইমিং পুলে বসে জন্মদিনের কেক কাটা, ক্যাফেটেরিয়ার চা, চপ, সিংগাড়া সঙ্গে এক টাকার চা যেন আজও অনবদ্য ভাবে আড্ডার উপকরণ কিংবা কারও খুদা নিবারনের জন্য মাত্র ১০ টাকায় যোগান পাওয়া যায়। আর টিএসসির চায়ের দোকানগুলো তো এক একটি উপন্যাস হয়ে যাবে। টিএসসির জনতা ব্যাংকের কথা আর কি বলব প্রত্যেক শিক্ষার্থী জন্য যাওয়া বোধ হয় ফরজ। এক কাপ চায়ের ধোঁয়ার সঙ্গে কত গল্প জুড়ে যায় তা প্রতিটা কাপের হিসেব করলে কয়েকশ উপন্যাস হয়ে যাবে।
আমার সঙ্গে যদি কোনো কবির ভালো পরিচয় থাকত তাকে টিএসসি নিয়ে একটা কবিতা লিখতে বলতাম আর নিচের লাইনগুলো সেই কবিতায় রাখার জন্য অনুরোধ করতাম।
‘এক কাপ গরম চা সাথে উড়ে যাওয়া ধুয়া
বন্ধুর হাতের অর্ধেক সিগারেট
রং চা, আদা চা,মালটোবা, মরিচ কিংবা দুধ চা
আমাদের গল্পের বয়ে যাওয়া ধারা
অলস বিকেল কিংবা, তপ্ত দুপুরের আভা
ঠিক যেনো মিলে যায় আবার কোনো হারানো সন্ধ্যা
তারপর হয়তো এতদিন লিখা হতো অমর কিছু কবিতা..’

বটতলা, আমতলা ওই দুইটা জায়গা আমার পছন্দের। আবার অপছন্দের কিছু কারণ আছে। এই দুইটা জায়গা দুইধরনের অনুভূতি সৃষ্টি করে। আপনি যখন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের দিন যাবেন দেখবেন যত মিটিং আছে সব বটতলায়। তার ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যাবে আমতলায়। এই আমতলা ছিল ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দানের স্থান। কিন্তু এখন এই আমতলা সবচেয়ে বেশি পছন্দের জায়গা হল প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য। তারা প্রেম করার জন্য এটাকে উপযুক্ত জায়গা মনে করে। আমার পছন্দের কারণ হলো আমার ভার্সিটি লাইফের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার মূহুর্তগুলো বেশিরভাগ কেটেছে এই দুটো স্থানে। আর অপছন্দের কারণ হলো হিংসা, কেন হিংসা করতাম সেটা নিশ্চয় সবাই বুঝতে পারবে। যদি কখনো স্মৃতির পাতায় এই দুটো স্থান উকি দেয় তখন হয়তো দুটো লাইন মাথায় আসবে
‘তুমি দেখতে তেমন সুন্দর নও, নও মনের মতো
তবে তোমায় আমি মনে রাখবো, যনমে যতকাল পাবো’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডের প্রেমে পড়ে না এমন মানুষ নাকি খুব কম পাওয়া যায়। যদি তাদের গণনা করা হয় তাদের ভিতর আমাকে একজন পাওয়া যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোড, ভিসি চত্বর দিয়ে বৃটিশ কাউন্সিল, শহিদ মুনির ভবন,উদয় স্কুল অ্যান্ড কলেজ, এসএম হলের দেওয়াল ঘেঁষে স্বাধীনতা স্তম্বতে গিয়ে মিশেছে। আমি প্যারিস রোডের প্রেমে না পড়লেও ফুলার রোডের প্রেমে পড়েছি। এই রাস্তার অনুভূতিগুলো দারুণ। কালো পিচ ঢালা পথ, কেমন যেন একটু এঁকেবেঁকে চলে গেছে। বন্ধুদের সঙ্গে হাঁটার সময় গলা ছেড়ে গান এক অনন্য অনুভূতি তৈরি করে। আবার যখন বিষন্ন বিকেলে একা একা হাঁটা শুরু করি তখন কেন যেনো বিরহের কবিতা বেরিয়ে আসতে চায়। বিরহ বেশি ভালোবাসি তাই বোধ হয় এমনটা হয়। অনেকের মুখে শুনা যায় প্রেমিকার সঙ্গে হাঁটার জন্য নাকি ফুলার রোড অসাধারণ জায়গা। আবার এটাও শুনতে পাওয়া যায় বেইলি রোডের প্রেমের মত নাকি ফুলার রোডের প্রেমও টিকে না। কিন্তু শেষ অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি। তবে ইচ্ছে ছিল ফুলার রোড নিয়ে একটি ছোট্ট কবিতা লিখবে, কিন্তু লিখা হয়নি কখনো। তবে যদি লিখেই ফেলতাম তবে কেমন হতো-
‘ওই পিচ ঢালা পথে
পায়ে পায়ে হেঁটে, হাতটি ধরে
কিছু রঙিন স্বপ্ন নিব কি কুড়িয়ে
বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায়, খালি পায়ে
আমাদের পায়ের ছাপ রয়ে যাক প্রতিটি ধাপে
একটু পর মুছে যাবে তাপে কিংবা বৃষ্টির জলে
যে ভালোবাসা আছে মনে, রেখে দিও মনের সিন্ধুকে’

ভিসি চত্বরের আসল সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় বৃষ্টি ভেজা বিকালে কিংবা কাক ভেজা ভোরে। যারা হলে থাকে তাদের আড্ডা দেওয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় জায়গা হলো ভিসি চত্বর। এখানে সবচেয়ে বেশি আড্ড দেওয়া হয় প্রথম বর্ষে। অনাবাসিক ছাত্র হলেও টিএসসির পর৷ সবচেয়ে বেশি আড্ডা দেওয়ার জায়গা হলো ভিসি চত্বর৷ ভিসি চত্বরের সবচেয়ে মজার বিষয় হলো প্রক্টরিয়াল টিম আর ফ্ল্যাক্সে করে চা এবং সিগারেট বিক্রেতাদের চোর পুলিশ খেলা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার- ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা কলেজ ও’ ল ‘কলেজ থেকে প্রাপ্ত ১৮ হাজার গ্রন্থ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে প্রায় ৯ লক্ষ গ্রন্থ ও জার্নাল এবং প্রায় ৩০ হাজার পাণ্ডুলিপি রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার শিক্ষার্থীদের জন্য একটি মহামূল্যবান প্রাপ্তি।একজন শিক্ষার্থী জন্য যা যা দরকার তা এই লাইব্রেরিতে সংগ্রহ করা আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার- ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা কলেজ ও’ ল ‘কলেজ থেকে প্রাপ্ত ১৮ হাজার গ্রন্থ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে প্রায় ৯ লক্ষ গ্রন্থ ও জার্নাল এবং প্রায় ৩০ হাজার পাণ্ডুলিপি রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার শিক্ষার্থীদের জন্য একটি মহামূল্যবান প্রাপ্তি।একজন শিক্ষার্থী জন্য যা যা দরকার তা এই লাইব্রেরিতে সংগ্রহ করা আছে। আমরা আমাদের এই গ্রন্থাগার নিয়ে খুবই গর্বিত। সবসময় ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারণায় মুখরিত থাকে এই গ্রন্থাগারের প্রতিটি কক্ষ। পৃথিবীর কোনো দেশে মনে হয় না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভোর ৬ টায় পড়াশোনা করার জন্য গ্রন্থাগারে লাইন ধরে। একটি সিটের জন্য যুদ্ধ। এই যে যুদ্ধ এটা কিন্তু সাধারণ কোনো যুদ্ধ নয়। নিজেকে তৈরি করার যুদ্ধ। একটি চাকরি যোগাড় করার যুদ্ধ। নিজেকে তৈরি করার যুদ্ধ। নিজের খেটে খাওয়া পরিবারটাকে একটি সুন্দর স্বপ্ন দেখানোর যুদ্ধ।
মিরাজ হোসেন সবুজ, পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সুন্দর লেখনী 💚💚
ধন্যবাদ