ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার ক্রাশ এবং আমি

তখন আজকের চেয়ে দ্বিগুণ বোকা ছিলাম! সমসাময়িকতার বিষয়গুলো সম্পর্কে অজ্ঞ ও অসচেতন ছিলাম। তখন সবে নবম শ্রেণি! কোনো এক অনুষ্ঠানে এক সিনিয়র ভাই আমার জীবনের স্বপ্ন কী জানতে চেয়েছিলেন! সেদিন বুক ফুলিয়ে জবাব দিয়েছিলাম, ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব’! আমার আত্মবিশ্বাসী উত্তর শোনে ‘ওয়েলডান’ বলে পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্বপ্ন দেখলে সর্বোচ্চটাই দেখতে হবে। মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়’। সেদিন কীভাবে এমন আত্মবিশ্বাস এসেছিল নিজেই বুঝতে পারিনি। তবে সেই সিনিয়র ভাইয়ের উৎসাহ আমাকে দারুণ অনুপ্রাণিত করেছিল।

এরপর কেটে যায় বছর দুয়েক। মাধ্যমিক শেষে শিক্ষা সফরে যাওয়ার সুযোগ হয়। চট্টগ্রাম, ঢাকা হয়ে খুলনা। সুন্দরবন, বাগেরহাট কুষ্টিয়া থেকে আবারও ঢাকায়। রাজধানীতে নেমে জাতীয় জাদুঘর, ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের শিখা অনির্বাণ ঘুরে প্রথমবারের মতো যাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেদিনই প্রথম জাতীয় কবির মাজার দেখা আমার। প্রথমবারের মতো কবিকে শ্রদ্ধা জানাই। সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে দেখি। অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাস্কর্য, টিএসসি, শহীদ মিনার হয়ে কার্জন হল দেখে আমার বুক কেঁপে উঠেছিল বারবার। ক্রাশের সামনে নব্য প্রেমিকের বুক যেমনি করে দুরু দুরু করে, সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে আমারও একই অনুভূতি হয়েছিল। সেই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার ক্রাশ। আমার প্রথম প্রেম, আমার কচি মনের আকাঙ্ক্ষা। আমি তাকে আপন করে পাওয়ার প্রতিজ্ঞা করি সেদিন।

রাতের বাসে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি সেদিনই। ক্রমেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার ঘোর হয়ে ওঠল। রাতের ঘুম কেড়ে নেয় কার্জনের লাল ভবন। বাড়িতে কাউকে কিছু বলিনি তখনও। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতে থাকি। যত সময় গড়িয়ে যাচ্ছে ততই আমার স্বপ্নের পালে হাওয়া লাগছে। দেখতে দেখতে চলে আসে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময়কাল। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার সময় নিজের আগ্রহের কথা জানাই বাড়িতে। কিন্তু ঢাকায় আসতে দিতে কেউ রাজি নন। একেকজন অজুহাতের গ্রন্থ খুলে বসতে শুরু করলেন বাড়িতে। আমার সহজ-সরলতা ও বোকামিতেই তাদের যত ভয়। ঢাকায় গিয়ে যদি তাদের সন্তান কোথাও হারিয়ে যায়! না, এত দূরে যাওয়ার চেয়ে বরং আশপাশে কোথাও পড়া যাবে— এই হলো সবার চিন্তা। কিন্তু আমি জানি আমাকে। আমার স্বপ্নের হিসাব আমি রেখেছি অক্ষরে অক্ষরে। বাড়ির সকলের শত অনুৎসাহি চিন্তার মধ্যেও দমে যাইনি। স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। অবশ্য আমার সেই স্বপ্নের পথে একজনের হ্যাঁ-সূচক কথা সাহস বাড়িয়ে দিয়েছিল আমার। তিনি আমার বড় ভাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে তিনি সমর্থন করলেন। পরে বাড়ির সবাইকে বুঝাতে সক্ষম হই। তবুও বলা যায়, একধরনের জোরাজুরি করেই আমার এই রাজধানীতে আসা।

সেইসব দিনগুলোতে ঢাকায় আমার আশপাশে কেউ ছিল না। কারও কারও গাইডলাইনও পাইনি! তাতে কী! নিজের মত করে পথ চললাম! পথ চলতে গিয়ে কত ধাক্কা খেলাম। কতবার থেমে গেলাম। মাঝে মধ্যে চরম অসহায়ত্ব ভর করত। বুকের ভেতরে হাহাকার রব উঠে যেত। বিশেষ করে কক্সবাজার থেকে অচেনা ঢাকা অসহ্য লাগত প্রথমদিকে। কিন্তু হতাশ হইনি। ভেঙে পড়িনি। ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে শুরু করি। আমার মনে পড়ে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ঢাকার আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষাই দিইনি। একটাই লক্ষ্য ছিল। সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়। তার নাগাল পেতে কত কিছু করেছি। বহু সংগ্রামের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছিলাম!
এভাবেই সান্নিধ্য পেয়ে যাই আমার ক্রাশের। স্বপ্নের ক্যাম্পাসে পদার্পণ করে আমার আত্মপরিচয়ের ঠিকানা খুঁজে পাই। সূচনা হলো নতুন জীবনের। নিজেকে আবিষ্কার করতে শুরু করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়ে অক্সফোর্ডের কথা আর মাথাতেই আসেনি। এতটাই উন্মাদ ছিলাম তখন। সেই থেকে আমার শ্রেষ্ঠ পরিচয় হয়ে উঠল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমি একটা ঠিকানা খুঁজে পেলাম। আমার প্রকৃত ঠিকানা!

বলা বাহুল্য, আমি কোনো উচ্চ চাকরির স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসিনি। যদিও বাড়ি থেকে অনেকে অনেক রকম স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু আমি চলেছি সব সময় আমার রাস্তায়। আমার চিন্তা, ভালোলাগা-ভালোবাসা যেদিকে আমাকে টেনেছে, আমি সেদিকেই পথ চলেছি। মূলত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলাম শেখার জন্য, জানার জন্য, নিজেকে খুঁজে পাবার জন্য। আমি চাচ্ছিলাম, প্রচলিত গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। চাচ্ছিলাম, বক্সের বাইরে চলে আসতে। তা আমি অনেকটাই সম্ভব করেছি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি একাডেমিক জায়গায় সিরিয়াস ছিলাম না। বেশি নাম্বার পাওয়ার জন্য শিক্ষকদের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত সম্পর্কও গড়ে তুলিনি। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক যেটুকু রাখা প্রয়োজন ছিল, ঠিক ততটুকুই রেখেছি। যা বুঝেছি, যেটুকু জেনেছি ঠিক ততটুকুই উত্তর লিখে শেষ করেছি খাতা। তাছাড়া কক্সবাজারের ছেলে হিসেবে দেশের অন্য অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের তুলনায় আমার অনেক সীমাবদ্ধতাও ছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল আঞ্চলিকতার টান। অতিরিক্ত সরলতা ও বোকামি। আমি প্রথম দিকে কথা বলতে ভয় পেতাম। মগজে অনেক কিছু খেলা করত। কিন্তু ভাবপ্রকাশে ছিলাম আনাড়ি। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেকে বদলে ফেলতে শুরু করি। সাহস বৃদ্ধি পেতে থাকে। মূলত বিশ্ববিদ্যলয়ে আমার বিচরণ ছিল শ্রেণিকক্ষের বাইরে বেশি। ক্যাম্পাসের ছাত্রছাত্রী, পরিবেশ, নানামুখী জীবনাচরণ থেকে যা শিখেছি, পুরো ৫/৬ বছরের স্নাতক-স্নাতকোত্তরের শ্রেণিকক্ষ থেকে তার সিকি ভাগও শিখতে পারিনি।
আমার কাছে বিশ্ববিদ্যালয় মানে স্কুলের ক্লাস-পরীক্ষা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় মানে উন্মুক্ত আকাশ। এখানে বিশ্বজনিন চর্চা হবে। মুক্তমনে জ্ঞান চর্চা করবে। নতুন কিছু করবে। ভিন্ন কিছু। আমি ব্যাপারটিকে সেভাবেই দেখতাম। যেদিকে যেতাম, হা করে তাকিয়ে থাকতাম। বিস্ময় নিয়ে দেখতাম ক্যাম্পাসের পরিবেশ, ৬৪ জেলার শিক্ষার্থী ও তাদের জীবনের নানা দিক ও তাদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা! উপভোগ করতাম সবকিছু। সত্যি বলতে, একটা হলুদ পাতার ঝরে পড়া দেখেও আমি বিস্মিত হয়েছি! এভাবেই আমি পরিবেশ-প্রতিবেশে বৈচিত্র্যময়তার সান্নিধ্যে যাওয়ার চেষ্টায় ব্রত ছিলাম। এভাবেই চিনেছি মানুষ, সেখান থেকে শেখা অনেক কিছুই! আমি শিখেছি ভিন্ন মতকে কীভাবে গ্রহণ করতে হয়, ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-মত-পথ সবকিছুর উর্ধ্বে উঠে কীভাবে জীবন পরিচালনা করতে হয়, এই ক্যাম্পাস আমাকে গভীর দেশপ্রেম শিখিয়েছে, দৃঢ়চেতা মানসিকতা জাগ্রত করেছে, বাকশক্তি যুগিয়েছে। এখানে আমি শিখেছি, কীভাবে নিজের লোভী মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, কীভাবে গর্ব-অহংকার থেকে দূরে থাকতে হয়, মুর্খতা, কপটতা, স্বার্থপরতাকে পদদলিত করে কীভাবে বিনয়ী ও নম্রভাবে নিজের সঠিক কাজটি করে যেতে হয়!

আমার সেই ক্রাশ আজ শতবর্ষ পেরিয়ে যাচ্ছে। ১ জুলাই তার শততম জন্মবার্ষিকী! এমন দিনে তাকে কীভাবে শুভেচ্ছা জানাতে হয়, তার ভাষাও খুঁজে পাইনি যুতসই! এই বিদ্যাপীঠের কাছে আমি ঋণী, খুব বেশি ঋণী। সেই ঋণ শোধ করা কঠিন। শুরু থেকে আমার চেষ্টা ছিল এমন কিছু করা, যাতে করে সামান্য হলেও ঋণ শোধ করতে পারি।
সেই চেষ্টা থেকে সৃজনশীল ও আত্মপ্রত্যয়ী কিছু মানুষকে একত্রিত করে প্রতিষ্ঠা করেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ। কাউকে দেখাতে বা জানান দিতে নয়। নিজেকে বড় কিছু হিসেবে তুলে ধরার জন্য নয়, টিভি-মিডিয়ায়-সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হতে নয়। নিজের হীনস্বার্থ হাছিলের জন্যও নয়। সেই চিন্তা মাথাতেই আসেনি কোনোদিন। বর্জনই ছিলো আমার ব্রত। আগামীর উন্নত দেশ ও উন্নত বিদ্যাপীঠের প্রয়োজনে সামান্য হলেও ভূমিকা রাখা ছিলো লক্ষ্য। আমি চেয়েছি, এমন একটি প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে যেটি ইত:পূর্বে দেশের কোথাও হয়নি, কেউ যা করেনি, করতে পারেনি। এমন একটি নতুন কিছু,যেটি একটি উদার, মননশীল ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে সহায়ক হবে।
২০১৬ সালের ৬ ডিসেম্বর এই সংগঠনের যাত্রা। বহু সংগ্রাম, বাঁধা, চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে গবেষণা সংসদ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নিজস্ব সহপ্রতিষ্ঠান। সংগঠনটি তার আদিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে। শত শত শিক্ষার্থী কোনো না কোনোভাবে উপকৃত হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্ব রাখছে। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের তরুণরা। এই সংগঠন দেশ ছেড়ে বিশ্বে সাড়া ফেলছে। আগামীতে আরও সাড়া ফেলবে। আগামীর উন্নত বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত হচ্ছে সবাই।
সেই মাধ্যমিক পরীক্ষার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আমার ক্রাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষের দিকে আমি আমার নতুন প্রেমিকার সন্ধ্যান পেলাম। আর সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ। এখন এই ক্যাম্পাসের প্রতি আমার দ্বিগুণ প্রেম, দ্বিগুণ আবেগ, বহুগুণ ভালোবাসা। আমার এই ভালোবাসার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বহুদূর যাবে। বাংলাদেশকে কাঁধে বহন করে নিয়ে যাবে উন্নত বিশ্বের কাতারে-এমনটাই স্বপ্ন দেখি আমি। সে পথে ভূমিকা রাখবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ।
সেই মাধ্যমিক পরীক্ষার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আমার ক্রাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষের দিকে আমি আমার নতুন প্রেমিকার সন্ধ্যান পেলাম। আর সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ। এখন এই ক্যাম্পাসের প্রতি আমার দ্বিগুণ প্রেম, দ্বিগুণ আবেগ, বহুগুণ ভালোবাসা। আমার এই ভালোবাসার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বহুদূর যাবে। বাংলাদেশকে কাঁধে বহন করে নিয়ে যাবে উন্নত বিশ্বের কাতারে-এমনটাই স্বপ্ন দেখি আমি। সে পথে ভূমিকা রাখবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ।
আর তাই তাকে তার মূল জায়গায় ফিরতে হবে। আগামীর পৃথিবী দাঙ্গার-হাঙ্গামার, রাজনীতিক কলাকৌশল বা নিছক গুটিবাজির হবে না। আগামীর পৃথিবী হবে বুদ্ধিবৃত্তিক, মস্তিষ্কের, চিন্তা-চেতনার, গবেষণা ও উদ্ভাবনের! উদার মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশকে সেই ধারায় রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রস্তুত হতে হবে। ‘মাথা উঁচু করে হাজার হাজার বছর দাঁড়িয়ে থাকুক আমার প্রাণের বিদ্যাপীঠ, আমার শ্রেষ্ঠ ক্রাশ।
সাইফুল্লাহ সাদেক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ
অনেক সুন্দর লিখেছিস বন্ধু…