বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে ঠেকে গিয়ে আবার ওঠে দাঁড়াতে হয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সন্ধিক্ষণ। কিছু ক্ষেত্রে যা চেয়েছি তার চেয়েও বেশি কিছু পেয়েছি, আবার কিছু ক্ষেত্রে যা চাইনি তাও পেয়েছি। এখানে চান্স পাওয়া থেকে শুরু করে ভর্তি হওয়া, সবকিছুই আমাকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন করেছে। এই মিশ্র অনুভূতি আর অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণেই আমার প্রিয় ক্যাম্পাস জীবন। তবে সবার স্বপ্নের চেয়ে আমার স্বপ্নটা ছিল একটু আলাদা৷ এইচএসসি পর্যন্ত ছিলাম বিজ্ঞানের ছাত্রী। স্বপ্ন দেখতাম একটি সাদা এপ্রোনের। কোনো এক মেডিকেল কলেজের করিডোর দিয়ে সাদা এপ্রোন পরে হেঁটে যাচ্ছি। সে স্বপ্নটা শেষ হয়ে যায় এইচএসসি পরীক্ষা ফলাফলের পরেই। মনোস্থির করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। এক্ষেত্রে ভাগ্য খুব বেশি সুপ্রসন্ন ছিল না আমার জন্য।

সারাজীবন গণিত ভালোবেসে যাওয়া মেয়েটা সাব্জেক্ট হিসেবে পেয়ে গেলাম সমাজবিজ্ঞান। সেই থেকে বিচিত্র এই ঢাকা শহরে প্রথম আমার একা একা থাকার শুরু। ভর্তি হতে এসেছিলাম বাবার সঙ্গে, ভর্তির বিভিন্ন কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাবা আমাকে পুরো ক্যাম্পাসটা খুব ভালো করে ঘুরে দেখিয়েছিল। সেদিন এই ক্যাম্পাস এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে মনে একটা অদৃশ্য স্বপ্ন হাতছানি দিয়েছিল। সেই থেকেই আমার নতুন এক পথচলার শুরু। তবে সে পথের শুরুটা খুব সহজ ছিল না আমার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন এক অদ্ভুত গোলকধাঁধা, এরমধ্যে একবার ঢুকলে বের হওয়া খুব কঠিন। আমিও পারিনি, মায়ায় আটকা পরে গেছি। আস্তে আস্তে এই ব্যাস্ততম শহরের ব্যস্ততম মানুষগুলোর প্রতিও এক অদ্ভুত মায়া জন্মে গেল।

প্রথম বর্ষে আমার হল ছিল সুফিয়া কামাল। রোজ সকাল শুরু হত দোয়েল চত্বরের জ্যাম ঠেলে সমাজবিজ্ঞান চত্ত্বর যাওয়া নিয়ে। আর তারপর লাইব্রেরির সামনে থেকে এক কাপ চা আর একটা ২০ টাকা দামের স্যান্ডউইচ হাতে নিয়েই দৌড়, লিফটের চার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিকেই খুব ভালো কিছু বন্ধু পেয়ে গেলাম, ক্লাস শেষে সারাদিন তাদের সঙ্গে আড্ডা, খুনসুটি, ঘোরাঘুরি এসবের যেন কোনো কমতি ছিল না আমাদের। এটিই ছিল আমাদের সবচেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর সময়। হল দূরে থাকায় আর ক্লাসের ফাঁকে হলে যাওয়া হত না। সকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত পুরো ক্যাম্পাসে যেন আমাদেরই বিচরণ। কখনো টিএসসি, কখনো আমতলা-বটতলা, কখনো সমাজবিজ্ঞান চত্ত্বর।

সন্ধ্যা হলে হাকিম চত্ত্বরে মামার হালিম আর টিএসসির স্বপন মামার চা। এছাড়া ফুলার রোড, সেন্ট্রাল ফিল্ড, কার্জন এর মাঠ, শহীদুল্লাহ্ হলের পুকুরপাড় কতশত গল্প আর স্বপ্ন বুনেছি এসব জায়গায় তার হিসেব মেলানো দায়।
দুপুরে ক্যাফেটেরিয়ার ফ্রাইড রাইস অথবা টিএসসি/ডাকসুর ২০ টাকার লাঞ্চ। আর বিকেল হলেই শ্যাডোর চার নম্বর দোকান। সন্ধ্যা হলে হাকিম চত্ত্বরে মামার হালিম আর টিএসসির স্বপন মামার চা। এছাড়া ফুলার রোড, সেন্ট্রাল ফিল্ড, কার্জন এর মাঠ, শহীদুল্লাহ্ হলের পুকুরপাড় কতশত গল্প আর স্বপ্ন বুনেছি এসব জায়গায় তার হিসেব মেলানো দায়। ঘড়িতে যখন ঠিক সাড়ে নয়টা দৌড় দিতাম হলের গেটে। কিন্তু জীবন তো সমভূমির ন্যায় সমতল না, এখানে রয়েছে হাজারটা বাক, তাই ভালো সময়ের পর অনেক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখিও হতে হয় জীবনে।

এখানেও রোজ সূর্য ওঠে, সূর্য ডুবে যায় আর বেঁচে থাকে আমাদের কোলাহল আর কলতানে মুখরিত এই প্রিয় ক্যাম্পাস, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস” যা আমাদের স্বপ্নের চেয়েও অনেক বড়।
আসেপাশের পরিচিত মুখগুলো হঠাৎ যেন অচেনা হতে শুরু করল, বুঝতে পারলাম বন্ধুত্বের নতুন সংজ্ঞা। একবার না বারবার ভেঙেছি, যতবার ভেঙেছি ততবার নিজেকে নতুন করে গড়েছি। এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে ঠেকে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়াতে হয়, কিভাবে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে হয়। রোজ সকাল হয় আর রোজ নিজেকে একটু একটু করে নিজের স্বপ্নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় আমার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট, এখানে দেখা পেয়েছি মেধাবী ও রুচিশীল কিছু হৃদয়ের। তাদের থেকে প্রতিনিয়তই শিখছি, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা অন্তহীন। এখানেও রোজ সূর্য ওঠে, সূর্য ডুবে যায় আর বেঁচে থাকে আমাদের কোলাহল আর কলতানে মুখরিত এই প্রিয় ক্যাম্পাস, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস” যা আমাদের স্বপ্নের চেয়েও অনেক বড়।
রেজওয়ানা হক, সমাজবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।