ফিরে আসুক মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের মুল্যবোধ

৩৯ নিউ এলিফেন্ট রোড কাজী ভবন।
মাধুরী আমেরিকা থেকে একটি হলুদ গোলাপের পোস্ট ফেসবুকে দিয়েছিল। হলুদ গোলাপ আমাকে নস্টালজিক করে তোলে।আমার জীবনে শৈশবে প্রথম হলুদ গোলাপ দেখা,ধানমন্ডি ৫ নম্বর সড়কে।মাধুরির পোস্টে মন্টি বসাক হলুদ গোলাপ,আর তিতাস দোকানের কথা উল্লেখ করাতে, আমার মনে পড়ে গেল, ৩৯ নিউ এলিফেন্ট রোডের কাজী ভবনের সিগল,সেবা ফার্মেসীসহ আরও অনেক দোকানের কথা—
আমার জন্ম ৫০ দশকে ৬/বি আজিমপুরের কলোনিতে।আজিমপুর আমাকে অনেক দিয়েছে,মধ্য বিওের মুল্যবোধ,যৌথ জীবন,দেশ প্রেম,সমাজের শ্রেষ্ঠ, মানুষদের দেখা—তাঁদের মধ্য উল্লেখ্য অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ডাক্তার টি এ চৌধুরী, তাঁর বড় ভাই জীবুদা তখন কার ঢাকার প্ল্যানার,চিত্রকর আব্দুল বাসেদ, লেখক শাহেদ আলী,সানজিদা খাতুন,ওয়াহেদ চাচা, নভেরা আহম্মেদসহ অগণিত মানুষের।
আমাদের ছিল যৌথ পরিবার।আমার বাবা চাচারা ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর ঢাকায় এসে সরকারি চাকরির সুবাদে আজিমপুর কলোনির বাসা বরাদ্দ পেয়েছিলেন। আমার বাবা কলকাতায় চাকরিকালীন যা সঞ্চয় করেছিলেন, তা দিয়ে গুলবাগে(বর্তমান নিউ এলিফেন্ট রোডে) ১২, কাঠার ধানি জমি ৫০০ টাকায়, একজন দুধ বিক্রেতার কাছ থেকে, তাঁদের পৈত্রিক জমি ক্রয় করেছিলেন।শুনেছি আমার জন্মের আগে।কারণ আমার জন্ম হবার পর থেকে আমার স্মৃতিতে দোতালা ঐ বাড়িটি।তখন কার দিনের গোলাকার নকশায়।
ঐ বাড়িটি এক সময় সমাজের বর্তমান নামী দামী অনেক মানুষ, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য রাজনীতিবীদদের আশ্রয় স্থল ছিল—ছিল অফিস ঘর। যাদের ঢাকায় কোনো ঠিকানা ছিল না। আমার মা বাবা ছিলেন উদার মনের মানুষ।তাঁদের নিজ বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন দু’বেলা খাবার খাওয়াতেন, চায়ের কেটলি সে তো সারাদিন চুলায় চাপানো থকত।আমার মা বলতেন তাঁদের রিজিক আমার কাছে নিয়ে এসেছে। অনেকে দেখেছি অফিস ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।যারা এখন ঢাকা শহরে হাজার কোটি টাকার মালিক।
আমাদের ছিল যৌথ পরিবার,আমার দাদা ছিলেন প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন। তিনি তাঁর চাকরিজীবি ছেলের বাইরে অন্য ছেলেদের দিয়ে ঔষধের ব্যবসা শুরু করেছিলেন।তখনকার মানুষ ছিলেন সৎ। সরকারের নির্ধারন করে দেয়া শতকরা ১৫ ভাগ লাভে ঔষধ বিক্রি হত। আমার স্মৃতি যদি ভুল না করে।
আগেই উল্লেখ্য করেছি,আমাদের ছিল যৌথ পরিবার,আমার দাদা ছিলেন প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন। তিনি তাঁর চাকরিজীবি ছেলের বাইরে অন্য ছেলেদের দিয়ে ঔষধের ব্যবসা শুরু করেছিলেন।তখনকার মানুষ ছিলেন সৎ। সরকারের নির্ধারন করে দেয়া শতকরা ১৫ ভাগ লাভে ঔষধ বিক্রি হত। আমার স্মৃতি যদি ভুল না করে।
আমরা থাকতাম ৬/বি আজিমপুর কলোনির বাড়িতে।এলিফেন্ট রোডের বাড়ি ভাড়ায় থাকতেন ডাক্তার ইদ্রিস লস্কর চাচা (তৎকালীন সময়ের নাম করা মেডিসিন ডাক্তার) নিচে থাকতেন মঈনুদ্দিন মানিক বিখ্যাত বিচারপতির বাবা। তখন জানতাম তিনি জাহাজ কোম্পানীর মালিক।(আমার ভুল হতে পার তাঁর বাবার কর্মস্থল সম্পর্কে)
মুক্তিযুদ্ধের চালাকালীন সময়ে থাকতেন মীনারা জামান চাচী। ১৯৬৬ সালে আজিমপুরের বাসা ছেড়ে আমরা উঠে এলাম তখনকার গুলবাগের বাড়িতে।এখন নিউ এলিফেন্ট রোডের যে প্রশস্ত রাস্তা তখন তা ছিল না। আমাদের বাড়ির উল্টো দিকে একটা সরু রাস্তা, সে রাস্তাটি পুরনো এলিফেন্ট রোডে গিয়ে মিলিত হয়েছিল।আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে সাইন্স ল্যাবরেটরির কোয়াটারে যাওয়ার এবং পেছনের বাড়িতে যাওয়ার রাস্তা ছিল।৬৬ /৬৭ সালের দিকে নিউ এলিফেন্ট রাস্তাটির জন্ম হয়।প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিল,মিরপুর রোড থেকে রাস্তাটি সংযোগ হবে তখনকার কনটিনেন্টাল (বর্তমানে সে নামটি আবার ফিরে এসেছে) এর সাথে।সার্ভে করে দেখা গেল—মিরপুর রোড থেকে যদি হোটেল কন্টিনেন্টালের সঙ্গে সংযোগ করা হয়,অনেক দোতালা স্থাপনা ভাঙ্গা হবে।তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পরে পিজি হাসপাতালের সঙ্গে সংযোগ স্থাপিত হয়।যেদিন রাস্তার জন্য বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভাঙ্গা হয়েছিল, আমাদের সামনের একতলা বাড়িটি যখন ভাঙা হয়।তখন বসার ঘরে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমার চাচা,চাচার বন্ধু মজিদ চাচা, দেখছিলেন বাড়ি ভাঙ্গার দৃশ্য ।বাড়িটি ছিল মজিদ চাচার। হঠাৎ আমার চাচা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন, মজিদ চাচা দাঁড়িয়ে হাসছেন।কারণ হিসাব জানতে পারলাম আমার বাবা,মজিদ চাচা এক সাথে জমি ক্রয় করেছিলেন।মজিদ চাচা সরকারি চাকরির সুবাদে আমেরিকা যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল।সেখানকার জমানো টাকা, আমার চাচাকে পাঠাতেন, চাচা সেই টাকা দিয়ে বন্ধুর জন্য বাড়িটি খেটে খুটে তৈরি করে দিয়েছিল।মজিদ চাচা বলছিলেন, আমি তো শুধু টাকা পাঠিয়েছি, এ বাড়ির উপর যত শ্রম কাশেমের।তাই সে সহ্য করতে পারেনি।
রাস্তার কাজে দুজন প্রকৌশলী নিয়োগ ছিল।তাঁদের নাম আমার মনে নেই। আমার বড়বোন লাভলী আপা, মেজদী মিলে নাম দিয়েছিলেন—একজন রোগা প্রকৃতির ছিলে তার নাম ভাতে মরা ইঞ্জিনিয়ার,আরেকজন স্বাস্থ্যবান, মোটা সোটা ভোদাই ইঞ্জিনিয়ার। ভাতে মরা,ভোদাইর সঙ্গে আমার বেশ ভাব জমে গিয়েছিল,আমি তাঁদের বাসা থেকে চা পানি পান করাতাম।
আমদের বার ভাই–বোনদের স্কুল ছিল আজিমপুর ওয়েস্টেন্ড, ল্যাবলটরি,ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরিতে।আমরা স্কুল ছুটির পর কেউ বাড়ি ফিরতাম না।যে যার পছন্দের আজিমপুর খালাদের বাড়িতে ঢুকে যেতাম।তখনকার সম্পর্কগুলো ছিল, যৌথ জীবন বা সম্মিলিত জীবনের।আমার মনে পড়ে, ৬৪/৬৫ সালে কামরুন্নেসা,বাংলাবাজার স্কুলে আমাদের কলোনির বড় বোনরা তখন ঘোড়ার গাড়ি চড়ে স্কুলে যেতেন।বাড়ির দরজায় এসে আয়া ডাক দিতেন আপা গাড়ি আইসে।বোনেরা বাসা থেকে বের হয়ে ঘোড়া গাড়িতে উঠে স্কুলে যেতেন— স্কুলে ভাত খেয়ে রওনা হতেন।যে কোনো এক বাড়িতে ভাত আগে রান্না হলে, সে বাড়ির ভাত খেয়েই তারা রওনা করতেন। কলোনির মা খালাদের নতুন শাড়ী পড়ার প্রথম অধিকার ছিল কলেজে যাওয়া আপাদের।মা খালারা মার দেওয়া পাট ভাঙ্গা শাড়ি পড়তে অভ্যস্ত ছিলেন না।তাঁরা পড়ে দিলে অতঃপর ধুয়ে তারা পড়তেন। স্কুল থেকে আমাদের বাড়ি ফেরার দেরি দেখে আম্মা চিন্তিত হয়ে নাকের পানি চোখের পানি এক করে রওনা হতেন আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসার জন্য।পরে বাধ্য হয়ে চাচার নামে বরাদ্দ কৃত আজিমপুরের বাড়িতে আমাদের আবার ঢুকে পড়া।
বার ভাই বোনের সবার আজিমপুর কলোনির বাসায় জায়গা সংকুলান হত না তাই পরবর্তিতে আমরা বড় ভাই বোনরা এলিফেন্ট রোডের বাড়িতে, ছোটরা থাকতেন আজিমপুরের বাসায়।
মুক্তিযুদ্ধে অনেকের জীবনের উত্থান পতন হয়েছে— আমাদের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীর প্রতীক ভাই মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বাবা মা ভাই বোনকে হারিয়ে অনেকটা মানসিক অশান্তিতে ছিলেন।আমার মা তাঁকে সন্তানের মতো আগলে আজিমপুরের সেই ছোট বাড়িতে নিজের কাছে রেখেছেন।ঘরে সংকুলান হত না।সিঁড়ি ঘরে পাটিশন দিয়ে ঘর করে দিয়েছিলেন।বোঝার উপায় ছিল না সে আমার মায়ের গর্ভের সন্তান নয়।আমাদের মত আবদার, রাগ,অভিমান তাঁর আমার মায়ের কাছে ছিল।বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে তিনি প্রতিষ্ঠিত হয়ে আমার মায়ের আশ্রয় ছেড়েছেন।
অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিমকে একবার টিভি সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল আগামী বাংলাদেশকে নিয়ে আপনার কি স্বপ্ন? উওরে বলেছিল—আমার একটাই চাওয়া মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ফিরে পাওয়া। তার সুরে সুর মিলিয়ে আমিও বলতে চাই ফিরে আসুক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের মুল্যবোধ।
স্বাধীনতার পর গুলশান বনানী তখন গড়ে উঠেনি।নিউ এলিফেন্ট রোড ছিল অভিজাত এলাকা। স্বাধীনতা পূর্ব আমাদের বাড়িতে একটি দোকান ছিল সিগল নামে।সে দোকানে নায়ক, নায়িকাসহ অনেক অভিজাত লোকেরা আসতেন।তাঁদের মধ্য উল্লেখযোগ্য ছিল নায়ক নাদিম।নাদিমকে দেখে আমরা খুউব উল্লসিত হতাম। মুক্তিযুদ্ধের পর সময়ের চাহিদা অনুযায়ী তখন নিউ এলিফেন্ট রোড সংলগ্ন বাড়ি ঘরগুলো,দোকান পাঠ ডাক্তারদের চেম্বার,ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসাব আত্ম প্রকাশ করে।আমাদের বাড়িতে বসতেন নামি দামী ডাক্তার,ছিল দি ল্যাবরেটরি,আইডিয়াল ল্যাবরেটরিসহ বর্তমান নামি দামি ব্যবসায়ীদের অফিস ঘর।
আমার মনে পড়ে আমার জীবন সঙ্গী দু বছরর শ্রেণিচ্যুত হওয়ার ব্রত শেষ করে, ঢাকা মেডিকেলের পাঠ চুকিয়ে যখন চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন,তখন কাজী ভবনে তাঁর শিক্ষক ডাক্তাররা প্রাকটিস করতেন।তাঁরা তাকে বিকালে প্রেকটিস করার জন্য সেবা ফার্মেসীতে বসতে বলতেন।কিন্তু সে সাহস করত না। বলত, সেখানে আমার শিক্ষকরা রোগী দেখেন,সেখানে আমি কি করে বসি? অধ্যাপক কামরুল হক তাঁকে বসতে বাধ্য করেন।তখন এমবিবিএসের ভিজিট ২০ টাকা,অধ্যাপকদের ভিজিট ছিল সম্ভবত ৪০ টাকা।প্রতিদিন রোগী দেখে ডাক্তার এর আয় হতো শখানেক টাকা।প্রথমদিন হয়েছিল ৭৫ টাকা। কী যে আনন্দ ৭৫ টাকায়!
সেবা ফার্মেসীর মালিকানা প্রথম ছিল, যতদূর মনে পড়ে,সারা জাকেরের বাবা মেজর আমিন চাচার।তবে বিকেলে সেখানে আসতেন লুবনা মরিয়ম আপার বাবা কর্নেল নুরুজ্জামান, নায়লা আপার বাবা,সাম্মু আপা, রায়না আপার বাবা। তাঁরা জমিয়ে আড্ডা দিতেন।সাম্মু আপা কিছুদিন সেখানে সেলসের কাজ করেছিলেন।এক সময় চাচারা সেবা ফার্মেসী ছেড়ে দিলেন।তখন আমার চাচা তাঁর মালিকানা নিয়ে ছিলেন।যেহেতু আমাদের ঔষধের ব্যবসা ছিল।ধীরে ধীরে ধানমণ্ডি, গুলশান,বনানী গড়ে উঠল, নিউ এলিফেন্ট রোড তাঁর গৌরভ হারাল।আমার মনে পড়ে, হার্টের ডাক্তার সিরাজুল ইসলাম চাচা কাজী ভবনের চেম্বার ছেড়ে যখন ধানমন্ডি চেম্বার শুরু করলেন।অনেকদিন পর্যন্ত কাজী ভবনের চেম্বার রেখে দিয়েছিলেন।চাচা বলতেন কাজী ভবনের চেম্বার আমার লক্ষী।যদি ধানমন্ডির চেম্বার আমার প্রসার না ঘটে আমি আবার ফিরে আসব।
না কাউকে আর ফিরে আসতে হয়নি।মধ্যবিত্তের বলয় থেকে সবাই উঠে গেছেন উচ্চবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তে।
প্রসঙ্গ উল্লেখ্য এক সময় প্রয়োজনে ১২ কাঠা থেকে পাঁচ কাঠা বিক্রি করা হয়েছিল।সেখানে গড়ে উঠেছিল ডাক চাইনিজ রেস্তোরা। বসুনিয়াসহ তখনকার বিশ্ববিদ্যালয়েরশিক্ষার্থীদের হল ত্যাগ করতে হলে আশ্রয়ের স্থল হত আমাদের নিউ এলিফেন্ট রোডের কাজী ভবন।মফস্বলের ছেলেদের ঢাকায় থাকার জায়গা না যোগাড় হলে ব্যবস্থা হত আমার মায়ের ৩৯নং নিউ এলিফেন্ট রোড।
আমরা আমাদের কাজী ভবনের মধ্যবিত্তের মুল্যবোধ নিয়ে এখনো টিকে আছি।অভিনেতা শহীদুজ্জামান সেলিমকে একবার টিভি সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল আগামী বাংলাদেশকে নিয়ে আপনার কি স্বপ্ন? উওরে বলেছিল—আমার একটাই চাওয়া মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ফিরে পাওয়া। তার সুরে সুর মিলিয়ে আমিও বলতে চাই ফিরে আসুক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের মুল্যবোধ।
লিনু হক : লেখক