ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: আমার স্বপ্ন, আমার অর্জন

আমার জীবনে ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হতে পারাটা আমার কাছে ‘উপেক্ষিত জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ সংগ্রামের পর স্বাধীনতা অর্জনের যে উদ্দীপনার স্বাদ’- তার সমান। আমি যখন ঢাকা সিটি কলেজে পড়তাম, আমার বড় ভাই মাঝে মাঝেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ক্যাম্পাসটা আমাকে নিয়ে রিকশায় করে ঘুরতেন আর এখানের শিক্ষার্থী হবার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। আমি তখন মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, এই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী হয়ে সগৌরবে ঘুরে বেড়াব। তাইতো, শিক্ষার্থী থাকাকালীন কখনো তার ব্যতিক্রম ঘটাইনি।

ইতি ও নেতির এই নিরন্তর টানাপোড়েন-জীবনের সবচেয়ে স্বর্ণালী দিনগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে কাটিয়েছি। আমার সবচেয়ে ভালো লাগত হলের বাসে চড়ে কলাভবন আসার ব্যাপার টা। আমি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেসা হলের ছাত্রী ছিলাম। নিউ মার্কেটের একটু পেছনের দিকটায়, সমাজকল্যাণ ইন্সটিটিউটের পাশেই আমার হল। বাসের গেইটে দাঁড়িয়ে-ঝুলে আসা-যাওয়া করার যে উল্লাস তা কেবল বাস গেইটে দাঁড়ানো শিক্ষার্থীরাই বলতে পারবে। সেসময় নিজেকে স্বাধীন-সম্রাজ্ঞী মনে হত। হলের বাসে ঝুলে ঝুলে ক্যাম্পাসে যাওয়া-আসার কথা খুব মনে পড়ে।

অফিসে যখন লাঞ্চ করতে বসি মনের অজান্তেই ঠাই পেয়ে যায় বন্ধুরা মিলে দলবলে লাঞ্চ করার কথা। ২০ টাকায় ডাকসুর সেই খিচুরীর অমৃত স্বাদ আর অজস্র আড্ডা। মাঝে মাঝে আমরা চারুকলায় খেতে যেতাম। সবুজে ঘেরা, শান্ত-নিবিড় পরিবেশে আবেশ মাখানো সেই দুপুরের খাবার। ভর্তা-মাছ-মুরগী-ডাল-শাক দিয়ে পেট পুরে ভাত খেতাম। সবচেয়ে ভালো লাগার ব্যাপার ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দুপুরের খাবার কখনো একা খাওয়া হয়নি। অন্ততপক্ষে চার জন তো থাকতামই। একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল- তখন ফার্স্ট ইয়ারের শেষের দিকে, আমাদের একজন সহপাঠী দুপুরের খাবার খেতে যাওয়ার কথা বললে প্রায়ই বলত- “তোরা যা, আমার একটু কাজ আছে। আমি আসছি…”, এই বলে চলে যেত। লাঞ্চের পর ক্লাসে আবার দেখা হলে বলতাম- “কী রে? তুই আসলি না কেন? তোর জন্য কতক্ষণ অপেক্ষা করলাম চারুকলায়”। আমাদের বন্ধুটি কিছু বলত না। কিছুদিন পর আমরা বুঝতে পারলাম, ওর কাছে দুপুরের খাবারের টাকা না থাকায় ও আমাদের সাথে খেতে যেতে চাইত না; আর লজ্জায় কিছু বলতও না। আমরা যেদিন বিষয়টি অনুধাবন করতে পারি, সেদিনের পর থেকে আমরা কখনোই আমাদের সেই বন্ধুটিকে ফেলে খেতে যাই নি আর ওর খাবারের বিল আমরা সবাই মিলে দিয়ে দিতাম। মাসছয়েক পর অবশ্য সে একটা টিঊশনি পেয়েছিল, তারপর আর অসুবিধা হয় নি। “দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ” বাক্যটির অসম্ভব ক্ষমতা এখন অনুভব করতে পারি।

আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতির একটা বড় অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ (ডিইউআরএস) কে জুড়ে। টিএসসি কে বলি আমরা ‘সেকেন্ড হোম’ কারণ ক্লাস শেষে আড্ডা টা টিএসসি তে না হলে ঠিক জমে না। এই আড্ডায় থাকে নানান বর্ষের, নানান বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতির একটা বড় অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ (ডিইউআরএস) কে জুড়ে। টিএসসি কে বলি আমরা ‘সেকেন্ড হোম’ কারণ ক্লাস শেষে আড্ডাটা টিএসসিতে না হলে ঠিক জমে না। এই আড্ডায় থাকে নানান বর্ষের, নানান বিভাগের শিক্ষার্থীরা। সিনিয়র-জুনিয়রের এই আড্ডায় ছিল যুক্তির প্রাচুর্য, মূল্যবোধের দীক্ষা এবং ইন্টেলেকচুয়াল ইন্সট্রাকশন্স যা আমার ভবিষ্যৎ জীবনের অন্যতম পাথেয়। আমার খুব মনে পড়ে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিজ বিশ্ববিদ্যালয় কে রিপ্রেজেন্ট করতে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ‘আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে’ অংশগ্রহণ করতে সদলবলে দেশ প্রস্থান ও ভিন্ন দেশে সম্মান কুড়ানোর কথা। আমরা বিশ জন তরুণ গবেষক নিজেদের গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছিলাম সেই কনফারেন্সে। রিসার্চ টিম নিয়ে উপাচার্য স্যারের সঙ্গে সাক্ষাত, অতঃপর কলকাতার গোটা শহর, আসাম এবং আসানসোল ঘুরে দশ দিন পর নিজ দেশে সগৌরবে ফিরে আসি। সেখানে আমাদের কে ‘ইন্টারন্যাশনাল স্কলার’ বলে সম্বোধন করা হত। তখন আমরা ক’জন মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আর বাকিরা আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে। একটি আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা এত ভারি সম্বোধনে সংবর্ধিত হয়ে তো আমরা মহা খুশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলোর সিংহদ্বার। বিশ্ববিদ্যালয় আজ শতবর্ষ পেরিয়ে। এই শতবর্ষের যাত্রায় আমার যেই পাঁচ বছরের ভাগ আছে, তা নিতান্তই আমার জীবনের সবচেয়ে অপরিমেয় সুন্দরতম সময়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জনগুলোর সিংহদ্বার। বিশ্ববিদ্যালয় আজ শতবর্ষ পেরিয়ে। এই শতবর্ষের যাত্রায় আমার যেই পাঁচ বছরের ভাগ আছে, তা নিতান্তই আমার জীবনের সবচেয়ে অপরিমেয় সুন্দরতম সময়। এই ক্যাপিটালিস্টিক-পৃথিবী একটি ইমপারফেক্ট সেটিংস যেখানে আমরা পার্ফেকশন এবং এবসলিউট হ্যাপিনেস খোঁজার অদম্য আকাঙ্খা নিয়ে ২৪ ঘন্টা নিজেদের তাড়া করে ফিরি। কিন্তু, আমার এই পার্থিব জীবনে এবসলিউট হ্যাপি মোমেন্ট ছিল যেদিন আমি স্বর্ণপদক গ্রহণ করি। কত কদর, কত সম্মান, কত ভালোবাসা, সবকিছু পেয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার জোরেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে আমার সহস্র স্মৃতি কলাভবন-ডাকসু-চারুকলা- টিএসটি- শহীদ মিনার- কার্জনহল- ফুলার রোড- সিনেট ভবন হয়ে আবারও কলাভবনে ঘুরপাক খায়। আমার মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্মৃতিগুলো বয়ে চলে, মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায়। তাই তো শত ব্যস্ততার মাঝেও ছুটে আসি টিএসসি কিংবা কলাভবনে- শুধু এক কাপ চায়ে নিজেকে পুনঃরায় উজ্জীবিত করতে।
নাসরিন জেবিন, শিক্ষার্থী, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়