জোছনা সিনান, পর্ব: ৩

দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শত বছর পূর্তি উপলক্ষে থাকবে বইচারিতার বিশেষ আয়োজন। ধারাবাহিকভাবে লিখছেন কবি, লেখক ও সংগঠক শামীম আজাদ । আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।
হায়রে রোকেয়া হল! এর রসুনের কোয়া যেন অন্তরে পুঁতে দিয়েছে কেউ। এত বছরেও তার ঝাঁজ কমেনি কিছু মাত্র। যেন বুকের বাঁপাশে কেউ লাগিয়ে দিয়েছিল এক সুবাসের গাছ। এখনো ঝাঁজের সঙ্গে পাওয়া যায় তার সুবাস। এর সৃষ্টি হয়েছিল আমাদের শিক্ষক, বন্ধু বান্ধব, আমাদের যাঁরা খাবার বেড়ে দিতেন, যে বাসুদা আমাদের শাড়িতে মাড় ও আব দিয়ে ধুয়ে এনে দিতেন, যে মালিভাই ফুলের কেয়ারি খোঁচাতেন, যে স্যান্ডেলওলা কিশোর তার ঝুড়িতে করে পাঁচ টাকার স্যান্ডেল নিয়ে আসতো সে, যে আমড়াওলা আমড়া বিক্রি করতো এমনকি আমাদের যত কিসিমের ‘ভিজিটর’ থাকতো তারা!
দেখেই চিনতাম কারা অথবা কাহার জন্য অপেক্ষা করছে। রাজনীতি বা শিল্পান্দোলনে থাকা ছেলেদের পায়ে জুতো দেখতাম না। এরা ধুলাধুসরিত পায়ে স্যান্ডেল পরা, হাতে পোস্টার বা লিফলেট নিয়ে একা বা দলে অপেক্ষা করতো। এরা অপেক্ষা করতো দলের মেয়েদের জন্য। আর উষ্কখুষ্ক চুলে অপেক্ষা করতো অধির প্রেমিকেরা। এরা কিছুক্ষণ পেইভমেন্টে বসতো, কিছুক্ষণ পায়চারি করতো, ভয়ে ভয়ে তাকাতো কখন প্রভোস্ট আপার গাড়ি আসে। আমরা তাঁতের শাড়ি পরে এক বা দু’বেনী করে সারিবদ্ধ বেগুনী জারুল গাছের নিচে বসে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে দেখতাম এই সব। টিএসসি জনতা ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসতেন ব্যাংকের সুদর্শন ব্যাংক ম্যানেজার বুলবুল আহমেদ।
আরও দেখেছি শহরের বাইরে থেকে আসা ক্লান্ত অভিভাবক পোটলা করে গুড়মুড়ি বা মায়ের বানানো পিঠা নিয়ে এসেছেন। তাঁরা একে তাকে আমাদেরকে বা হলে ফেরা মেয়েদেরকে জিজ্ঞেস করতেন দেখা করার নিয়মটা কি? অনেক সময় মেয়েরা এঁদেরকে বার্তাবাহকের কাছে স্লিপ পাঠাতে বলে নিজেরাই তাঁর মেয়েটিকে ডেকে দিতো। কিছু তরুণ রিক্সাওয়ালা গাছের নিচে রিক্সার জটলা পাকিয়ে, আপা আসেন আপা আসেন হাঁকতো। কিন্তু কাছে গিয়ে গন্তব্য উল্লেখ করা মাত্র আশাতীত ভাড়া চাইতো। তাতে মেয়েরা রেগে গিয়ে পাশের চালককের কাছে যেতো। সে তার চেয়ে আরও বেশি চাইত। তারপর আরেক জন… লাভ হত না। কারণ ওরা রোকেয়া হল গেটকে তাদের বিশ্রাম ও বিনোদনের স্থান হিসেবেই গন্য করতো। তাই আমাদের পছন্দ ছিলো বুড়ো রিক্সা চালক।
আমার বড়বোন, বুজান আমার স্থানীয় অভিভাবক ছিলেন। সপ্তাহন্তে মাঝে মাঝে লাল জাস্তোভা করে দুলাভাই আমাকে তুলে নিতে এলে গাড়ি রাখার জায়গা না পেয়ে গজ গজ করে বলতেন, তোদের দারোয়ানগুলো করেটা কি! যত্তসব অপদার্থ!
আজ লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে, দারোয়ানগুলো অকেজো পদার্থ হলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা তা ছিল না। ওরাই মাঝে মাঝে ধমকা ধামকি করতো। একবার কোথা থেকে এক উদোম গা আর উঁচু করে গিট্টু দিয়ে লুঙ্গিপরা এক তরুণ পাগল জুটলো। তার হাতে গোলাপ ও গালে কৃষ্ণতুল্য হাসি। গেট থেকে বেরুলেই দৌড়ে ফুলটা এগিয়ে ধরতো। আমরা মাগো বাবাগো বলে শাড়ি মারি নিয়ে দিতাম দৌড়। আর সে তখন রিক্সাওলা ব্রাদারদের নিয়ে ফিকফিক করে হাসতো। ক্লাস বা পাবলিক লাইব্রেরী থেকে হলের সামনে আসার আগেই পাগলকে লোকেট করতাম- যাতে কোনো মতে তাকে এড়িয়ে গেটের ভেতরে ঢুকে পড়তে পারি। পারতাম না। মনে হতো পাগলের উদাম পিঠেও চোখ আছে! একদিন দেখি সব সুমসাম। ব্যাপার কি? তখন মনোবিজ্ঞানের বন্ধু হাসান বল্ল, ছেলেরাই পিট্টি দিয়ে মেয়েদের উত্যক্ত করার সাধ মিটিয়ে দিয়েছে।
কথা হল বাংলাদেশের শীর্ষ কবিদের অন্যতম যে নির্মলেন্দু গুণ তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় তখনি। তিনি তখন আজকের নির্মলেন্দু গুণ না হলেও আবুল হাসান, তিনি, হেলাল হাফিজ এঁদের নাম তখন আমাদের মুখে মুখে। দু’ই কারণে। প্রথমটি তাদের কবিতা, আর দ্বিতীয় কারণ ঐ রোকেয়া হলের সামনে মানে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির বারান্দায় বসে আড্ডা দেয়া।
কথা হল বাংলাদেশের শীর্ষ কবিদের অন্যতম যে নির্মলেন্দু গুণ তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় তখনি। তিনি তখন আজকের নির্মলেন্দু গুণ না হলেও আবুল হাসান, তিনি, হেলাল হাফিজ এঁদের নাম তখন আমাদের মুখে মুখে। দু’ই কারণে। প্রথমটি তাদের কবিতা, আর দ্বিতীয় কারণ ঐ রোকেয়া হলের সামনে মানে বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির বারান্দায় বসে আড্ডা দেয়া। ঝড় বৃষ্টি হাওয়া কিছুওই তাঁকে আটকাতে পারতো না। লম্বা সাদা পাঞ্জাবি, লম্বা চুল, ঢোলা পাজামা, ধুলাধূসরিত পা জোড়ায় স্যান্ডেল এবং তীব্র তীক্ষ্ণ চোখ। মনে হতো রোকেয়া হল থেকে বেড়িয়ে লাইব্রেরির সামনে দিয়ে কলা ভবনের দিকে শর্টকাট রাস্তা ধরে যাবার কালে আমাদের অন্তর বাহির সব দেখে নিচ্ছে কবির চোখ। হেলাল হাফিজের ছিল জলে ভাসা চোখ, পিঠে ঝোলা আর পিন পিন করে কথা বলা। আর আবুল হাসানকে দেখেছি লাইব্রেরির পেছনে শরীফ মিয়ার ক্যান্টিনে। কিন্তু নির্মলেন্দু গুণকে ( পরে নির্মল’দা) লাইব্রেরির ঐ রোয়াক ছাড়া আমরা ভাবতেই পারি না। তাঁর সঙ্গে পুরো ৬৯ সাল গেল শুধু তাকাতাকিতেই। ৭০ এ হুলিয়া বেরুলে রোকেয়া হলের মেয়েদের কাছে নির্মলেন্দু গুণের দাম বাড়ল। আর হেলাল হাফিজের বাড়ল কোনো কবিতা গ্রন্থ ছাড়াই কথায় কথায়।
বাকি রইল আবুল হাসান। তাঁকে আমরা ভীষণ ভালো কবি ছাড়াও কবি ও অসামান্য সুন্দরী সুরাইয়া খানমের প্রেমিক বলে জানতাম। ৭০ এর পর তিন কবিই এই আমি যে কিনা তখন শুধু উঠতি গল্প লেখক সে শামীম তরফদারের বন্ধু হয়েছিলেন। হাসান প্রয়াত কিন্তু বাকি দু’জন এখনো আমার প্রাণের বন্ধু। এখন কথা হয় ফোনে, ম্যাসেঞ্জারে। একজনকে ডাকি নির্মল’দা কিন্তু হেলালকে ডাকি নাম ধরেই কেনো কে জানে। এই ত্রিমূর্তির সঙ্গে আলাপের গল্প অন্যদিন বলা যাবে। আমার জীবনে কবিতার সর এরাই বিছিয়ে ছিলো- আর আমার বন্ধু বাবলী, বাবলী হক। কিন্তু কবিতাতে নিবিষ্ট হই গুরু রফিক আজাদের কারণে। সেও প্রায় ৮০ দশকের কাছাকাছি সময়ে। এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে গেছি। আমি তরফদার থেকে আজাদ হয়েছি।
হলের খাবারে সাধ মিটতো না তাই কেউ কেউ ছোট্ট ইলেক্ট্রিক চুলো কিনে লুকিয়ে চুরিয়ে রুমে রান্না করা করতো। আর গান শোনার একমাত্র উপায় ছিলো লুকানো রেডিও বা টেইপ রেকর্ডার। বিলতো আর আলাদা হয় না! স্মার্ট হলে রান্নার মতো এটাও হাউস টিউটরের চোখ এড়িয়ে করা সম্ভব। শ্রাবণীর প্রতি মৃদু অনুরাগ ছিলো তার এক বিদেশ ফেরত মাসতুতো না পিসতুতো দাদার। আমরা দুই মূর্তি এক সন্ধ্যায় তার কাছে হাজির। তারপর ধারের নামে তার ছোট্ট মিষ্টি এক রের্কড প্লেয়ার হাতিয়ে নিয়ে রিক্সায় উঠেই আমাদের কি উল্লাস! তারপর শুরু হল আমাদের রুমে জনজট! পারুলের সতর্কবানী উপেক্ষা করে ছুটির দিনে, বৃষ্টিভরা বিকেলে, ঘুম ভাঙা রাতে দরোজা বন্ধ করে তা শুনতেই লাগলাম আর শুনতেই লাগলাম। আগেই বলেছি নিচের তলায় থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অসামান্য রূপবতী হাউস টিউটর মেহেরুন্নেসা চৌধুরী আপা। বরিশালের মেয়ে নাকে হিরের ফুল। কিন্তু ঐ সুচারু সরু নাকেই ছিল দুনিয়ার ঘ্রাণ শক্তি আর চাঁপাকলি পায়ে বিড়ালের গতি। রুমে রান্না চড়ালে বা গান ছাড়লে কি করে যে তিনি উঠে আসতেন আল্লাহ মালুম! আমরা আভাস পেতাম কি পেতাম না ধমাধম দাদার রের্কড প্লেয়ারের উপর বালিশ চাপা দিতাম। শেষে দেখা গেল পিনের খোঁচায় রের্কড ক্ষত বিক্ষত আর হাতাটার হাড় ভেঙে ঝুলছে। আর কি আমরা দাদামুখো হই?কিন্তু একদিন আপার মুরগী চুরি করে দোনিরার ঘরে লাল টকটকে ঝোল দিয়ে ডাইনিং রুমের মোটা ভাত এনে ভালো ভোজের পর মহা বিপদে পড়লাম। এখন মুরগী বর্জ্য ফেলি কোথায়? শেষে খবরের কাগজে মুড়ে দেয়ালের বাইরে ফেলা হল। কার বাড়ির উপর? এখনো বলা যাবে না!
বাংলার অধ্যাপক ও প্রিয় শিক্ষক নীলিমা আপা হয়ে এলেন আমাদের রোকেয়া হলের প্রভোস্ট। বাগানের উন্নতি হল। ঘাটের কাছ টা পরিষ্কার হল আর মেইন বিল্ডিঙের পিলারে গায়ে আটকানো একমাত্র পাবলিক টেলিফোনটির মেরামত শেষ হলো। একদিন এরকম আষাঢ় মাসে হঠাৎ আকাশ ফুটো করে, শিরীষগাছ হুড়মুড়িয়ে বৃষ্টি এলো। আমি আর শ্রাবনী দৌড়ে নিচে নেমে সেই অপরূপ রূপালী তরল ধারায় ভিজতে লাগলাম। ভিজতে ভিজতে ও জল ছোড়াছুড়ি করে করে কখন যে চামেলী হাউসের সামনে মেইন বিল্ডিং এর নিচে মূল পয়েন্টে এসে দেখি জানি না। এক সময় দেখি মাঠভরা মেয়ে। সবাই খালি পায়ে চুল খুলে হাত ছড়িয়ে সবাই ভিজছে। হঠাৎ মেঘের র্গজন ছাপিয়ে উঠল নীলিমা ইব্রাহীম আপার গলা! সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই হতভম্ব স্থির ধাতব ভাষ্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। গা গলিয়ে জল্ধারা, কানে বৃষ্টি মাদলের শব্দ। কিন্তু ভালো করে শুনে বুঝি তিনি বকছেন সব পুরুষ স্টাফদের। কেন তারা এখানে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! তাঁর ধমকে মালি, ঢালী, বালি, কালি সবক‘টা দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে নরম কন্ঠে মুখে মৃদু হাসি চেঁপে বল্লেন, শোনো মেয়েরা জ্বর বাঁধালে কিন্তু সোজা বাড়ি পাঠিয়ে দেবো। আর এই আমি যাচ্ছি, কিন্তু পাঁচ মিনিট পর ফিরে এসে যেন মাঠ খালি পাই। সেকি মধুর মুরতি গো ! এবার আনন্দে বিহব্বল হয়ে ফোয়ারা, মাধু, পারুল, লিলি সবকটাকে টেনে এনে বৃষ্টিভেজা ঘাসের গোড়ায় গড়াগড়ি করলাম! আর আপা? পঁচিশ মিনিটেও এলেন না।
২০ জুন ২০২১ লন্ডন
(চলবে)
শামীম আজাদ : কবি, লেখক ও সংগঠক