জোছনা সিনান

দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শত বছর পূর্তি উপলক্ষে থাকবে বইচারিতার বিশেষ আয়োজন। ধারাবাহিকভাবে লিখছেন কবি, লেখক ও সংগঠক শামীম আজাদ । আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
তখনও শামছুন্নাহার হল নির্মান সম্পন্ন হয়নি বিধায় চামেলি হাউস থেকে নিজস্ব সিট হল স্টাফ কোয়ার্টারের তিন তলায়। পাশের কক্ষেই বাংলার লিলি, আখতারি এবং মনোবিজ্ঞানের শিরিন। ওদের কক্ষের সঙ্গেই লাগোয়া বিশাল এক আমগাছে হেলান দেয়া একটি নিটোল বারান্দা। আর বারান্দায় দাঁড়ালেই অদূরে ছেলেদের মোহসীন হল, পাশে সদ্য লাগানো শিশু কৃষ্ণচূড়ার সারির পরেই রেজিস্ট্রেশন ভবন। আমাদের আকর্ষণ ওদিকেই। মাঝে মাঝে ওখান থেকে আমাদের গায়ে এসে পড়ে ওদের হাত আয়নার প্রতিসরণ। বিদ্যূত চলে গেলে ওদের হুক্কাহুয়ার সঙ্গে চলে আমাদের থালা বাসনের শব্দ। কিন্তু ঐ আমগাছএর গাছের গুঁড়িটা হাউস টিউটর মহা সুন্দরী মেহেরুন্নেসা আপার বাসায়। অর্থাৎ আমাদের সর্বশেষ তলে থাকেন হাউস টিউটর। আপার পুত্র ফুয়াদ এবার আমাদের সতীর্থ। আপা ঐ অন্ধকারেই টর্চসহ উঠে আসেন। ততক্ষণে বাতি জ্বলে উঠেছে আর আমরা তো কেউ আর সে বারান্দায় নাই!
আমার রুমমেট হয়ে এসেছিল কুমিল্লা থেকে আসা আমার শৈশবের সঙ্গী ডাগর চোখের সিমীন, টাঙ্গাইল কুমুদিনী কলেজ হোস্টেলের বেস্টফ্রেন্ড ছোট্টখাট্ট পারুল আর চশমা পরা বিশাল টিপ পরা কিন্তু অসম্ভব পাতলা শ্রাবণী। ওদের বিভাগগুলো ছিল যথাক্রমে রাষ্ট্র বিজ্ঞান, অর্থনীতি ও মনোবিজ্ঞান আর আমি তো বাংলার।
শ্রাবণীর না ছিল সময় মত হলে ফেরা না ছিল হলের নিয়ম মানা। ফলে দু’দিনেই সে আমার প্রাণের দোসর হয়ে উঠল আর আমাদের বাউন্ডেলে চলাফেরায় ঐ ছোট মেয়েটা হয়ে গেল আমাদের গার্জেন। সকাল বেলা বেল শুনে ঘুম থেকে ওঠোরে, ডাইনিং রুম থেকে মাখন লাগানো পুরু পাউরুটি চা আনোরে, বাথরুম ও ঘর পরিষ্কার কররে… আমরা কি আর ঠিক মত করি। এর মধ্যে আমারই সহপাঠি, ভালো লেখে, তখনি ললনায় তার ধারাবাহিক উপন্যাস চলছে এবং সে রোকেয়া হলের সঙ্গে অ্যাটাচড ছাত্রী বাবলী হক আমার জিগরী দোস্ত হয়ে গেছে। নব্য সাহিত্যিক আমরা। ক্লাসের ফাঁকে একবার পূর্বদেশ আরেকবার দৈনিক বাংলা করে বেড়াই। গল্প লিখলে পাই পনর টাকা, রেডিওতে অনুষ্ঠান করলে পঁয়ত্রিশ। আর পেলেই স্কলারশিপের টাকা সহ সব জমাই টিএসসির জনতা ব্যাংকে। ছুঁতা পেলেই ব্যাংকে চলে যাই। আসলে আমি আর বাবলী যেতাম সুদর্শন ব্যাংক ম্যানেজারকে দেখতে। ভদ্রলোকের নাম বুলবুল আহমেদ। নাটকে অভিনয় করেন। চুলে টেরিকাটা, চলাফেরায় মহা নায়ক ভাব। শুনছি অচিরেই সিনেমায় অভিনয় করবেন। তার কারনেই কিনা জানি না, আমাদের হলের সব মেয়ের সেখানে এ্যাকাউন্ট ছিল।

ঐসব দৌড়াদৌড়ি করে প্রায়ই রোকেয়া হলের দুপুরের ভাত খাবার সময় সীমা শেষ করে ফেলতাম। তখন প্রায়ই আমি আর বাবলী একটাকা পঁচিশ পয়সা দিয়ে টিএসসি থেকে একজনের ভাত দু’জন ভাগাভাগি করে খেয়ে ফিরতাম। বাবলীও শ্রাবনীর মত স্বল্পাহারী। সুতরাং খেতাম আসলে আমিই। ও খেতো ঝোল, আমি আলু। ও খুঁটে খুঁটে খেতো ইট্টুখানি মাংস, আমি খেতাম বাকিটা এমনকি হাদ্দিটাও। লাইন ধরে পুরু প্লাস্টিকের থালা, বাটি আর ট্রে করে খাবারটা নিয়ে আসতে হতো। মেনুতে মাংস থাকলে তার সুগন্ধ বারান্দার টেবিলটেনিসের বলের সঙ্গে লাফাতো, জিভে জল আসত। দুজনেরই ইংরজি সাবসিডিয়ারি। সেটাই দুপুরে তত। সিপি স্নো পড়াতেন শহীদ অধ্যাপক রাশুদুল হাসান। সেটা না হলে বাবলী চলে যেতো ওর মনোবিজ্ঞান ক্লাসে আর আমি আমার সমাজবিজ্ঞান ক্লাস শেষ করে হলে ফিরে দেখতাম অপেক্ষা করে করে পারুল খাওয়া শেষ করেছে। তখন ঐ পড়ন্ত বিকেলে আমরা দু’জন হলের রান্নাঘরে গিয়ে পাঁচক দাদীদের পটাতাম। তাতে তাঁরা খড়ি কাঠের চুলোর অবশিষ্ট অংগারের উপর এলুমনিয়ামের বাটিতে সামান্য সর্ষের তেলে একটা ডিম ঘুঁটে বসিয়ে দিতেন। সুগন্ধ ছড়াতে ছড়াতে সে ‘মামলেট’ নামধারী জিনিষটা যখন পুডিনের মত ফুলে উঠতো। তখন আমার আনন্দে হাত তালি দিতে ইচ্ছে হত। সেই মামলেটের সঙ্গে দুটো কাঁচা লংকা ডলে ডাইনিং টেবিলে গামলায় রাখা জলবৎ তরলং ডাল দিয়ে সুরুত সুরুত করে মহা তৃপ্তির সঙ্গে আহার শেষ করে রুমে যেতাম।
তখন ঐ পড়ন্ত বিকেলে আমরা দু’জন হলের রান্নাঘরে গিয়ে পাঁচক দাদীদের পটাতাম। তাতে তাঁরা খড়ি কাঠের চুলোর অবশিষ্ট অংগারের উপর এলুমনিয়ামের বাটিতে সামান্য সর্ষের তেলে একটা ডিম ঘুঁটে বসিয়ে দিতেন। সুগন্ধ ছড়াতে ছড়াতে সে ‘মামলেট’ নামধারী জিনিষটা যখন পুডিনের মত ফুলে উঠতো। তখন আমার আনন্দে হাত তালি দিতে ইচ্ছে হত। সেই মামলেটের সঙ্গে দুটো কাঁচা লংকা ডলে ডাইনিং টেবিলে গামলায় রাখা জলবৎ তরলং ডাল দিয়ে সুরুত সুরুত করে মহা তৃপ্তির সঙ্গে আহার শেষ করে রুমে যেতাম।
পারুল বেচারার আমাদের নিয়ে শান্তি ছিল না। এমনকি সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে না ফিরলে মেহেরুন্নেসা আপা রোল কল করার আগে সে নিজে পারত না বলে তাকেই আমাদের প্রক্সি যোগাড় করতে হত। মেইন বিল্ডিং সিঁড়ির গোড়া্র ছিল চিঠি পত্রের কবুতর খোপ। সেখান থেকে রোজ চিঠি আনার কাজে আমার আর শ্রাবণীর সমান উৎসাহ ছিল দারুণ। আমরা দুই দুষ্টু তক্কে তক্কে থাকতাম কার প্রেমপত্র আসে! আজ আর বলব না কার চিঠি খুলে পড়ে ডাইনিং রুম থেকে ভাত এনে গেলে তা পূণরায় আঠা লাগিয়ে দিতাম। আমার আর ওর ঝগড়াও হত অনেক । আমাদের ঘরে মোবাইল ফার্নিচার বলতে ছিল একটি কাঠের আলনা। ঝগড়া হলেই সেটা হয়ে যেত রুম ডিভাইডার।
কিন্তু দুম করে সীমিনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেল ফৌজদার হাট কেডেট কলেজে কর্মরত ভীষণ স্মার্ট ও সুর্দশন এক শিক্ষকের সঙ্গে। আমরা তিন অসম দর্শন মূর্তি হল গেট থেকে কন্যা বিদায় করে শিরীষ গাছ পেরিয়ে পুকুর পাড়ে কাঁদতে বসলাম। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় পাশের রুমের লিলি আর শিরিন ডাকতে এলে বুঝি গালে জলের ধারা শুকিয়ে গেছে। সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করলাম অর্নাস না করে কিছুতেই বিয়ে করবো না। উঠে দাঁড়াবার সময় আমাদের পেছনে ফিরে দেখি পুকুরের জলস্রোতে জোছনা জ্বলছে।কিন্তু তারাওকি সেদিন জানতো একাত্তুর আমাদের তছনছ করে দেবে!
(চলবে )
সকাল, ১৩.৬.২১ লন্ডন
শামীম আজাদ : কবি, লেখক ও সংগঠক
প্রথম পর্ব পড়ুন : জোছনা সিনান