বুদ্ধদেব গুহ’র মৃত্যুতে দুই বাংলায় শোকের ছায়া

অরণ্যপ্রেমী লেখক বুদ্ধদেব গুহ সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট কোভিড সংক্রমিত পরবর্তী নানা জটিলতায় ভুগে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
বন, প্রকৃতি ও অরণ্য প্রেমিক পশ্চিমবঙ্গের এই লেখকের মৃত্যুতে বাংলাদেশ ও ভারতে বিশিষ্টজনেরা টুইটার, ইন্সট্রাগ্রাম, ফেসবুকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে শোকবার্তা জানিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন— ‘বুদ্ধদেব গুহর প্রয়াণে সাহিত্য জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি হল। আমি বুদ্ধদেব গুহর আত্মীয় পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।’
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়— ‘পৌষমাসে আমার বাড়িতে পিঠে খেতে আসত’
কথাশিল্পী বাণী বসু লিখেছন— ‘কোভিডের কোপে পড়ে অনেক ভুগতে হয়েছিল সাহিত্যিককে। শেষের দিনগুলোতে কোনও কিছুই করতে পারতেন না। এনিয়ে আক্ষেপ ছিল তাঁর মনে।
সাহিত্যিক শংকর—“ঋজুদাকে নিয়ে কোয়েলের কাছে চলে গেলেন আপনি … ভালো থাকবেন বুদ্ধদেব গুহ …”,

টুইটারে অভিনেতা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও আবির চট্টোপাধ্যায় লেখেন, “সুখ নেইকো মনে নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে। ভাল থাকবেন। প্রণাম নেবেন।”
অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় —“আবার নক্ষত্র পতন… সাহিত্যে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।”
তথাগত রায় লিখেছেন, ‘আমাদের প্রিয় লালাদা, বুদ্ধদেব গুহ প্রয়াত হলেন। সদাহাস্যময়, আড্ডাবাজ এই লোকটির সান্নিধ্য আর পাওয়া যাবে না। তাঁর সাহিত্যকীর্তির পাশাপাশি তাঁর ব্যক্তিত্বের স্বাদ আমরা যারা পেয়েছি কখনো ভুলতে পারব না।’
অভিনেতা আবির চট্টোপাধ্যায়— ‘সুখ নেইকো মনে
নাকছবিটি হারিয়ে গেছে
হলুদ বনে বনে।
ভালো থাকবেন। প্রণাম নেবেন।’
অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তা লিখেছেন— ‘বুদ্ধদেব গুহ, যাঁর লেখা পড়ে বার বার আশ্চর্য হয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি ! সাহিত্যের আরেক সম্রাটকে হারালাম আমরা আজ, শুধু রয়ে গেল ওনার অনবদ্য সৃষ্টি সব!’
মিউজিক ডিরেক্টর জিৎ গাঙ্গুলি—‘আমাদের মনের মানুষ, মনের মতো মানুষ, আজীবন থাকবেন আমাদের মনের মাঝেই। প্রণাম শ্রী বুদ্ধদেব গুহ।’
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় লিখেছন— ‘ গত কয়েক দশকে বিশ্ব সাহিত্যে ‘ইয়ং অ্যাডাল্ট’ নামে এক বিশেষ ধারা পরিলক্ষিত। এই ধরনের সাহিত্য ‘ইয়ং’-দের ‘অ্যাডাল্ট’ হয়ে ওঠার সহায়ক। আবার পরিণত পাঠকও কৈশোরে ফিরে যেতে চাইলে এমন সাহিত্যে ডুব দিতে পারেন। বাংলায় এমন ধারার অস্তিত্ব সে অর্থে বিরল। যে ক’জন হাতে গোনা সাহিত্যিক সেই রাস্তায় হেঁটেছেন, বুদ্ধদেব তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর রচনা পড়েই সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা কিশোর বয়ঃসন্ধিকে পেরিয়ে যুবক হওয়ার প্রথম পাঠ নিয়েছে। ‘একটু উষ্ণতার জন্য’ মেয়েবেলার আর্তিকে যুবতীবেলায় উত্তরিত করেছে। আক্ষরিক অর্থেই বঙ্গ সাহিত্যের বেশ কয়েক প্রজন্মের পাঠক বুকের মধ্যে ভালবাসার সবুজ অন্ধকারকে বনজ্যোৎস্নায় লালন করেছে তাঁর কলমেরই সুবাদে।’

কবি শাহেদ কায়েস লিখেছেন— ‘কথাসাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ, যার বই পড়ে প্রকৃতিকে আরও বেশি ভালোবাসতে শিখেছি— তিনিও চলে গেলেন! তিনি চলে গেছেন, রেখে গেছেন পদচিহ্ন…. ’
চলচ্চিত্র নির্মাতা ব্রাত্য রাইসু— ‘বুদ্ধদেব গুহ, বিশিষ্ট সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ-র প্রয়াণে আমি গভীরভাবে শোকাহত। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র প্রয়াত বুদ্ধদেব গুহর অনবদ্য লেখনী মননশীল পাঠকদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। তিনি পেশাগত ভাবে একজন সফল চ্যাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হলেও সাহিত্যই ছিলো তাঁর প্রিয় বিষয়। সমকালীন বাংলা সাহিত্যে নিজের জায়গা গড়ে নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘জঙ্গল মহল’-এর পর থেকে ‘মাধুকরী’, ‘অববাহিকা’, ‘বাবলি’ – একের পর এক উপন্যাস উপহার দিয়েছেন পাঠকদের। কিশোর সাহিত্যেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর সৃষ্ট ‘ঋজুদা’ বা ‘ঋভু’র মতো চরিত্র আকৃষ্ট করে রেখেছে কয়েক প্রজন্মের বহু কিশোর-কিশোরীর মনকে। ‘সবিনয়ে-নিবেদন’, ‘চাপরাশ’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা। আমার সাম্প্রতিকতম ছবি ‘ডিকশনারি’ ওনার ‘বাবা হওয়া’ এবং ‘স্বামী হওয়া’ দুটি ছোট গল্পর আধারে তৈরি, ইতিমধ্যেই সমাজের বিভিন্ন স্তরে বহুল চর্চিত। ১৯৭৬ সালে তিনি ‘আনন্দ-পুরস্কার’ পান, এবং পরবর্তীকালে ‘শিরোমনি-পুরস্কার’ এবং ‘শরৎ-পুরস্কার’ সম্মানে ভূষিত হন। পরবর্তী প্রজন্মের সাহিত্যিকদের কাছে তিনি ছিলেন অগ্রজপ্রতিম।
তাঁর প্রয়াণ বাংলার সাংস্কৃতিক জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর আত্মীয়-পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাই।’
উল্লেখ্য, জঙ্গলমহল তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। এছাড়াও বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে খুব অল্প সময়েই এবং তা পাঠক হৃদয়ে ভাস্মর হয়ে আছে। তাঁর গল্পের নায়িকাদের মধ্যে টিটি, টুঁই, কুর্চি এবং নায়কদের মধ্যে ঋজুদা, রুরু, পৃথু উল্লেখযোগ্য। কোজাগর,আয়নার সামনে, অভিল্বাহিক, অববাহিকা,অবরোহী, অদ্ভুত লোক, আলোকঝারি, অনবেষ, বাবলি, বাজে চন্দনপুরের কড়চা, বাংরিপোসির দু রাত্রির, বাসনাকুসুম, বাতি ঘর, চবুতরা, চান ঘরে গান, চারকন্যা, চারুমতি, ছৌ, কুমুদিনী, পাখসাট, পরিযায়ী, একটু উষ্ণতার জন্য, গুঞ্জা ফুলের মালা, হলুদ বসন্ত, জগমগি, যাওয়া-আসা, ঝাঁকিদর্শন, পলাশতলির পড়শি, জঙ্গল মহল, বনোবাসার, লবঙ্গীর জঙ্গলে, খেলা ঘর, কোয়েলের কাছে, মান্ডুর রুপমতী, মহরা, নগ্ন নির্জন, কাঁকড়িকিরা, পামরি, জলছবি, পারিধি, রাগমালা, কুর্চিবনে গান প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। ১৯৭৭ সালে আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন তাঁর ‘হলুদ বসন্ত’ সৃষ্টিকর্মের জন্য।
গ্রন্থনা : রাজিয়া সুলতানা ঈশিতা