আহা! কী যে স্বাদ! বিক্রমপুরের ঐতিহ্যবাহী ‘কাজির ভাত’

কাজির ভাত। ছবি : নিবিড় সাফওয়ান
‘কাজি’ শব্দটি ‘কাঁজি’ শব্দের অপভ্রংশ। আভিধানিক অর্থ পান্তাভাতের টকজল। তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ ‘কাঞ্জি’ থেকে ‘কাঁজি’র উৎপত্তি। মধ্যযুগের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কাঞ্জির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। সেখানে ধর্মকেতুর পত্নী এবং কালকেতুর মাতা ‘নিদয়া’ তাঁর গর্ভাবস্থায় স্বামীর নিকট বিভিন্ন ব্যাঞ্জন খাওয়ার সাধ প্রকাশ করেন। কাঞ্জির কথা সেথায় বর্ণিত হয়েছে এভাবেঃ
“হরিদ্রা রঞ্জিত কাঞ্জি উদর পুরিয়া ভুঞ্জি [হলুদাভ কাজি পেট ভরে খাই]
প্রাণ পাই পাইলে পাকা তাল…”
এমনকি প্রবাদেও ঠাঁই করে নিয়েছে এই ‘কাঁজি’: “গোয়ালা হইয়াও দুধ খাইতে পায় না, কাঁজি খায়।”
বাংলা একাডেমি পত্রিকা’র (ভলিউম ৪৮, পৃষ্ঠা: ৪৬) তথ্য মোতাবেক, “পদ্মার চরাঞ্চলে ‘কাজির ভাত’ খুব প্রিয় খাবার। পানিভরা মাটির হাঁড়িতে গাজানো চালের ভাতই হলো ‘কাজির ভাত’। এর সঙ্গে নানা অনুপান-উপকরণ প্রয়োজন হয়। যেমন: মেথি, কালজিরা, আর শুঁটকি মাছ। মেথি ও কালজিরা খোলায় ভেজে বেটে ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।”
‘কাজির ভাত’ মূলত: বিক্রমপুরের ঐতিহ্য হলেও সংলগ্ন জেলা নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার অনেক বাসিন্দাদেরও এই খাবার খেতে দেখা যায়।
ভূমিকা অনেক হলো। এবার বিস্তারিতভাবে প্রস্তুত-প্রণালী এবং কাজির ভাত খাওয়ার নিয়ম-রীতি নিয়ে আলোচনা করা যাক। এই ভাত রান্নার বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হলো, অন্তত ছয় থেকে সাত দিনের জন্য মাটির হাঁড়িতে মানুষ অনুপাতে চাল ভিজিয়ে রাখা। সেই মাটির হাঁড়ি চুলার পাশে এমনভাবে রাখা যাতে আগুনের আঁচ মাটির হাঁড়িতেও লাগে। ছয়-সাত দিন পর সেই চালটা রান্না করতে হয়। কেউ ভাতের মাড়টা ফেলে দেয়, আবার কেউ ভাতটা এমনভাবে রান্না করে যেন মাড়টা ভাতের মাঝে মিশে যায়। ভাতের মাড় ফেলে দিলে টক স্বাদটা কমে যায়। তবে পুষ্টিবিদদের মতে, মাড় ফেলে না দেওয়াই উত্তম।
কাজির ভাত’ মূলত: বিক্রমপুরের ঐতিহ্য হলেও সংলগ্ন জেলা নারায়ণগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলার অনেক বাসিন্দাদেরও এই খাবার খেতে দেখা যায়।
আরেকটা পদ্ধতি হলো, ভাত রান্নার সময় ধোয়া চাল থেকে পরিমাণ মতো নিয়ে সে চাল একটি মাটির হাঁড়িতে পানির মধ্যে রাখা হয়। সেই মাটির হাঁড়ি চুলার পাশে এমনভাবে বসানো হয় যাতে আগুনের আঁচ মাটির হাঁড়িতেও লাগে। অন্তত ছয় থেকে সাত দিন প্রতিবার ভাত রান্নার সময় ধোয়া চাল থেকে পরিমাণ মতো নিয়ে সে চাল ওই মাটির হাঁড়িতে জমানো হয়। অতঃপর ভাত রান্নার সেই কাঙ্খিত দিন। এক্ষেত্রেও মাড় ফেলে দেয়া যেতে পারে অথবা রাখা যেতে পারে। দীর্ঘ সময়ে মাটির হাঁড়িতে জমানো চাল খানিক ফুলে ওঠে এবং একটু টক হয়ে যায়। সেটাই খাবারে বাড়তি স্বাদ এনে দেয়। তবে বিশেষজ্ঞ রাঁধুনীদের মতে, ওভাবে মাটির হাঁড়িতে জমানো চাল সাতদিনের বেশি রাখা ঠিক নয়। সেটা খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে যেতে পারে। শুধু মাটির হাঁড়িতে রাখা চালটুকু দিয়েও রান্না করা যায়, আবার পরিমাণ মতো ফ্রেস চালের সঙ্গে মিশিয়েও কাজির ভাত রান্না করা যেতে পারে। অনেকে মাটির হাঁড়িতে জমে থাকা পানিটুকু ফেলে দেন।
অনেকে আবার সেটা রান্নার সঙ্গে মিশিয়েও দেন। এতে করে টক স্বাদের বেশ কিছুটা তারতম্য হয়। তবে পুষ্টিবিদদের মতে, মাটির হাঁড়িতে জমে থাকা পানিটুকু ফেলে না দেওয়াই উত্তম।
কাজির ভাত অনেক প্রকার ভর্তা দিয়েই খাওয়ার রেওয়াজ। যেমন- কাঁচামরিচ ভর্তা, ধনেপাতা ভর্তা, চ্যাঁপাশুঁটকি ভর্তা, ধুন্দল ভর্তা, কালিজিরা ভর্তা, বেগুন ভর্তা, বরবটি ভর্তা, ডাল ভর্তা, কচু ভর্তা, শিম ভর্তা, পটল ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা, আলু ভর্তা, কাকরোল ভর্তা, লাউশাক ভর্তা, বাঁটামরিচ ভর্তা, তিল ভর্তা, সরিষা ভর্তা। মূলত ভর্তা দিয়েই এই ভাত পরিবেশন করা হয়। তবে আজকাল ভর্তার পাশাপাশি যুক্ত হয় ইলিশ মাছ, পুঁটি মাছ, দেশি কই মাছ ভাজা।
কাজির ভাত অনেক প্রকার ভর্তা দিয়েই খাওয়ার রেওয়াজ। যেমন- কাঁচামরিচ ভর্তা, ধনেপাতা ভর্তা, চ্যাঁপাশুঁটকি ভর্তা, ধুন্দল ভর্তা, কালিজিরা ভর্তা, বেগুন ভর্তা, বরবটি ভর্তা, ডাল ভর্তা, কচু ভর্তা, শিম ভর্তা, পটল ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা, আলু ভর্তা, কাকরোল ভর্তা, লাউশাক ভর্তা, বাঁটামরিচ ভর্তা, তিল ভর্তা, সরিষা ভর্তা। মূলত ভর্তা দিয়েই এই ভাত পরিবেশন করা হয়। তবে আজকাল ভর্তার পাশাপাশি যুক্ত হয় ইলিশ মাছ, পুঁটি মাছ, দেশি কই মাছ ভাজা।
এই খাবার তৈরি করা কিছুটা ঝামেলার বলে শীতের সময় অনেকে এই খাবার তৈরি করতে চান না। কারণ, শীতকালে চাল কাঙ্খিত পর্যায়ে ফুলে ওঠতে ও টক হতে বেশি সময় লাগে। গ্রীস্ম বা বর্ষার তুলনায় শীতে প্রায় দ্বিগুণ সময় প্রয়োজন হয়। সাধারণত: ভাত-ভর্তা সব একসঙ্গে মেখে কাজির ভাত খাওয়ার রেওয়াজ। সব ভর্তা একসঙ্গে মিশিয়ে খেলে স্বাদ হয় এক রকম আর প্রত্যেক ভর্তা আলাদা আলাদা মেখে খেলে স্বাদ হয় আরেক রকম। এই খাবারটি একা একা খাওয়ায় মজা নেই বললেই চলে। তাইতো পরিবারের সবাই মিলে এক সঙ্গে খেতে হয়। আহা! কী যে স্বাদ! যে একবার খেয়েছে, সেই স্বাদ সে কখনো ভুলতে পারবে না।
হোসাইন মোহাম্মাদ জাকি : গবেষক ও লেখক